ঢাকা : ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির রাজনীতির মত ও পথ আলাদা। রাজনৈতিক কৌশলেও ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। দল দুটির জন্মও ভিন্ন সময়ে, ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দুই দলকেই একবিন্দুতে দেখা যাচ্ছে।
কারণ আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার এবং স্বজনদের প্রার্থী না করার জন্য কঠোরভাবে নির্দেশনা দিয়েছিল। কিন্তু কেউ কথা শোনেননি।
অন্যদিকে বিএনপি সংসদ নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় উপজেলা ভোট বর্জনের সিদ্ধান্ত নিলেও দলের মাঠপর্যায়ের নেতাদের অনেকেই নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। দুই দলের মধ্যে তফাত হলো আওয়ামী লীগ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অন্যদিকে বিএনপি বহিষ্কার করছে।
চলমান উপজেলা নির্বাচন ঘিরে দল দুটির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নানা প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে। নির্দেশনা না মানায় দল দুটির অভ্যন্তরে নানা অস্থিরতাও তৈরি হয়েছে। এ ঘটনায় মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের ওপর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে রাজনৈতিক মহলে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নীতিনির্ধারকরা অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে নানা অজুহাত তুলছেন।
চলমান উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দেখা যায়, সরকারি দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা যেমন কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন, তেমনি বিএনপিতেও বিশৃঙ্খল রাজনীতির চিত্র ফুটে উঠেছে।
এ বিষয়ে দুই দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে দুই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা পৃথক যুক্তি তুলে ধরেছেন।
আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপির সঙ্গে তাদের দলকে তুলনা করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের দাবি, গত ১৫ বছরে ক্ষমতাকেন্দ্রিক একটি শ্রেণি আওয়ামী লীগে বেশ পোক্ত অবস্থান নিয়ে রাজনীতি করছে। ক্ষমতাসীন দলের বেশ কিছু এমপি দলের চেয়ে ব্যক্তি রাজনীতিকে প্রাধান্য দিয়ে চলেছে।
যে অংশটি গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগে প্রবেশ করেছে, ব্যক্তি রাজনীতিকে প্রাধান্য দিয়েছে, তারাই দলের কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনেক ক্ষেত্রে মানছে না। আদর্শিক ও পোড়খাওয়া নেতাকর্মীরা নির্দেশনা মেনে নির্বাচন থেকে সরে এসেছেন, তেমন উদাহরণও রয়েছে। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এসব নেতা আরও দাবি করেন, বড় রাজনৈতিক দলে অল্পস্বল্প কিছু অনিয়ম থাকে।
বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতা দাবি করেছেন, সরকারের বিভিন্ন অংশ বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীদের ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য করেছে। কেউ কেউ প্রলোভনে পড়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন। জেল-জুলুমের ভয়ে মুষ্টিমেয় অংশ প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন। নিজ নিজ এলাকায় শান্তিতে থাকতে বিএনপির তৃণমূলের মুষ্টিমেয় কিছু নেতাকর্মী কেন্দ্রীয় নির্দেশনা শোনেননি। তবে বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের অনেক নেতা আবার কেন্দ্রের সমন্বয়হীনতাকেও দুষছেন এর জন্য।
বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের এসব নেতা বলেন, উপজেলা নির্বাচনের পরের ধাপগুলোতে বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীর অংশগ্রহণ অনেক কমে যাবে।
প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে এমপি ও মন্ত্রীদের বলয়ের বাইরে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগের ত্যাগী কোনো নেতা জিতে আসতে পারেননি। দলীয় নেতাকর্মী যারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, নির্বাচনের পর অনেক জায়গায় তারা অত্যাচার-নির্যাতনসহ মারামারি, হানাহানির শিকার হয়েছেন। নানা বিশৃঙ্খল রাজনীতি চোখে পড়েছে প্রথম ধাপের নির্বাচনে।
একই চিত্র বিএনপিতেও দেখা গেছে। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করেই বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতারা নির্বাচনে গেছেন। অর্থাৎ দেড় দশক ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা মাঠপর্যায়ের এ নেতাদের দলীয় সিদ্ধান্ত মানাতে ব্যর্থ হয়েছেন। ক্ষমতার বাইরে থাকায় কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ থাকার কথা থাকলেও সেটা হয়নি।
ফলে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মী কেউ উপজেলা নির্বাচন করলে দল থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা করা হয়। তাতেও কর্ণপাত করেনি বিএনপির তৃণমূলের একটি অংশ। তারা নির্বাচন করেছেন, যথারীতি পরাজিতও হয়েছেন।
উপজেলা নির্বাচনের তৃতীয় ধাপের প্রার্থিতা ইতিমধ্যে চূড়ান্ত হয়েছে। তিন ধাপের চিত্র বলছে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত যতটা কঠোর ছিল, তার চেয়ে বেশি অনড় অবস্থান নেন আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রী ও তাদের অনুসারী এবং বিএনপির মাঠপর্যায়ের নির্বাচনমুখী নেতারা।
দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে মাঠপর্যায়ের নেতাদের নির্বাচনের যাওয়ার মধ্য দিয়ে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল বা নেতৃত্ব সংকট ফুটে উঠল কি না, সে আলোচনাও আছে। যদিও বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব তা মানতে নারাজ।
তারা বলছেন, বিএনপির লাখ লাখ নেতাকর্মীর তুলনায় উপজেলার ভোটের অংশ নেওয়ার সংখ্যা খুবই সামান্য। আর ভোটের থাকা তৃণমূল নেতারা বলছেন, কেন্দ্রের সমন্বয়হীনতাই বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী। সঠিক সময়ে সঠিক নির্দেশনা পেলে প্রার্থী সংখ্যা সিকিভাগও হতো না।
পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। বিএনপি ক্ষমতার বাইরে থেকেও তৃণমূল নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, ‘বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে আওয়ামী লীগকে মেলানো যাবে না।’
তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় নির্দেশনা একেবারেই মানছে না সেটাও ঠিক নয়। তবে নির্দেশনা না মানলে তাৎক্ষণিক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে যেকোনো বিষয়ে শতভাগ সফল হওয়া যাবে। নির্দেশনা না মানা মানে তৃণমূলে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নেই সেটাও বলা যাবে না।
টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান ফারুকও মনে করেন, ত্বরিত শাস্তি নিশ্চিত করা হলে সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নও ঘটবে।
এদিকে চলমান উপজেলা নির্বাচন ঘিরে যতই দিন গড়াচ্ছে, বিএনপির তৃণমূলে বিশৃঙ্খলা ততই প্রকট হচ্ছে।
কেন্দ্রের নির্দেশনা অগ্রাহ্য করে দলটির মাঠপর্যায়ের প্রায় দুই শতাধিক নেতাকর্মী ইতিমধ্যেই নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন, যাদের প্রায় ১৮৬ জনকে এরই মধ্যে তিন দফায় বহিষ্কার করা হয়েছে। বহিষ্কার করার আগে সব নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়ে, এমনকি সরাসরি কথা বলেও থামানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো কাজ হয়নি।
উল্টো প্রথম দফায় ৭৩, দ্বিতীয় দফায় ৬২ এবং তৃতীয় দফায় ২৯ মে হতে যাওয়া নির্বাচনের আগে ৫১ জন নির্বাচনী মাঠ দাপিয়ে বেড়ানোর দায়ে বহিষ্কার হয়েছেন। গতকাল বুধবারও আরও ৪৫ জনকে কারণ দশানো নোটিস পাঠিয়ে আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছে।
বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম আজাদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যাদের বহিষ্কার করা হয়েছে, তারা ভোটে জিতলে অনেকেই নির্দেশ অমান্য করে নির্বাচনে যেতে উৎসাহিত হতো। এতে দলের চেইন অব কমান্ড ধরে রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াত। তাই দল এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।’
সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার পরও প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত রাখা যাচ্ছে না কেন, এ প্রশ্নের জবাবে প্রার্থী হওয়া তৃণমূলের একাধিক নেতা বলছেন, এর জন্য মূলত কেন্দ্রের সমন্বয়হীনতাই দায়ী।
নাম প্রকাশ না করে অন্তত তিনজন তৃণমূল নেতা যারা বিভিন্ন পদে প্রার্থী হয়েছেন তারা বলছেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে এক ধরনের নির্দেশ দিচ্ছেন। আবার সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ দপ্তর থেকে সেই নির্দেশনা দিচ্ছেন এক রকমভাবে।
দেখা যাচ্ছে, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নির্দেশনায় আরেক রকম তথ্য মিলছে। তাহলে তৃণমূল কোনটা গ্রহণ করবে? উপজেলা নির্বাচনের ক্ষেত্রে এমনটাই লক্ষ করা গেছে।
তারা আরও বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের পরপরই বিএনপির কেন্দ্র থেকে যদি ঘোষণা দেওয়া হতো, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা যাবে না, তাহলে এ ভোটে বর্তমানের সিকিভাগও নেতাই প্রার্থী হতো না। হয়তো ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের মতো কয়েকজন নেতা সরকার বা এজেন্সির প্ররোচনায় ভোটের মাঠে থাকতেন।
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শেখ শাহিনুর রহমান ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে।
তৃণমূলের এই নেতা বলেন, ‘প্রার্থী হওয়া যাবে না দল আগে কেন সিদ্ধান্ত দেয়নি? বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করে নির্বাচন করছি। দলও বহিষ্কার করেছে। কেন্দ্রের সমন্বয়হীনতার জন্য সারা দেশে উপজেলা নিয়ে তৃণমূলের নেতাদের এ অবস্থা। কেন্দ্রের ব্যর্থতা এখন আমাদের বয়ে বেড়াতে হবে।’
খুলনার দীঘলিয়া উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন মো. এনামুল হাচান মাসুম। তিন সেনহাটি ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক।
মাসুম বলেন, ‘দল যে এত কঠোর হবে সেটা তো আমাদের আগে জানায়নি। দল যখন সিদ্ধান্ত দিয়েছে তখন আমরা প্রচার-প্রচারণায়। জনগণও আওয়ামী লীগকে গ্রহণ করছে না। এই মুহূর্তে পেছনে ফেরার সুযোগ ছিল না বলেই ভোটের মাঠে রয়ে গেছি।’
দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে ভোটে থাকার কয়েকটি কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে প্রার্থী হওয়া তৃণমূল নেতারা বলছেন, এবার উপজেলা নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হচ্ছে না। আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাও স্বতন্ত্র, তারাও স্বতন্ত্র। রাজনীতি হচ্ছে জনগণের জন্য আর জনগণের জন্য কাজ করতে ভোটে অংশগ্রহণ ছাড়া বিকল্প নেই।
আবার ভোটে অনড় অধিকাংশই বিএনপির সাবেক নেতা। তারা বলছেন, দলীয় পদ না থাকায় তাদের নির্বাচনে অংশ নিতে কোনো বাধা নেই।
কেন্দ্রের নির্দেশনা অমান্য করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার মতো ঘটনা ঘটছে কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘কিছু ঘটনা ঘটছে, কিন্তু বিএনপির লাখ লাখ নেতাকর্মীর তুলনায় তাদের সংখ্যা খুবই সামান্য।’ সূত্র : দেশ রূপান্তর
এমটিআই
আপনার মতামত লিখুন :