নির্ভরতা এক প্রকল্পে

পূরণ হচ্ছে না ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধের এসডিজি লক্ষ্য

  • বিশেষ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুন ১২, ২০১৮, ০৪:৪৬ পিএম
পূরণ হচ্ছে না ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধের এসডিজি লক্ষ্য

ঢাকা : টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্ব থেকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধ করতে চায় জাতিসংঘ। ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম নির্মূল করার লক্ষ্য আছে এসডিজিতেও। তবে ২০১৬ সালেই বাংলাদেশ থেকে শিশুশ্রম নির্মূলের টার্গেট ধরেছিল সরকার। এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাড়ে ৩৪ লাখ শিশুকে পুনর্বাসন করতে হবে। অথচ এ বিষয়ে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় সুনির্দিষ্ট প্রকল্প নেই। ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুদের পুনর্বাসনে নেওয়া প্রকল্পের পরিধিও পর্যাপ্ত নয়। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এক প্রকল্পের আওতায় ২০২০ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত প্রায় দুই লাখ শিশুকে পুনর্বাসন করতে চায়। তারপরও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে থেকে যাবে আরো প্রায় ১০ লাখ ৮০ হাজার শিশু।  

শিশুশ্রম নিয়ে সর্বশেষ ২০১৩ সালে জরিপ করেছে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। তাতে জানা যায়, দেশে প্রায় সাড়ে ৩৪ লাখ শিশু শ্রমে নিয়োজিত। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ১২ লাখ ৮০ হাজার। আর অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে আছে ২ লাখ ৬০ হাজার শিশু। ২০০৩ সালে দেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪২ লাখ। ওই সময় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিতের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৩ লাখ। সে হিসেবে এক দশকের বেশি সময়ে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমিকের সংখ্যা মাত্র ২০ হাজার কমেছে। অবশ্য ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত মাত্র ৯০ হাজার শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে বের করে আনা হয়েছে বলে দাবি করছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এ প্রকল্পের আওতায় প্রথম পর্যায়ে ১০ হাজার, দ্বিতীয় পর্যায়ে ৩০ হাজার এবং তৃতীয় পর্যায়ে ৫০ হাজার শিশুকে পুনর্বাসনের লক্ষ্য ছিল। ৯০ হাজার শিশু পুনর্বাসনের কথা থাকলেও ঠিক কত শিশু এর সুফল পেয়েছে, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান মন্ত্রণালয়ে নেই। এ অবস্থায় আরো দুই লাখ শিশুকে পুনর্বাসনের লক্ষ্য ধরে ২৮৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটির চতুর্থ পর্যায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক এ বিষয়ে বলেন, ২০১৬ সালে লক্ষ্য পূরণ না হলেও ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনে সরকার কাজ করছে। কোন কোন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে কত শিশু নিয়োজিত রয়েছে, তা নিরূপণে জরিপ হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনে সামগ্রিক কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণের কাজ চলছে। সরকার ৩৮টি খাতকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে। এর বাইরে গৃহশ্রমকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আলাদাভাবে গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। পরে গৃহকর্মী সুরক্ষা বিষয়েও আইন করা হবে বলে তিনি জানান।  

এ বিষয়ে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের শিশু বাজেটে বলা হয়েছে, গত তিন বছরে শিশু সুরক্ষায় নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আইএলও আইপেক প্রোগ্রামের আওতায় ৯১টি অ্যাকশন প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন হয়েছে। কাজের তালিকা করে তিন বছরে ৫০ হাজার শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে সরানো হয়েছে। আগামীতে এক লাখ শিশুকে উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষার আওতায় আনা হবে। আর এক লাখ শিশুকে দেওয়া হবে কারিগরি প্রশিক্ষণ। প্রকল্পের আওতায় আসা শিশুরা প্রতি মাসে এক হাজার টাকা করে বৃত্তি পাবে।  

বিবিএস সূত্র জানায়, কর্মক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত ধমক, অপমান, প্রহার বা শারীরিক আঘাত এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে শিশুরা। কর্মে নিয়োজিতদের মধ্যে গড়ে ১৭ দশমিক ১ শতাংশ শিশু ধমকের শিকার হচ্ছে। সিটি করপোরেশন এলাকায় ২৬ শতাংশ এবং গ্রামে ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ শিশু নিয়োগকর্তার ধমকের শিকার হচ্ছে।  

কর্মক্ষেত্রে প্রহার বা শারীরিক আঘাতের শিকার হচ্ছে ১ দশমিক ২ শতাংশ শিশুশ্রমিক। যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে ২ দশমিক ৫ শতাংশ শিশুশ্রমিক। এর মধ্যে ছেলে শূন্য দশমিক ৪ এবং মেয়ে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। সিটি করপোরেশন এলাকায় যৌন নির্যাতনের হার সবচেয়ে বেশি, ৯ দশমিক ৭ শতাংশ এবং গ্রামে ১ দশমিক ৩ শতাংশ।  

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ১২ থেকে ১৩ বছর বয়সের শিশুরা সবচেয়ে বেশি ধমক বা অপমানের শিকার হয়। এ ছাড়া প্রহার বা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় সবচেয়ে বেশি ৬ থেকে ১১ বছরের শিশুরা। অন্যদিকে ১৪ থেকে ১৭ বছরের শিশুরা সবচেয়ে বেশি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।  

শিশুরা কোন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত আছে তার একটি চিত্রও উঠে এসেছে পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে। এতে বলা হয়েছে, ধুলা, ময়লা, ধোঁয়া এবং কম্পমান স্থানে কাজ করে ১৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ শিশু। আগুন, গ্যাস এবং স্ফুলিঙ্গময় স্থানে কাজ করে ৩ দশমিক ১৬ শতাংশ। অতিঠান্ডা বা অতিমাত্রায় গরম পরিবেশে কাজ করে ৩ দশমিক ৭২ শতাংশ। বিপজ্জনক যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ করে ৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ শিশু। খুবই নিচু বা উঁচু স্থানে কাজ করে ১ দশমিক ৫৫ শতাংশ। পানি অর্থাৎ পুকুর বা নদীতে কাজ করে ১ দশমিক ১ শতাংশ, অন্ধকার বা সীমাবদ্ধ পরিবেশে ১ দশমিক ৬৬ শতাংশ, রাসায়নিক বা বিস্ফোরক দ্রব্য আছে এমন পরিবেশে ১ দশমিক ৪৮ শতাংশ এবং অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করে শূন্য দশমিক ৬৪ শতাংশ শিশু।
আইএলওর প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০০ সালের পর থেকে বিশ্বে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা কমছে। বর্তমানে বিশ্বে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ১৬ কোটি ৮০ লাখ। ২০০০ সালে ছিল ২৪ কোটি ৬০ লাখ। ৮ কোটি ৫০ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। এ সংখ্যা মোট শিশুশ্রমিকের অর্ধেকের বেশি। ২০০০ সালে ১৭ কোটি ১০ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ছিল।  

মূলত অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতেই বেশি শিশুশ্রমিক নিয়োজিত আছে বলে দাবি করেছে আইএলও। সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বিশ্বে ৯ কোটি ৮০ লাখ শিশু কৃষিকাজে নিয়োজিত আছে। এ হিসেবে কৃষি খাতে কাজ করছে মোট শিশু শ্রমিকের ৫৯ শতাংশ। এর বাইরে সেবা খাতে ৫ কোটি ৪০ লাখ ও শিল্প খাতে ১ কোটি ২০ লাখ শিশু শ্রমিক রয়েছে।  

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Link copied!