• ঢাকা
  • রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

পঞ্চগড়ে লাম্পি স্কিনে মারা যাচ্ছে শত শত গরু, দিশেহারা খামারিরা


পঞ্চগড় প্রতিনিধি জুন ২০, ২০২৩, ১১:২৫ এএম
পঞ্চগড়ে লাম্পি স্কিনে মারা যাচ্ছে শত শত গরু, দিশেহারা খামারিরা

পঞ্চগড়: উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে দেখা দিয়েছে গবাদি পশু গরুর লাম্পি স্কিন রোগের প্রাদুর্ভাব। দ্রুত গ্রাম থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে রোগটি। সুচিকিৎসা না মেলায় ধুকে ধুকে মারা যাচ্ছে গরু। গত এক মাসে জেলার অন্তত এক হাজারেরও অধিক গরু এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। দিন দিন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এই সংখ্যা। গরু প্রতি চিকিৎসায় ব্যয় হচ্ছে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা। তারপরও সুস্থ্য করা যাচ্ছেনা আক্রান্ত গরুকে। ফলে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন গরু খামারিরা।

পঞ্চগড় সদর উপজেলার কামাতকাজলদিঘী ইউনিয়নের দফাদারপাড়া এলাকার বাসিন্দা আমেনা বেগম। স্বামী পরিত্যক্তা এই নারী এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে একটি শাহিওয়াল জাতের গাভী ক্রয় করেন। আর কদিন পরই গাভীটি বাচ্চা প্রসব করতো। কিন্তু এর মধ্যেই লাম্পিস্কিন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় গাভীটি। অসহায় এই নারী এখন গরুর শোকে প্রতিদিন কাঁদছেন। 
তিনি জানান, গাভীটি লাম্পিস্কিনে আক্রান্ত হলে প্রথমে স্থানীয় পশু চিকিৎসক আনিসুরের মাধ্যমে চিকিৎসা করান। কিন্তু কাজ না হওয়ায় পরে মিজানুর নামে আরক স্থানীয় পশু চিকিৎসকের মাধ্যমে চিকিৎসা শুরু করেন। কিন্তু তার চিকিৎসায় গরুর অবস্থার আরও অবনতি হয়। ১০ দিন ভুগে অবশেষে মারা যায় গরুটি। 

আমেনা বেগম বলেন, আমি নিজের সন্তানের মতো করে গরুটি লালন পালন করেছি। এক লাখ টাকা দাম হতো। আশা ছিলো গরুটি বিক্রি করে ঋণ শোধ করবো। এখন স্থানীয় পশু চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় আমার গরুটি মারা গেলো। আমার সম্পদ বলতে এই গরুটিই ছিলো। সেটিও রইলো না। এখন ঋণের চিন্তায় ঘুমাতে পারি না। গরুটির কথা মনে হলেই চোখে পানি চলে আসে। শুধু আমেনা বেগম নয় পঞ্চগড়ে লাম্পিস্কিন রোগে আক্রান্ত হয়ে পালিত গরুটি হারিয়েছেন এমন সংখ্যা দুই একটা নয়। দরিদ্র কৃষকদের সম্বল গরু এভাবে মারা যাওয়ায় তাদের অভাব ত্বরান্বিত হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাস খানেক আগে এ জেলায় দেখা দেয় গরুর প্রাণঘাতি লাম্পিস্কিন রোগ। দ্রুতই তা এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে জেলার পাঁচ উপজেলাতে অন্তত এক হাজারেরও বেশি গরু এই রোগে আক্রান্ত রয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় মারা গেছে অন্তত ১০ টি গরু। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্ত গরুর সংখ্যা। শুরুতে সারা শরীরে বসন্তের মতো গুটি গুটি উঠছে। তারপর পায়ের হাটু গোড়ালি ও গলা ফুলে যাচ্ছে। গলায় জমছে পানি। জ্বর ও প্রচন্ড ব্যথায় খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দেয় আক্রান্ত গরুগুলো। অনেক সময় মুখ দিয়ে লালা পড়ে। কেউ কেউ আক্রান্ত গরুকে অন্য গরু থেকে মশারি দিয়ে আলাদা করে রাখছেন। কিন্তু তারপরও সংক্রমণ ঠেকানো যাচ্ছে না। গরিবের সম্পদ গরু মারা যাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন গরু পালনকারীরা। চিন্তায় নিদ্রাহীন কাটছে রাত। একদিকে অভাব আর অন্যদিকে গরুর চিকিৎসায় ব্যয় হচ্ছে বাড়তি টাকা। 

গরু খামারিদের অভিযোগ, প্রাণী সম্পদ অফিসের চিকিৎসকদের ডাকলে সাড়া পাওয়া যায় না। কখনো আসলেও তাদের দিতে হয় বড় অঙ্কের ফি। নিরুপায় হয়ে তারা গ্রামের পশু চিকিৎসকদের মাধ্যমে আক্রান্ত গরুর চিকিৎসা করাচ্ছেন। এ রোগে নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা না থাকলেও গ্রাম্য চিকিৎসকরা যে যার মতো ওষুধ প্রয়োগ করছেন বলেও অভিযোগ তাদের। চিকিৎসার পেছনে গরু প্রতি খরচ হচ্ছে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা। তারপরও অনেক গরুকে মৃত্যুর হাত থেকে ফেরানো যাচ্ছে না। লাম্পি স্কিন ভয়াবহ আকার ধারণ করলেও প্রাণী সম্পদ অফিসসহ সংশ্লিষ্টদের তেমন কোন তৎপরতা নেই। ভুক্তভোগী খামারিরা সরকারি উদ্যোগে এই রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কারসহ ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন। 

পঞ্চগড়ের গলেহাপাড়া এলাকার গরু পালনকারী মনিরুল ইসলাম বলেন, ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে গরুটি কিনেছিলাম। সঠিক চিকিৎসা না পাওয়ায় গরুটি লাম্পিস্কিন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলো। পশু হাসপাতালে নিয়ে গেলে সার্জনরা গরু না দেখেই ওষুধ লিখে দেয়। আর বাড়িতে তাদের ডাকলে এক হাজার টাকা ভিজিট দিতে হয়। এমনিতে অভাব চলছে তার মধ্যে গরুটি মারা গেলো। 

একই এলাকার নার্গিস আক্তার বলেন, গরুই হলো আমাদের সম্পদ। এই গরু লালনপালন করে বিক্রি করে আমরা সংসারের কাজে লাগাই। মেয়ের বিয়েতে খরচ করি। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ দেই। কিন্তু এই রোগে আক্রান্ত হয়ে আমার গরুটি মারা গেলো। কোন কাজেই লাগাতে পারলাম না। আমাদের এলাকায় প্রতি বাড়িতেই এক দুটি করে গরু এই রোগে আক্রান্ত। কিন্তু সুচিকিৎসা পাচ্ছিনা আমরা। প্রাণী সম্পদ অফিসের লোকজনও খোঁজ খবর নিতে আসে না। 

মামুনুর রশিদ বলেন, বর্তমানে সব এলাকায় লাম্পিস্কিন রোগ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা খরচ করে চিকিৎসা করিয়েও গরুগুলো বাঁচানো যাচ্ছে না। প্রতি বছরই এ রোগে গরুগুলো মারা যাচ্ছে। এই রোগের প্রতিষেধক বা প্রতিকার করার জন্য সরকারি উদ্যোগে জরুরি।

এদিকে, লাম্পি স্কিনের প্রাদুর্ভাব বাড়ায় জেলার পশুর হাটগুলোতে এবার পশুর আমদানি অনেকটাই কম। জেলার রাজনগর, নগরকুমারিসহ বড় বড় হাটগুলোতে গত বছরের তুলনায় পশুর আমদানি কমেছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। 

কামাতকাজলদিঘী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তোফায়েল প্রধান বলেন, এই রোগের প্রতিকারে সরকারের কার্যকরী প্রদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। আমাদের ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামেই এই রোগে গরু আক্রান্ত হয়েছে। এক ব্যক্তি আক্রান্ত গরু পশু হাসপাতালে নেয়ার পথেই মারা যাওয়ায় রাগে ক্ষোভে রাস্তার পাশেই ফেলে চলে যায়। আমরা পরে সেটি মাটি চাপা দেয়ার ব্যবস্থা করি। 

পঞ্চগড় রাজনগর পশুরহাটের ইজারাদারের প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেন বলেন, এবার পশুরহাটে গরুর আমদানি মারাত্মকভাবে কমেছে। গত বছরের তুলনায় এবার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত পশু আমদানি কমে গেছে। মূলত লাম্পি স্কিন রোগ সব এলাকায় ছড়িয়ে পড়ায় পশুরহাটগুলোর এই পরিস্থিতি। 

পঞ্চগড় জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. আব্দুর রহিম বলেন, লাম্পিস্কিন ভাইরাস জনিত রোগ। এটি মশা মাছির মাধ্যমে ছড়ায়। লাম্পিস্কিন রোগের সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা না থাকলেও রোগের ধরণ অনুযায়ী চিকিৎসা দেয়া হয়ে থাকে। আতঙ্কিত না হয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও মশা মাছি থেকে গরুকে নিরাপদ রাখতে হবে। কতগুলো গরু আক্রান্ত তার সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। তবে সীমান্ত এলাকায় এটি বেশি ছড়াচ্ছে। দুএকটি গরু মারাও গেছে। এছাড়া গ্রামের ভুয়া চিকিৎসকদের দৌরাত্ম ঠেকাতে তাদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। আমাদের অফিসের কারো বিরুদ্ধে কারো কোন অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 

সোনালীনিউজ/আরএম/এসআই

Wordbridge School
Link copied!