সাবেক ডিসি ফয়জুলকে বাঁচাতে মরিয়া জনপ্রশাসনের শায়লার সিন্ডিকেট

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মে ১৯, ২০২৫, ০৯:৪৬ পিএম
সাবেক ডিসি ফয়জুলকে বাঁচাতে মরিয়া জনপ্রশাসনের শায়লার সিন্ডিকেট

ঢাকা: অন্যের স্ত্রীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগের প্রাথমিক তদন্তে সত্যতা পেয়ে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদ থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল এ এন এম ফয়জুল হককে। 

সরকারের দুইটি গোয়েন্দা সংস্থা অভিযোগের প্রমাণ পেলেও পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়নি। উপরন্তু বর্তমানে বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া এবং তৎকালীন জনপ্রশাসনের অতিরিক্ত সচিব শায়লা ফারজানার আর্শীবাদপুষ্ট হওয়ায় যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতিও পেয়েছেন তিনি। 

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অর্ন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরেও সাবেক ডিসি ফয়জুলকে বাঁচাতে মরিয়া হয়েছে জনপ্রশাসনের সেই শায়লা সিন্ডিকেট। ফলে প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণিত হওয়ার পরেও তাকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টায় ব্যস্ত সেই সিন্ডিকেটের বহাল কর্মকর্তারা।

ভুক্তভোগী অভিযোগকারী জানান, তৎকালীন বাগেরহাট জেলা প্রশাসক আ.ন.ম. ফয়জুল হক তার স্ত্রীকে প্রলোভন দেখিয়ে পরকীয়ায় লিপ্ত হন এবং সংসার ভেঙে দেন। এমনকি একপর্যায়ে অভিযোগকারীকে খুন করার হুমকি দেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে ২০২১ সালের ১১ এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদ সচিব বরাবর তিনি লিখিত অভিযোগ করেন।

তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের মৌখিক নির্দেশে অভিযোগটি জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা (এনএসআই) ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই) যৌথভাবে তদন্ত চালিয়ে অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণ করে। 

এ প্রেক্ষিতে ফয়জুল হককে ডিসি পদ থেকে প্রত্যাহার করা হয়। এই বিষয়টি মন্ত্রিপরিষদ সচিব নিজেও ১০ জুন ২০২১ তারিখে ডিসিদের পরিচিতি সভায় উল্লেখ করে বলেন, বাগের হাটের সাবেক জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে প্রমাণিত হয়েছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পরেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তার বিরুদ্ধে কোন বিভাগীয় মামলা করেনি।

আ.ন.ম. ফয়জুল হক স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার শাসনামলে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত এর একান্ত সচিব হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। এরপরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলামের ঘনিষ্ট হওয়ায় সিটি করপোরেশন-১ শাখায় ৪ বছর চাকুরী করেছেন। এসময় তার বিরুদ্ধে ৫০ কোটি টাকা আত্নসাতের অভিযোগ ওঠে। কিন্তু মন্ত্রীর ঘনিষ্ট ও শায়লা সিন্ডিকেটের সদস্য হওয়ায় সেই অভিযোগের ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সেই সময়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক ছিলো বহুল আলোচিত ৫ আগস্টের পরে পালিয়ে যাওয়া পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মনিরুল ইসলামের স্ত্রী ও অতিরিক্ত সচিব শায়লা ফারজানা। এই কর্মকর্তা এ এন এম ফয়জুল হকের ঘনিষ্ট হওয়ায় সেই সময়ে তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর ভুক্তভোগী আবারও প্রতিকার চেয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। কিন্তু এখনও জনপ্রশাসনে শায়লার সিন্ডিকেটে বহাল থাকায় ন্যায় বিচার বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।

জনপ্রশাসনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ভুক্তভোগীর অভিযোগের তদন্ত করতে গত ৬ ফেব্রুয়ারী সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা-১ অধিশাখার যুগ্মসচিব শাহীন আরা বেগমকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেয় জনপ্রশাসনের শৃঙ্খলা-১ অধিশাখা।

তদন্ত কর্মকর্তা শাহীন আরা বেগমের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এই কর্মকর্তা স্বৈরাচারের শাসনামলের ২০২১ সালের ১ মার্চ থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত আছেন। শায়লা ফারজানার ঘনিষ্ট হওয়ায় দাপটের সাথে ৩ বছর চাকুরী করেছেন। শেখ হাসিনার পতন হলেও এই কর্মকর্তা এখনো বহাল রয়েছেন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ছাড়াও স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার শাসনামলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়, মৎস ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয়, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, নারায়নগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার নির্বাহী অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

শায়লা ফারজানার সময়ে শৃঙ্খলা-১ শাখার উপসচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন ২২ তম প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা ডা. মো: নুরুল হক। উপসচিব বা তদুর্দ্ধ কর্মকর্তার বিষয়ে শৃঙ্খলাজনিত অভিযোগ ও বিভাগীয় মামলা এই শাখার অধীনে। শায়লা ফারজানার নির্দেশে এই কর্মকর্তা এ এন এম ফয়জুল হকের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগ ফাইলবন্দী করে রাখেন।

এই কর্মকর্তার ব্যক্তিগত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এই কর্মকর্তা স্বৈরাচারের শাসনামলের ২০২০ সালের ৫ জুলাই থেকে অদ্যবধি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত আছেন। শায়লা ফারজানার ঘনিষ্ট হওয়ায় দাপটের সাথে ৫ বছর চাকুরী করেছেন। শেখ হাসিনার পতন হলেও এই কর্মকর্তা এখনো বহাল রয়েছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ছাড়াও স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার শাসনামলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন, সরকারী কর্মকমিশন সচিবালয়ের মত গুরুত্বপুর্ণ জায়গায় কাজ করেছেন।

এই দুই কর্মকর্তা ছাড়াও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে শায়লা ফারজানার ঘনিষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন এটিএম শরিফুল আলম। এই কর্মকর্তা নারায়নগঞ্জের রুপগঞ্জের এসিল্যান্ড, ২০১৪ সালের বিতর্কিত ভোটের সময় যশোরের শর্শার ইউএনও হিসেবে কাজ করেছেন। ২০ তম ব্যাচের মোহাম্মদ শামীম সোহেল চট্রগ্রাম ওয়াসার সচিব, চাদপুরের এডিসি, নোয়াখালীর সেনবাগের ইউএনও হিসেবে কাজ করেছেন। উর্দ্ধতন নিয়োগ-৩ শাখার উপসচিব তৌহিদ বিন হাসান, উর্দ্ধতন নিয়োগ-৪ শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন সারোয়ার, অভ্যন্তরীণ নিয়োগ শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব মোহাম্মদ বারিউল করিম খান, প্রেষণ-২ শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব জেতী প্রু। 

অভিযোগকারীর দাবি, প্রশাসনের ভেতরে একটি গোষ্ঠী তাকে রক্ষায় আগেও তৎপর ছিল, এখনো আছে। এর মধ্যে রয়েছেন তৎকালীন একজন অতিরিক্ত সচিব, একাধিক যুগ্মসচিব ,সিনিয়র উপসচিব এবং ফয়জুলের কয়েকজন ব্যাচমেট।
 
এআর

Link copied!