পরিবেশ সুরক্ষায় ইসলামের পরিচর্যা

  • মো. মুরাদ হোসেন | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: এপ্রিল ২, ২০২১, ০২:০৮ পিএম
পরিবেশ সুরক্ষায় ইসলামের পরিচর্যা

ঢাকা : আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির বসবাসের জন্য প্রাকৃতিক ভারসাম্যতা বজায় রেখে পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের প্রকৃতি ও সত্তাগত চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখেই পৃথিবীর প্রত্যেকটি জিনিসকে সৃষ্টি করা হয়েছে, যা প্রতিনিয়তই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানুষের কল্যাণ এবং সেবায় ব্যবহূত হচ্ছে। পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্টির উপাদানের নির্যাস দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই সৃষ্টিকুলের মাঝে যদি ভারসাম্যতা বজায় রাখতে হয় তাহলে মানুষকেই তার সঠিক পরিচর্যার দায়িত্ব নিতে হবে। কোরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী মানুষ এই পৃথিবীর উত্তরাধিকারী এবং দায়িত্বশীল। একজন দায়িত্বশীলের যেমন ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব থাকে তেমনই যাদের ওপর তাকে কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে, তাদের সবার (প্রাণিকুলের) প্রতি কর্তব্যও রয়েছে। মানুষকে পৃথিবীর দায়িত্বশীল প্রাণী হিসেবে তৈরি করে এমন একটি ব্যবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে মানুষ ও প্রাণীর মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকে। অর্থাৎ মানুষ প্রকৃতি ও প্রাণিকুলের সাথে বিবেক সম্মত আচরণ করবে তাহলেই পরিবেশের স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আর মহান আল্লাহ আকাশকে করেছেন সমুন্নত এবং স্থাপন করেছেন ভারসাম্য’ (সুরা রহমান-৭)। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘এই পৃথিবী সুন্দর ও সবুজ এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে এখানে পাঠিয়েছেন প্রতিনিধিরুপে, যাতে তোমরা কেমন কাজ করো তা তিনি দেখতে পারেন’ (সহিহ্ মুসলিম)। মানুষের এই প্রতিনিধিমূলক দায়িত্বের সঙ্গে রয়েছে পরীক্ষাও। অর্থাৎ দুনিয়ায় যাবতীয় কাজকর্ম সুষ্ঠু, সঠিক ও প্রশংসনীয় উপায়ে হয়েছে কিনা তা বিচার দিবসে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে হিসাব করে প্রতিদান দেওয়া হবে।

সাধারণভাবে ইসলাম সমস্ত সৃষ্টিজগৎকে আল্লাহ অনুগ্রহশীল পরিবারের সদস্য হিসেবে অবহিত করেছে। তাই অপ্রয়োজনে গাছকাটা, পানি অপচয় করা, অকারণে পশুপাখি হত্যা করা, এমনকি গাছের পাতা ছিঁড়তেও ইসলাম কঠোর ভাষায় নিষেধ করে। বরং বেশি বেশি গাছ লাগানোর প্রতি উৎসাহ দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, কোনো মুসলমান যদি একটি বৃক্ষের চারা রোপণ করে অথবা ক্ষেতখামার করে। অতঃপর মানুষ, পাখি বা কোনো জন্তু তা ভক্ষণ করে, তাহলে তার জন্য রয়েছে সদকার সওয়াব।’ (সহিহ বুখারি) অন্যত্র রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি বিনা প্রয়োজনে গাছ কাটবে, আল্লাহ তার মাথা আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করবেন।’ (আবু দাউদ : ৫২৪১)

মহান রবের অনুগ্রহশীল সৃষ্টিকে উপেক্ষা করে যেখানে-সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলে রাখা, প্রয়োজন ব্যতীত গাছ কাটা, আবাদযোগ্য জমি নষ্ট করার ফলে জলবায়ু ও পরিবেশের ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে মানুষ চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রীয় নিয়ম না মেনে গড়ে উঠছে বহু কলকারখানা যার দূষিত ধোঁয়া ও বিষাক্ত বর্জ্যগুলো প্রতিনিয়ত প্রকৃতির অমূল্য সম্পদ বায়ু ও নদী-নালাকে মানুষের ব্যবহারের অনুপযোগী করে তুলছে। প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ করার বৈধতা ইসলাম রাখেনি। আল্লাহ বলেন : ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার পর তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না। তাঁকে ভয় ও আশার সহিত ডাকবে। নিশ্চয় আল্লাহর অনুগ্রহ সৎকর্মপরায়ণদের নিকটবর্তী’ (সুরা-৭ আরাফ, আয়াত: ৫৬)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে কাসির (র.) বলেন, যেসব কর্মকাণ্ড পৃথিবীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তা করতে আল্লাহ তায়ালা নিষেধ করেছেন। কেননা, যখন কাজকর্ম শান্ত পরিবেশে চলতে থাকে, তখন যদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, তবে তা হবে বান্দাদের জন্য বেশি ক্ষতিকর। অর্থাৎ যদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করো তাহলে জলে, স্থলে, শূন্যে তোমাদের অন্যায় কর্মকাণ্ডের ফলে বিপর্যয় নেমে আসবে।

ইসলামে পবিত্র পানি ছাড়া পবিত্রতা অর্জন সম্ভব নয়। এই হেকমতীয় অনিবার্যতা পানি দূষণ রোধ করে বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা বজায় রাখার পাশাপাশি সুরক্ষিত পরিবেশ গড়তে সহয়তা করে। পানির ওপর জীবন-জগতের সীমাহীন নির্ভরতার কারণেই ইসলাম পানিকে বৈশ্বিক সম্পদ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তা মানবজাতিকে রক্ষা করতে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মানুষ তিনটি বিষয়ে পরস্পরের অংশীদার। পানি, ঘাস (বাণিজ্যিক ও মালিকানাধীন ভূমিতে নয় এমন) ও আগুন।’ (ইবনে মাজাহ) আল্লাহ তায়ালাও কোরআনুল কারীমে বিশুদ্ধ পানির গুরুত্ব তুলে ধরে বলেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা যে পানি পান করো, তা সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কি? তোমরা তা মেঘ থেকে নামিয়ে আনো, না আমি বর্ষণ করি? আমি চাইলে তা নোনা করে দিতে পারি। এরপরও কেন তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো না?’ (সুরা ওয়াকিয়াহ, আয়াত : ৬৮-৭০)

শব্দদূষণ, পরিবেশ দূষণ, আবহাওয়া ও জলবায়ু দূষণ হয় এমন কোনো স্বেচ্ছাচারী কাজ ইসলামে হালাল রাখা হয়নি। ইসলাম মানুষের সুস্থভাবে উন্নত জীবনযাপনের ব্যাপারে পৃথিবীতে বসবাসের কথা বলে অর্থাৎ বর্তমান নগরায়ণ ব্যবস্থা কিন্তু তা পরিবেশ ও প্রাকৃতিক ব্যবস্থার জন্য ক্ষতিকর এমন কোনো কাজের মাধ্যমে করা যাবে না। তাই পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন জলে-স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে তাদের কোনো কোনো কর্মের শাস্তি তিনি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে’ (সুরা আর-রুম, আয়াত : ৪১)। আমাদের জীবন ধারণের এসব উপায়-উপকরণগুলো আল্লাহর দেওয়া নিয়ামত। এ নিয়ামতের সঠিক ব্যবহার ও পরিচর্যার পরিবর্তে প্রয়োজন ব্যতীত তার কোনো কিছু নষ্ট করলে বা অন্যায়ভাবে ধ্বংস করলে আল্লাহর নির্ধারিত পরিমাপের ভারসাম্যতা বিনষ্ট হয়ে তা মানুষের জন্যই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। পরিবেশের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছেন। ক. জগতের সব সৃষ্টবস্তুই আল্লাহর বলে উপলব্ধি করা। খ. যে কোনো কাজ করার ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচারকে সামনে রেখে কাজ সম্পূর্ণ করা। গ. সার্বিক অপচয় রোধ করে প্রাকৃতিক ও অন্য যেকোনো ধরনের সম্পদের সঠিক ব্যবহার করা। মানবতার নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পথে সত্যিকার অর্থে চলতে গেলে পৃথিবীর সকল সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে। কেননা আমরা তাদেরকে ব্যবহার করে আমাদের জীবনধারণের প্রয়োজনগুলো পূরণ করে থাকি।

পৃথিবীতে কীভাবে বসবাস করলে এই প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যতা বজায় থাকবে এবং মানবজীবনের বসবাস সুন্দর হবে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতিমালা দিয়েছে ইসলাম। কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘আমি পৃথিবীকে বিস্তৃত করেছি এবং এতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং পৃথিবীর প্রত্যেকটি বস্তুকে সুনির্দিষ্ট পরিমাপে উৎপন্ন করেছি। আর এতে তোমাদের জন্য জীবিকার ব্যবস্থাও রয়েছে এবং তোমরা যাদের অন্যদাতা নও তাদের জন্যও (অর্থাৎ প্রাণিকুলের জন্যও জীবিকার ব্যবস্থা করেছি)। প্রতিটি বস্তুর ভান্ডার রয়েছে আমার কাছে আর আমি তা সুষম পরিমাপে সরবরাহ করে থাকি। আমি বায়ুকে উর্বরকারীরূপে প্রেরণ করি অতঃপর আকাশ থেকে বৃষ্টিবর্ষণ করি এবং আমি তা তোমাদেরকে পান করাই। বস্তুত এসবের ভান্ডার তোমাদের কাছে নেই’ (সুরা হিজর-আয়াত ১৯-২২)।

পরিবেশের সুরক্ষার জন্য ইসলামী মূলনীতির নির্দেশনা ধরে আমাদের কর্মপন্থা নির্ধারণ করলে তবেই আগামী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ একটি বিশ্ব রেখে যেতে পারব। না হলে কিছু লোভী মানুষের বেপরোয়া ও কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজের জন্যে মানবজাতিকে চরম মূল্য দিতে হবে। এসব স্বার্থান্বেষী মানসিকতার মানুষ প্রকৃতি ব্যবস্থাকে প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে দিচ্ছে। যার ফলে বনগুলো হারিয়ে যাচ্ছে, সুন্দর পাখিগুলো বিলুপ্ত হচ্ছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় আমরা জানতে পেরেছি, মাত্রাতিরিক্ত কার্বণ নিঃসরণের কারণে বিশ্বজুড়ে মানুষ ও প্রাণীর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সে জন্যে গবেষকরা মানুষের অরাজকতা, অসচেতনতা ও লোভকেই সর্বাংশে দায়ী করছেন। মানুষের সর্বগ্রাসী লোভের হাত থেকে অরুণের সম্পদকে রক্ষা করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ মহান আল্লাহ মানুষের প্রাণের সজীবতা ঠিক রাখার জন্যে চারদিকে প্রকৃতির নানা আয়োজন করে রেখেছেন। কিন্তু মানুষের অধিক লোভের কারণে অরুণ্যকে ধ্বংস করে নিজেই নিজের ক্ষতি ডেকে আনছে। বায়ুকে নির্মল করার ভার যে গাছের ওপর, যার পাতা ঝরে গিয়ে ভূমিকে উর্বরতা দেয়, তাকেই আমরা প্রয়োজন ব্যতীত নির্মূল করছি। প্রকৃতির সবকিছু মহান রবের পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে নিয়ামত। সুতরাং তার রক্ষণাবেক্ষণ করা একজন মুমিনের ঈমানি দায়িত্ব।

লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

 

 

Link copied!