ঢাকা: ক্রিকেটের রঙ চড়ানোর সবচেয়ে বড় বড় বিতর্কগুলো খুঁজতে গেলে সম্ভবত অস্ট্রেলিয়ার সাথে ভারতের বিতর্কিত ঘটনাগুলোই আসবে সবার সামনে।
ক্রিকেট কখনও মাঠ থেকে চলে যায় মাঠের বাইরে; তৈরি হয় নানা রেষারেষির, বিবাদের কেচ্ছা। সেরকম কিছু ঘটনা পড়তে চাইলে মনোযোগ দিন তাহলে...
১৯৮১ সালের এক ম্যাচে সুনীল গাভাস্কার তার ওপেনিং পার্টনার চেতন চৌহানকে নিয়ে মাঠ থেকে বেরিয়ে গেছিলেন।সেই ম্যাচটাতে তিনি ছিলেন অধিনায়ক। ম্যাচের শুরুতেই ডেনিস লিলির এক আবেদনে আম্পায়ার এলবিডব্লু দিয়ে দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে গাভাস্কার মাঠ ছেড়ে চলে যান। ঘটনার রঙ আরো চড়ে যায় যখন গাভাস্কার বলে বসেন অস্ট্রেলিয়া ঘরের মাঠে ১৩ জন নিয়ে খেলে।
অবশ্য গাভাস্কার পরে নিজের এ ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, তিনি আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে মাঠ থেকে চলে যাননি। তিনি গেছিলেন লিলি তাকে ব্যাক্তিগত আক্রমণ করায়।
অস্ট্রেলিয়া-ভারত ক্রিকেট ইতিহাসের সবচাইতে বড় বিতর্কটা মনে হয় এই ম্যাচটাতেই হয়েছিল। এই বিতর্ক অবশ্য কোন খেলোয়াড় তৈরি করেননি, করেছিলেন আম্পায়ার ড্যারেল হাইপার। গ্লেন ম্যাকগ্রার করা প্রথম বলটা লাগে শচীনের কাঁধে; ড্যারিল হাইপার তাতেই শচীনকে লেগ বিফোর দিয়ে দেন।
এই লেগ বিফোর এতটাই ‘পরিষ্কার’ ছিল যে সাদা চোখেই বোঝা যাচ্ছিল, শচীন আউট হননি। এটা নিয়ে তখনই সাবেক খেলোয়াড় থেকে সবাই ফুঁসে ওঠেন। তবে ১৯৯৯ সালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম না থাকায় এতটা বারুদ জ্বলে ওঠেনি। থাকলে কি হত ভাবা যায়!
২০০০-২০০১ এর সেই টেস্টটাতে আম্পায়ার ছিলেন ভেঙ্কট রাঘবন। খেলা চলছিল ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে।
খেলা চলার সময় রাহুল দ্রাবিড়ের ব্যাটের কোণায় লেগে ক্যাচ ওঠে, ডাইভ দিয়ে সেই ক্যাচ তুলে নেন মাইকেল স্লেটার। ক্যাচটা নিয়ে সন্দেহ হওয়ায়, টিভি রিপ্লে দেখে আম্পায়ার সিদ্ধান্ত দেন নট-আউট। আর এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন স্লেটার। তিনি রাহুল দ্রাবিড়কে গালি দিয়ে বসেন।
এতটুকুতেই থেমে গেলে চলত, কিন্তু তিনি সোজা আম্পায়ারের কাছে চলে যান তাঁর সামনে আঙুল নাচিয়ে শাসাতে থাকেন। মাইকেল স্লেটারকে আইসিসি পরে জরিমানা করে, কিন্তু এখনও দিনটি স্মরণীয় হয়ে আছে স্লেটারের অখেলোয়াড়সুলভ আচরণের জন্যে।
অস্ট্রেলিয়া-ভারতের বিতর্কে সৌরভের নামটা না থাকলে তালিকাটা সম্পূর্ণ হয়না। ২০০১ এর দিকে এক সিরিজে সৌরভ গাঙ্গুলি টসের সময় মাইকেল ওয়াহকে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় রাখেন। এ ঘটনা মাইকেল ওয়াহকে যারপরনাই অবাক করেছিল। তিনি তার আত্মজীবনী ‘আউট অফ মাই কমফোর্ট জোন’-এ লিখেছেন, ‘সেই সিরিজটাতে সৌরভ আরো কয়েকবার টসে দেরি করে এসেছিলেন।’ টসে গিয়ে এভাবে বসে থাকতে তার একটু বিরক্তই লেগেছে। সৌরভ অবশ্য পরে বলেছেন এটা আহামরি কোন ঘটনা নয়। ওয়াহ আর তার দলের সদস্যরা একটু ধৈর্য্যও ধরতে পারেননা।
২০০৮ সালের সিডনি টেস্টে হরভজন সিং এর বিরুদ্ধে বর্ণবাদের অভিযোগ ওঠে। এন্ড্রু সাইমন্ডস অভিযোগ করেন, হরভজন তার মুখায়বকে বানর বলেছে। এই ঘটনা মাঠেই উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, আর তা এতটাই ছিল যে পরিস্থিতি ঠান্ডা করতে আম্পায়ারকে এগিয়ে আসতে হয়। এরপর এই ঘটনা আইসিসি অব্দি গড়ালে ম্যাচ রেফারি মাইক প্রোক্টার হরভজনকে তিন টেস্টের জন্যে নিষেধাজ্ঞা দেয়। তবে, এরপরই হরভজন পাশে পায় বিসিসিআইকে।
বিসিসিআই দাবি করে, হরভজন নির্দোষ। আর তাকে অন্যায়ভাবে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। এই শাস্তি বদল না হলে সফর বাতিলেরও হুমকি দেয় ভারত। পরে যা হয়, হরভজনের নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেওয়া হয়। এই ঘটনা এখনও ক্রিকেটে ‘মাঙ্কিগেট স্ক্যান্ডাল’ নামে পরিচিত।
ভারত-অস্ট্রেলিয়ার বৈরিতা এক অনন্য মাত্রা পায় সেই টেস্টতে। ম্যাচটাতে এন্ড্রু সাইমন্ডস করেন ১৬২ রান, তবে এই রান করার পথে আম্পায়ার স্টিভ বাকনর মোট তিনবার সাইমন্ডসের নিশ্চিত তিনবার আউটকে নট-আউট ঘোষণা করেন। এটুকুতেই থেমে গেলে হত, কিন্তু অপর আম্পায়ার বেনসনের বিপক্ষেও মাঠে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ ওঠে।
যেমন, ভারতের ব্যাটিং এর সময় দ্রাবিড়কে কট-বিহাইন্ড দেওয়া হয়, যেখানে দ্রাবিড়ের ব্যাট ছিল প্যাডেরই পেছনে। এরপর মাইকেল ক্লার্কের হাতে সৌরভ তালুবন্দী হলে, কেউই নিশ্চিত ছিল না এটা আউট কিনা । যেখানে সেই সময় টিভি আম্পায়ারের সাহায্য নেওয়া যেত, সেখানে বেনসন পন্টিং এর মুখের কথাতে সৌরভকে আউট ঘোষণা করেন। এরপর ম্যাচশেষে বাকনরকে এই সিরিজ থেকে আম্পায়ার হিসেবে বরখাস্ত করা হয় । তাও সিডনীর ঐ টেস্টটা এক রকম বৈরিতাই তৈরি করেছিল দুই দলের মধ্যে।
ঘটনাটা ২০০৮-২০০৯ এর বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফির। সেই টেস্টটাতে গৌতম গম্ভীর ডাবল সেঞ্চুরি করেন। এছাড়াও টেস্টটা মনে রাখার আরেকটি উপলক্ষ্য হল এটা ছিল অনীল কুম্বলের শেষ ম্যাচ। তবে, আরো একটা ঘটনা সেই ম্যাচটাতে ঘটে।
ম্যাচের এক পর্যায়ে, দৌড়ে রান নেওয়ার সময় বোলার শেন ওয়াটসন গৌতম গম্ভীরকে মুষ্টি দেখিয়ে ঘুষির আভাস দেন। গৌতমও ছেড়ে কথা বলার পাত্র নন, তিনি দ্বিতীয় রান নেওয়ার সময় ওয়াটসনকে কনুই নিয়ে খোঁচা মারেন। এই ঘটনা তখন বেশ উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল। ম্যাচ শেষ হলে ম্যাচ রেফারি ক্রিস ব্রড গৌতম গম্ভীরকে এক ম্যাচের নিষেধাজ্ঞা দেন আর ওয়াটসনকে ম্যাচ ফির ১০% জরিমানা করেন।
২০১৬-২০১৭ এর সেই টেস্ট শুরুর আগে ভারত ছিল টেস্টের এক নম্বর দল। সুতরাং, টেস্ট সিরিজে জয় ছাপিয়েও ভারত হোয়াইট ওয়াশের স্বপ্ন দেখছিল। কিন্তু দেখা গেল, প্রথম টেস্ট জিতে নিয়েছেন স্টিভ স্মিথের অস্ট্রেলিয়া। শুধু তাই নয়, দ্বিতীয় টেস্টেও প্রথম তিন দিন ছিল অস্ট্রেলিয়ার দাপটে।
সেই টেস্টেই ঘটে এক আশ্চর্যজনক ঘটনা। স্মিথের এলবিডব্লুর সিদ্ধান্তে স্মিথ রিভিউ নেবেন নাকি নেবেন না এমন দ্বিধায় ড্রেসিং রুমের দিকে ফিরে সহায়তা চাইতে থাকেন। বিরাট কোহলি তখন স্মিথের দিকে এগিয়ে যান আর বলেন, এমনটা ক্রিকেটের নিয়মবহির্ভূত। এরপর অবশ্য আম্পায়ার নাইজেল লংও এগিয়ে এসে স্মিথকে একই সাবধানবাণী শোনান। তবে, নাইজেল লং আসার আগে কোহলি যথেষ্ট আক্রমণাত্মক ছিলেন।
এশিয়া আর ওশেনিয়া দুই মহাদেশের কাছে ক্রিকেট আলাদা আলাদা রঙ হিসেবে আবির্ভূত হয়। তাও দিনশেষে ব্যাট বল হাতে নামা এই দুই মহাদেশের তারকা দুই ক্রিকেট দেশের খেলোয়াড়েও মানুষ। তাই মাঠে এমন বিতর্ক তৈরি হয়, তৈরি হয় বিবাদ। তা, বিবাদ ছাড়া তো বিতর্ক হয়না।
সোনালীনিউজ/এআর
আপনার মতামত লিখুন :