দাড়ির বিধান : ক্ষতি ও উপকারিতা

  • মুফতি উবায়দুল হক খান | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: মার্চ ১৬, ২০২১, ১২:১২ পিএম
দাড়ির বিধান : ক্ষতি ও উপকারিতা

ঢাকা : দাড়ি সব নবী-রাসুলের সুন্নত। ইসলামের সবচেয়ে সহজ ইবাদত। মহান আল্লাহ পুরুষদের মুখে তা দান করেছেন সৌন্দর্যস্বরূপ। পুরুষদের জন্য দাড়ি রাখা ওয়াজিব। এক মুষ্টির ভেতরে কাটা বা ছাঁটা হারাম ও কবিরা গুনাহ। আর একেবারে মুণ্ডিয়ে ফেলা আরো মারাত্মক হারাম। হাদিস শরিফে পুরুষদের দাড়ি রাখার ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং তা কাটা-ছাঁটা বা মুণ্ডানো সম্পর্কে কড়া হুঁশিয়ারি এসেছে। এ ব্যাপারে আরো একাধিক হাদিস সহিহ বুখারি ও  মুসলিমসহ বিভিন্ন হাদিসগ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। হজরত যায়েদ ইবনে আরকম (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে তার মোছ খাটো করে না, সে আমাদের

দলভুক্ত নয়। (সুনানুত তিরমিযি ও সুনানুন নাসায়ি)

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা মুশরিকদের বিপরীত করো। মোছ খাটো করো এবং দাড়ি লম্বা করো।’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম) উল্লেখ্য, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে পারস্য সাম্রাজ্যের মুশরিক সম্রাটের অনুসরণ ও তার নির্দেশে তাদের সরকারি লোকজন ও প্রজারা মোছ লম্বা রাখতো এবং দাড়ি মুণ্ডিয়ে ফেলতো। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা মোছ খাটো করো এবং দাড়ি লম্বা করো। আগুনপূজারী মুশরিকদের বিপরীত করো।’ (সহিহ মুসলিম শরিফ : ১/২২২) উপরিউক্ত হাদিসদ্বয়ে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মোছ ছোট করার এবং দাড়ি লম্বা রাখার নিদের্শ দিয়েছেন ‘ছিগায়ে আমর’ দ্বারা। আর আমর মূলত ওয়াজিবের জন্য ব্যবহূত হয়। সুতরাং, উক্ত হাদিসদ্বয় থেকে প্রতিয়মান হলো, দাড়ি লম্বা করা ওয়াজিব। আর ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়াজিব ছেড়ে দেওয়া হারাম। দাড়ি এক মুষ্টির চেয়ে ছোট করা হারাম এবং মোছ বড় করে রাখাও হারাম।

প্রসিদ্ধ চার মাজহাব দ্বারাও দাড়ি লম্বা রাখা ওয়াজিব প্রমাণিত। দাড়ি সম্পর্কে হানাফি মাজহাবের বক্তব্য হলো-দাড়ি এক মুষ্টি থেকে কম করে রাখা হারাম। এ ব্যাপারে  ইমামগণের ঐকমত্য রয়েছে। দাড়ি মুণ্ডিয়ে ফেলা, কিংবা এ পরিমাণ ছেঁটে ফেলা যার ফলে দাড়ি এক মুষ্টি থেকে কম হয়ে যায়, এ উভয় অবস্থাই হারাম। শাফেয়ি মাজহাবের বক্তব্য হলো-ইমাম শাফেয়ি (রাহ.) বলেন, দাড়ি কাটা হারাম। কুরতবী (রাহ.) বলেন, দাড়ি মুণ্ডানো, ছাঁটা বা উৎপাটন করা সবই নাজায়েয। মালেকি মাজহাবের মন্তব্য হলো-দাড়ি মুণ্ডানো নিষেধ এবং তার মধ্যকার পাকা চুল বেছে বের করে কেটে বা উপড়ে ফেলাও নিষেধ। হাম্বলি মাজহাবের মতামত হলো-দাড়ির কিছুই না কেটে তাকে বড় হতে দেওয়া জরুরি ও আবশ্যক। তা মুণ্ডিয়ে ফেলা হারাম।

উপরিউক্ত চার মাজহাবের ফাতাওয়া এবং পূর্বের আলোচনার দ্বারা বুঝা গেল- নিঃসন্দেহে দাড়ি বৃদ্ধি করা ওয়াজিব এবং মুণ্ডানো হারাম।

দাড়ি মুণ্ডানোর অপরাধের প্রতি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এত বেশি ঘৃণা ছিল, যখন পারস্য সম্রাটের পক্ষ হতে দাড়িবিহীন ও বড় বড় মোছধারী দুজন দূত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে উপস্থিত হলো, তখন তাদের প্রতি দৃষ্টি দিতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘৃণাবোধ করলেন এবং তাদেরকে বললেন, ‘তোমাদের ধ্বংস অনিবার্য, তোমাদের এই সুদৃশ্য চেহারা বিকৃত করার হুকুম কে দিল? তারা বলল, এটা আমাদের রব

কিসরার হুকুম। তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমার রব আমাদের দাড়ি লম্বা করা এবং মোছ ছোট করার হুকুম দিয়েছেন।’

দাড়ি কাটা বা মুণ্ডানোয় দুনিয়া ও আখেরাতে অনেক ক্ষতি রয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো- ১. দাড়ির ওপর বার বার ক্ষুর চালালে স্মানুসমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে চোখের জ্যোতি হ্রাস পেতে থাকে। ২. দাড়ি মুণ্ডানোর কারণে পুরুষত্ব শক্তি হ্রাস পেতে থাকে। জনৈক ডা. বলেন, লম্বা দাড়ি রোগজীবাণুকে গলা ও বক্ষ পর্যন্ত পৌঁছতে বাধা দেয়। ৩. দাড়ি মুণ্ডানো ব্যক্তি যে কোনো পাপ কাজে সহজে লিপ্ত হয়ে যেতে পারে। যা তাকে জাহান্নামের পথে পৌঁছিয়ে দেয়। ৪. দাড়ি মুণ্ডানো ব্যক্তির প্রতিমুহূর্তে কবিরা গুনাহ লেখা হতে থাকে। যার দরুন তাকে জাহান্নামে কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। ৫. দাড়ি মুণ্ডানোর দ্বারা চেহারার সৌন্দর্য বিনষ্ট হয়। ৬. কিয়ামতের ময়দানে দাড়ি কর্তনকারী ব্যক্তি সেই সুরত নিয়েই উপস্থিত হতে হবে। ফলে সে প্রথম অবস্থায়ই পাকড়াও হয়ে যাবে। এছাড়াও দাড়ি কর্তনে দুনিয়া ও আখিরাতে আরো বহুবিধ ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। পক্ষান্তরে যারা দাড়ি কাটা ও ছাঁটা থেকে বিরত থাকে তারা উপরিউল্লিখিত সমস্ত ক্ষতি থেকে বেঁচে থাকে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আমার সমস্ত উম্মত ক্ষমার যোগ্য, কিন্তু প্রকাশ্যে যারা গুনাহ করে তারা ক্ষমা পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না। দাড়ি মুণ্ডানো সে রকমই প্রকাশ্য গুনাহ।

দাড়ি এখন আর শুধু হিপস্টার আর ভবঘুরেদের ফ্যাশন নয়। যে কোনো ভদ্রলোকই এখন দাড়ির মাধ্যমে নিজেকে আবেদনময়ী, স্বাস্থ্যবান ও সুদর্শন করতে পারেন। গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন, দাড়ি ও গোঁফ রাখলে একজন পুরুষ অনেক স্বাস্থ্যগত সুবিধা পেয়ে থাকেন। ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন কুইন্সল্যান্ডের একদল গবেষকের এ গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে ‘রেডিয়েশান প্রোটেকশন ডোজিমেট্রি জার্নালে’। গবেষণায় দেখা যায়, দাড়ি সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি ঠেকায় ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত। এটা দ্রুত বুড়িয়ে যাওয়া থেকে পুরুষকে বাঁচায় এবং স্কিন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। আপনার অ্যাজমা আছে? ভয় কি! আপনার দাড়িতে আটকে যাবে ধুলো আর ক্ষতিকর বস্তু, যা আপনার সমস্যা বাড়িয়ে দিতে পারত। তাছাড়া এটা ঠাণ্ডা বাতাস ঠেকিয়ে আপনার চামড়ার আর্দ্রতা বজায় রাখে। নিয়মিত শেইভ করলে আপনার দাড়ির মূলে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ ঘটায় এবং ব্রনের সৃষ্টি করে। হ্যাঁ ভদ্র মহোদয়! আপনার রেজার কি ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছেন? এই গবেষণাটি পরিচালনা করার জন্য এই গবেষক দলটি দাড়িওয়ালা এবং শেভ করা বিভিন্ন গ্রুপের পুরুষকে পর্যবেক্ষণ করেন। অস্ট্রেলিয়ার এই গবেষক দলটি ওই পুরুষদের দিনের বেলায় উত্তপ্ত সূর্যের নিচে দাঁড় করিয়ে রাখেন একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত এবং কে কতটুকু রেডিয়েশান শোষণ করেছে এটা তুলনা করে দেখেন। তখনই দাড়ির এই উপকারের দিকটি ধরা পড়ে। দাড়ি কি শুধু আর ফ্যাশন আছে! এর উপকারিতা গবেষণায় প্রমাণিত!

হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চৌদ্দ শত বছর পূর্বেই দাড়ি লম্বা করা এবং মোছ না মুণ্ডিয়ে খাটো করার নির্দেশ দিয়েছেন। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, দশটি কাজ মানবপ্রকৃতির অন্তর্ভুক্ত। এক. মোছ খাটো করা, দুই. দাড়ি লম্বা করা, তিন. মিসওয়াক

করা, চার. পানি দ্বারা নাক পরিষ্কার করা, পাঁচ. নখ কাটা, ছয়. আঙ্গুলের ফাঁক হাত লাগিয়ে ধোয়া, সাত. বগলের কেশ উপড়ে ফেলা, আট. নাভির নিচের কেশ পরিষ্কার করা, নয়. পেশাব-পায়খানার পর পানি নেওয়া, দশ. কুলি করা। (সহিহ মুসলিম, সুনানুত তিরমিযি, সুনানু আবু দাউদ, সুনানুন নাসায়ি ও সুনানু ইবনে মাজাহ)

উপরিউক্ত হাদিসে বর্ণিত প্রতিটি কাজই মানুষের স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্যের জন্য উপকারী। যা বুঝার জন্য বৈজ্ঞানিকদের গবেষণার আশ্রয় নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। যে কেউ সুস্থ মস্তিষ্কে তা নিয়ে কিছু সময় চিন্তা-ভাবনা করলেই যথেষ্ট। যাদের মোছ লম্বা, তাদের চুমুতে স্ত্রী ও শিশুরা ব্যথা-বিরক্তি অনুভব করে। যাদের বগলের কেশ লম্বা হয়, তাদের বগল অধিক ঘামে এবং তা থেকে অধিক দুর্গন্ধ বের হয়। যাদের নাভীর নিচের কেশ লম্বা থাকে, তাদের চুলকানি রোগ হয়। যাদের নখ লম্বা থাকে, তাদের নখে ময়লা ও জীবাণু আশ্রয় গ্রহণ করে এবং খাওয়ার সময় তা পেটে প্রবেশ করে। যারা দাঁত পরিষ্কার করে না, তাদের দাঁত পোকে খায় এবং আস্তে আস্তে সব দাঁত পড়ে যায়। যারা পানি দিয়ে নাক পরিষ্কার করে না, তাদের নাকে ধুলো-বালি জমে গিয়ে জীবাণু সৃষ্টি হয়। যারা কুলি করে না, তাদের মুখের ভেতর জমে থাকা খাদ্যের কণা দুর্গন্ধের সৃষ্টি করে। যারা আঙ্গুলের ফাঁক হাত লাগিয়ে পরিষ্কার করে না, তাদের আঙ্গুলের ফাঁকে ময়লা জমে থেকে ত্বকের রঙ পরিবর্তন হয়ে যায়। অন্যদিকে যারা পেশাব-পায়খানার পর পানি নেয় না, তাদের পেশাব-পায়খানার দ্বারে জীবাণু সৃষ্টি হয়ে চুলকানি রোগের সৃষ্টি করে।

লেখক : মুহাদ্দিস ও সহকারী শিক্ষাসচিব, জামিআতুস সুফফাহ আল ইসলামিয়া গাজীপুর

 

Link copied!