ঢাকা : বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা একবিংশ শতাব্দীতেও গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে সংকুচিত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে সমালোচনামূলক ও স্বাধীন সাংবাদিকতা, সাহিত্য, শিল্প ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মত প্রকাশের ক্ষেত্রে। সাংবাদিক, লেখক, কার্টুনিস্ট, সম্পাদকসহ বিভিন্ন শ্রেণির মতপ্রকাশকারীকে নিয়মিতভাবে হয়রানি, মামলা, কারাবন্দি করা হচ্ছে; কেউ কেউ শারীরিক নির্যাতন ও হামলার শিকার হচ্ছেন, এমনকি প্রাণও হারাচ্ছেন। বিগত ফ্যাসিবাদ আমলে এই দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। যার মাধ্যমে সরকারের সমালোচনা বা সংবেদনশীল বিষয় তুলে ধরার অপরাধে কঠোর শাস্তির বিধান রেখে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রকে আরও সংকুচিত করা হয়েছিল। এই পরিস্থিতি শুধু ব্যক্তি স্বাধীনতাকেই হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে না, বরং গণতান্ত্রিক চর্চা ও স্বাধীন গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎকেও বিপর্যস্ত করছে।
ফ্যাসিবাদ-উত্তর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে লেখক, সাংবাদিক ও যোগাযোগমাধ্যমসহ তথ্যপ্রবাহের মাধ্যমগুলো চরম ঝুঁকির মুখে পড়েছে। যা স্বাধীনতার চেতনা ও জুলাই অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্যবস্তুর পরিপন্থী। দুঃখজনকভাবে, কিছু স্বার্থান্বেষী মহল ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষায় দমন-পীড়ন, হামলা, মব কালচার, এমনকি হত্যার মতো নৃশংসতা অব্যাহত রেখেছে, যা মুক্ত গণমাধ্যম ও নাগরিক নিরাপত্তার ভিত্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। এর ফলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে সংকুচিত হচ্ছে এবং জনগণের জানার অধিকারকে অবরুদ্ধ করা হচ্ছে।
গত ৭ আগস্ট সন্ধ্যা সাড়ে ৮টার দিকে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা ঈদগাহ মার্কেট সংলগ্ন এলাকায় ঘটল এক ভয়াবহ নৃশংসতা। দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ-এর গাজীপুর প্রতিনিধি মো. আসাদুজ্জামান তুহিনকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করল ৫- ৬ জন সশস্ত্র দুর্বৃত্ত। স্থানীয় চাঁদাবাজি ও ছিনতাইকারী চক্রের বিরুদ্ধে মোবাইলে লাইভ ভিডিও ধারণ করায় হামলাকারীদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। ধাওয়া খেয়ে আশ্রয়ের জন্য একটি দোকানে প্রবেশ করলেও সেখানেই এলোপাতাড়ি কোপের আঘাতে তার জীবন শেষ হয়ে যায়। তুহিনের মৃত্যুর ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। যা দেখার পর সাংবাদিক সমাজ ও সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তার বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামে। একটি পরিবার আজ শোকে মুহ্যমান। অকালে এক পিতা, স্বামী ও সহকর্মীকে হারানোর বেদনা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা রক্ত, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন পোশাক এবং আতঙ্কিত প্রত্যক্ষদর্শীদের নির্বাক দৃষ্টি- সব মিলিয়ে ঘটনাস্থল এক শিহরণ জাগানো দৃশ্য। এই নির্মম হামলার পর সাংবাদিকদের সহকর্মী ও স্থানীয় মানুষ গভীর ক্ষোভ ও শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন। এমন নৃশংসতার সাক্ষী হওয়া প্রত্যেকেই উপলব্ধি করছিলেন যে, সত্য বলা আর সত্য প্রকাশের জন্য জীবন দিতে হচ্ছে- যা কোনোভাবেই একটি সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। এটি শুধু এক ব্যক্তির ওপর আক্রমণ নয়, বরং পুরো সাংবাদিক সমাজের নিরাপত্তা ও বাকস্বাধীনতার ওপর এক ভয়াবহ আঘাত।
এর মাত্র একদিন আগে, ৬ আগস্ট বিকেলে গাজীপুরের সাহাপাড়া এলাকায় দৈনিক বাংলাদেশের আলো-র রিপোর্টার আনোয়ার হোসেন সৌরভ একই চাঁদাবাজ চক্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় নির্মম হামলার শিকার হন। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, অন্তত সাত-আট জন যুবক তাকে ঘিরে ইট ও লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে, মাথায় আঘাত করছে, পা থেঁতলে দিচ্ছে এবং রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় ফেলে রেখে চলে যাচ্ছে। তার কাছ থেকে দুইটি মোবাইল ফোন ও টাকা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। হামলার সময় পুলিশ উপস্থিত থাকলেও তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপ করেনি। যা জনমনে আরও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। পরিবারের অভিযোগ, এটি ছিল সুপরিকল্পিত হামলা। আর সাংবাদিক মহল বলছে, আনোয়ারের উপর এই নৃশংস হামলা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর সরাসরি আঘাত।
পরপর দুই সাংবাদিকের উপর এমন ভয়াবহ ও সংগঠিত হামলা গাজীপুরের সাংবাদিক সমাজে আতঙ্কের ঢেউ তুলেছে। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের গণমাধ্যম, পত্রিকার সম্পাদকীয় এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো একযোগে এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে এবং দ্রুততম সময়ে অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি তুলেছে। প্রশাসনের র্যাপিড রেসপন্স টিম থেকে শুরু করে মানবাধিকার সংগঠনগুলো পর্যন্ত এটিকে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর এক গুরুতর আঘাত হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এ শোক, ক্ষোভ ও হতাশার প্রেক্ষাপটে একটাই প্রত্যাশা- ন্যায়বিচার হোক দ্রুত, যাতে আর কোনো তুহিনকে সত্য বলার অপরাধে প্রাণ দিতে না হয়। আর যেন আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাতে না হয় কোনো আনোয়ারকে। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি) কমিশনার নাজমুল করিম খান জানান, এই হত্যাকান্ডে অনেকেই সম্পৃক্ত। ইতিমধ্যে সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অপরাধ বাড়ার আরেকটি কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, গাজীপুরকে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি বলা হয়ে থাকে। তাই দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্যও এখানে নানা অপকর্ম চালানো হচ্ছে। জিএমপি কমিশনারের প্রতি আসাদুজ্জামান তুহিন ও আনোয়ারের সহকর্মীরা দাবী করেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে অপরাধীদের গ্রেফতার করে কঠোর বিচার নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে সাংবাদিকদের জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
বিগত ফ্যাসিবাদের আমলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে নির্মম দমন-পীড়নের এক করুণ অধ্যায় হয়ে রয়েছে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান এবং দৈনিক সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদের উপর শারীরিক নির্যাতন ও মামলা, কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরের গুম ও অমানবিক নির্যাতন এবং লেখক মুশতাক আহমেদের রহস্যময় মৃত্যুর মতো ঘটনা। এমনকি সাংবাদিক সাগর-রুনির হত্যাকান্ডের রহস্য এখনও জনমনে প্রশ্ন হয়ে রয়েছে। এই সাহসী ব্যক্তিরা স্বাধীন চিন্তা ও সৎ সংবাদ পরিবেশনের জন্য বাধার মুখে পড়েন এবং তাঁদের ওপর রাজনৈতিক হামলা, হয়রানি ও প্রাণহানি ঘটে। তাদের প্রতি এই অত্যাচার শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং এটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি একটি বড় ধরনের আঘাত। যা দেশের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রগতিকে ব্যাহত করেছে। এমনকি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হয়ে উঠেছিল মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এক দমনের হাতিয়ার। এই আইনের অসংখ্য অস্পষ্ট ও কঠোর ধারায় সাংবাদিক, ব্লগার ও সাধারণ মানুষদের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী শাসনের নামে অবৈধ মামলা এবং হয়রানি বেড়ে যায়। সরকারের সমালোচনা, সত্য ঘটনা প্রকাশ বা ভিন্নমত প্রকাশ করাই হয়ে ওঠে অপরাধ। যা দেশের গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতার জন্য ভয়াবহ হুমকি হিসেবে প্রমাণিত হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার এবং বিচারব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে তথ্য ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয়ে দাঁড়ায়। যা মুক্ত সমাজ গঠনে এক মারাত্মক বাধা সৃষ্টি করেছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর তথ্যমতে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে ১৯৬ সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে ৬৬ জন মারধরের শিকার, সংবাদ প্রকাশের জেরে ৪৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা, ৩১ জন মব হামলার শিকার, বিএনপি ও তাদের অঙ্গসংগঠনের হামলায় আহত ১৭ জন, বিক্ষোভ কর্মসূচিতে আহত ১৩ জন এবং ৮ জন সাংবাদিক মৃত্যুর হুমকি পেয়েছেন। এসব ঘটনা সাংবাদিকদের জন্য একটি ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। যা সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচারে গুরুতর প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) জানায়, ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের দিনেই অন্তত ১৮ জন সাংবাদিক হামলা, হয়রানি ও বাধার সম্মুখীন হন। এই পরিসংখ্যান কেবল সংখ্যার হিসাব নয়, বরং গণমাধ্যমের উপর ক্রমবর্ধমান দমন-পীড়নের একটি স্পষ্ট প্রমাণ, যা গণতন্ত্র ও মুক্ত চিন্তার জন্য গভীর হুমকি।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা একটি গণতান্ত্রিক সমাজের অন্যতম মৌলিক ভিত্তি। যা নাগরিকদের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করে এবং ক্ষমতার জবাবদিহিতা বজায় রাখে। গণমাধ্যম যখন অবাধে কাজ করতে পারে, তখন মানবাধিকারের সুরক্ষা, দুর্নীতির উন্মোচন এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সহজ হয়। কিন্তু যখন সাংবাদিকদের উপর নিপীড়ন, সেন্সরশিপ বা ভীতি প্রদর্শনের সংস্কৃতি চালু হয়, তখন তা কেবল সংবাদপত্র ও টেলিভিশনকেই নয়, বরং সমগ্র গণতান্ত্রিক কাঠামোকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা মানে মানুষের কণ্ঠ ও অধিকার রক্ষা করা।
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।
আপনার মতামত লিখুন :