• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৪, ৬ কার্তিক ১৪৩১

লবণে স্বস্তি নিয়ে চামড়ার জন্য প্রস্তুত পোস্তা


 নিজস্ব প্রতিবেদক জুন ১৭, ২০২৪, ১০:৩১ এএম
লবণে স্বস্তি নিয়ে চামড়ার জন্য প্রস্তুত পোস্তা

ঢাকা : গুদাম পরিষ্কার করে লবণ কিনে রাখা হয়েছে, অস্থায়ী শ্রমিকদেরও দেওয়া হয়েছে খবর। পশুর চামড়া সংগ্রহের সবচেয়ে বড় মৌসুম কোরবানির ঈদ ঘিরে প্রস্তুত পুরান ঢাকার পোস্তার আড়তগুলো।

অনুকূল আবহাওয়া, ট্যানারির কাছ থেকে অধিকাংশ পাওনা আদায় এবং লবণের দাম স্থিতিশীল থাকায় এবার অনেকটা স্বস্তিতে আছেন পোস্তার ব্যবসায়ীরা। সরকার ট্যানারি পর্যায়ে কোরবানির পশুর চামড়ার দর বাড়ানোয় এবার তারা ভালো ব্যবসার আশা করছেন।

পোস্তার দীর্ঘদিনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আনোয়ারুল ওহাব অ্যান্ড ব্রাদার্সের পরিচালক তারিক ইবনে আনোয়ার বলেন, আড়তে এহন মাল নাই। লেবার দিয়া পরিষ্কার করছি। নতুন চামড়া উডানোর সময়তো ধুলা-ময়লা ঝাইড়া দেওন লাগে।

বাংলাদেশে পশুর চামড়ার যে চাহিদা, তার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ পূরণ হয় কোরবানির পশু থেকে। সে কারণে এ সময়টাই চামড়া সংগ্রহের মূল মৌসুম।

সোমবার (১৭ জুন) সকালে ঈদেরনামাজ পড়েই পুরো শহরে শুরু হবে পশু কোরবানির তোড়জোড়। পাড়া-মহল্লা ঘুরে কাঁচা চামড়া কিনে বা সংগ্রহ করে মৌসুমি ক্রেতারা তা বিক্রি করবেন আড়তে। আড়ত সেই চামড়া কিছুটা প্রক্রিয়াজাত করে ট্যানারিগুলোর কাছে বিক্রি করবে।

ঈদ সামনে রেখে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার; ঢাকায় গরুর চামড়ার দাম গতবারের চেয়ে ৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩ টাকা বেড়েছে।

ট্যানারি ব্যবসায়ীদের এবার ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া কিনতে হবে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়; গত বছর এই দাম ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা।

ঢাকার বাইরে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম হবে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা, গতবছর যা ৪৭ থেকে ৫২ টাকা ছিল।

এছাড়া সারা দেশে লবণযুক্ত খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ২০ টাকা থেকে ২৫ টাকা দরে বিক্রি হবে ট্যানারিতে, যা গত বছর ছিল ১৮ টাকা থেকে ২০ টাকা, আর বকরির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১৮ টাকা থেকে ২০ টাকা, যা আগের বছর ছিল ১২ থেকে ১৪ টাকা।

পুরান ঢাকার হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সরিয়ে সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে নেওয়া হলেও ঢাকায় কাঁচা চামড়া সংগ্রহের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র লালবাগের ওই পোস্তা। কোরাবানির ঈদে পোস্তায় গড়ে ৪ লাখের মত চামড়া আসে।

শনি ও রোববার পোস্তায় ঘুরে দেখা গেল, নিয়মিত ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও অস্থায়ীভাবে ভাড়া নেওয়া গুদাম ঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করছেন। যারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে চামড়া সংগ্রহ করেন, সেই সব মৌসুমি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন আড়তদাররা। পাশাপাশি শ্রমিকদেরও বলে রাখা হচ্ছে, যাতে তারা ঈদের দিন ঠিকঠাক কাজে চলে আসেন।

লবণে এবার ‘ভারমুক্ত’ : কাঁচা চামড়া সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজন হয় মোটা দানার লবণের, যা একটু লালচে রঙের হয়। ব্যবসায়ীদের কাছে ‘লাল লবণ’ নামে পরিচিত এ শিল্প লবণ বাজারজাত করা হয় ৫০, ৬০ ও ৭০ কেজির বস্তায়। কিন্তু প্রতিবছর কোরবানির ঈদের মাস খানেক আগে থেকে বাজারে লবণের দাম বেড়ে যায়, ফলে ভুগতে হয় পাইকারদের।

এবছর লবণের দাম মোটামুটি গতবারের মত থাকায় স্বস্তিতে আছেন আড়তদাররা। পোস্তার সোহরাওয়ার্দী অ্যান্ড ব্রাদার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন এবার মুনাফা নিয়ে আশবাদী।

তিনি বলেন, ৭০ কেজির বস্তার দাম ১১০০ টাকা থেকে ১১৫০ টাকায় আছে। লবণের দাম নিয়ে এবার কোনো সমস্যা নেই। আগের মতই আছে। গতবার একটু বাড়ছিল দাম।

খুচরা পর্যায়ে ৭০ কেজি বস্তার লবণের দাম উঠেছে সর্বোচ্চ এক হাজার ৩০০ টাকা। গতবারও এই দামে ছিল।

পোস্তার আড়তদাররা পাইকারি দরে লবণ কেনায় তাদের দাম বাড়েনি বলে জানিয়েছেন আনোয়ারুল ওহাব অ্যান্ড ব্রাদার্সের পরিচালক তারিক ইবনে আনোয়ার।

অন্যদিকে উৎপাদন বেশি হওয়ায় লবণের দাম এবার কেজি প্রতি দুই টাকা কমেছে বলে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশেনের (বিসিক) লবণ সেলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

তারা বলছেন, গতবারের চেয়ে এবার লবণ উৎপাদন যেমন বেশি হয়েছে, তেমনি মিল চালু থাকায় সরবরাহেও ঘাটতি নেই।

চলতি অর্থবছর দেশে লবণ মৌসুমে উৎপাদন হয়েছে ২৪ লাখ ৩৭ হাজার ৮৯০ টন, যা ৬৩ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

এবার চাহিদার চেয়েও ৪৭ হাজার টন বেশি লবণ উৎপাদন হয়েছে জানিয়ে বিসিকের লবণ সেলের প্রধান সরোয়ার হোসেন বলেন, লবণের সরবরাহ ঠিক রাখতে তিন স্তরের মনিটরিং টিম কাজ করছে। বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে তদারকি করা হচেছ। দাম ও সরবরাহ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। উৎপাদন বেশি হওয়ায় গতবারের চেয়ে কম দামেই লবণ কিনতে পারবেন ব্যবসায়ীরা।

বিসিকের তথ্য অনুযায়ী, এবার ডিলার পর্যায়ে শিল্প লবণের পাইকারি দর প্রতি কেজি ১৭ টাকা ৫০ পয়সা, আগের বার ছিল ১৯ টাকা ৫০ পয়সা।

এবার দেশে কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা এক কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার। এর বিপরীতে এক লাখ ৪৭ হাজার ৬০০ টন লবণের মজুত রয়েছে বিক্রেতা পর্যায়ে।

গতবার এক কোটি ২৪ হাজার পশুর চামড়া সংরক্ষণে লবণ লেগেছিল ৮৯ হাজার টন। বিসিক কর্মকর্তাদের ধারণা, এবার লবণ লাগতে পারে এক লাখ টন।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ৫০ কেজির প্রতি বস্তা লবণে ৬-৭টির মত চামড়া সংরক্ষণ করা যায়। এজন্য ব্যবসায়ীরা বেশিরভাগই ৭০ কেজি ওজনের বস্তা ব্যবহার করেন। তাতে ছোট-বড় মিলিয়ে গড়ে ১০টির মতো চামড়া সংরক্ষণ করা যায়।

এমনিতে প্রতিটি চামড়ায় ৫ কেজির মত মোট দানার লবণ প্রয়োজন হয় সাধারণত। কিন্তু ঈদের সময় অনেক অদক্ষ ও মৌসুমি শ্রমিক কাজ করেন বলে লবণের খরচ বেড়ে যায়।

বৃষ্টি ভোগাবে : আষাঢ় মাসের তৃতীয় দিনে হতে যাচ্ছে কোরবানির ঈদ। আবহওয়া অফিস জানিয়েছে, ঈদের দিন ঢাকায় হালকা বৃষ্টি হতে পারে। তবে চট্টগ্রাম, রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেটে ভারি বৃষ্টির আভাস রয়েছে।

আড়তদার মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন বললেন, হালকা বৃষ্টি হলে চামড়া সংরক্ষণে সমস্যা হবে না। কিন্তু দীর্ঘ সময় বৃষ্টিতে চামড়া ভিজলে নষ্ট হওয়ার শঙ্কা থাকে।

বৃষ্টি বেশি হলে চামড়া দ্রুত পোস্তায় আনা কষ্টকর। চামড়া যত দ্রুত পোস্তায় চলে আসবে, তত দ্রুত সংরক্ষণ করা যাবে। পানি একটু লাগলে সমস্যা নাই, অনেক সময় ভিজলে চামড়ার টেম্পার কমে যায়।

এবার বর্ষা মৌসুমে ঈদ পড়ায় সেভাবেই কর্মীদের নির্দেশনা দেওয়ার এবং প্রস্তুতি নেওয়ার জানালেন শাহাবুদ্দিন।

ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ এবারও : চামড়া ব্যবসায়ীরা ঈদের সময় টাকা ধার করে কিংবা বিভিন্ন উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করে ব্যবসা ধরে রাখেন। তাদের ঋণ দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে আগে একটি লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিত বাংলাদেশ ব্যাংক।

গতবার সেই অঙ্ক ছিল ২৫৯ কোটি টাকা। এবার সেখান থেকে সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সরকারি-বেসরকারি কোনো ব্যাংক ঋণে তদারকি করবে না বলে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে।

তবে চামড়া শিল্পে খেলাপি ঋণ নবায়নের সুবিধা এবারও আছে। বিভিন্ন ব্যাংক চামড়া খাতের ১৭০ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করেছে। এখান থেকে নতুন করে ৫০-৬০ কোটি টাকার ঋণ নেওয়া হতে পারে বলে ধারণা করছেন বাংলাদেশ ট্যানারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ।

তিনি বলেন, চামড়া খাতে ২০১৯ সালের কিছু বকেয়া এখনো আছে। বিভিন্ন ট্যানারি শিল্প তা পরিশোধও করছে। গত কয়েক বছর ধরে নতুন করে কোনো বকেয়া তৈরি হয়নি। নগদ টাকা দিয়েই চামড়া সংগ্রহ করছেন ট্যানারি মালিকরা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সবশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে চামড়া রপ্তানি করে বাংলাদেশের ১২২ কোটি ৩৬ লাখ ডলার আয় হয়েছে। চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে এ খাতে আয় হয়েছে ৮৭ কোটি ২৪ লাখ ডলার। সূত্র : বিডিনিউজ

এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!