• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাজধানী ঢাকা এখন ‘টাইমবোমা’ 


লাইজুল ইসলাম মার্চ ৯, ২০২৩, ১০:০৪ পিএম
রাজধানী ঢাকা এখন ‘টাইমবোমা’ 

ঢাকা: প্রাণের শহর ঢাকা। এই ঢাকাকে আহ্লদ করে বলা হয় জাদুর নগরী। কিন্তু এই জাদুর নগরী ধীরে ধীরে মানুষের প্রাণের জন্য হয়ে উঠছে ভয়ঙ্কর। এমন ভয়ঙ্কর যার মিল আছে টাইমবোমা বা একেকটি ডায়নামাইটের সঙ্গে।

যেভাবে ভবন বিস্ফোরণ হচ্ছে তাতে মনে হতেই পারে প্রতিটি ভবন পরিণত হয়েছে শক্তিশালী বোমায়। আর এসব বোমা থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই। কারণ যেকোনো সময় ভবন বিস্ফোরণ হয়ে মানুষের ওপর পড়তে পারে। মরতে পারেন পথচারীসহ যে কেউ।

ফায়ার সার্ভিস ও নগর পরিকল্পনাবীদরা বলছেন, নগরায়নের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো রাজক তা সঠিকভাবে পালিত হয়নি। নিয়ম না মেনেই তৈরি করা হয়েছে রাজধানীর বেশিরভাগ ভবন। এই অপরিকল্পিত ভবনের কারণেই ঘটে চলেছে একের পর এক দুর্ঘটনা। ভবনগুলো পরিণত হয়েছে টাইমবোমায়। মারা যাচ্ছে সাধারণ মানুষ।

নাম পরিচয় গোপন রাখার শর্তে ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা সোনালীনিউজকে জানান, রাজউক তার কাজটি সঠিকভাবে না করায় এই সমস্যাগুলো হচ্ছে। তারা বাড়ির প্ল্যান ঠিকই পাশ করে কিন্তু এরপর আর কোনো খোঁজ রাখে না। এমনকি তারা ফিল্ড ভিজিটেও যায় না। এই যে কাজটি না করার প্রবণতাই সব কিছুর কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। গুলিস্তানের ঐ ভবনের কোনো নকসাই নেই রাজউকের কাছে। এই হচ্ছে তাদের অবস্থা। তারা আবার পুরো রাজধানীকে বাসযোগ্য করার কথা বলছে।

তিনি বলেন, আমাদের করার কিছু থাকে না যখন দুর্ঘটনা ঘটে যায়। আমরা এসে মানুষকে উদ্ধার করি। কিন্ত বাড়ি করার সময় রাজউক, তিতাস, ওয়াসাসহ আরো স্টেক হোল্ডারদের অনুমতি নেয়ার বিধান আছে। কিন্তু আমাদের কাছে কাউকেই পাঠানো হয় না। বাড়ি বানানোর অনুমোদনের সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদনের বিষয়টিও যুক্ত করতে হবে। যেমনটা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণে অনুমোদন নেয়া হয়।

তিনি বলেন, রাজধানীতে গ্যাসলাইন থেকে দুর্ঘটনার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। লাইনের লিকেজ থেকে কোথাও গ্যাস জমাট বাঁধলে মশা মারার ব্যাট ব্যবহারের সময় অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে। নিয়ম না মেনে ভবন তৈরি, অনিরাপদ গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ, ত্রুটিপূর্ণ সংযোগ মেরামত না করাসহ ভবনের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকাই চলমান দুর্ঘটনার মূল কারণ।

দুর্ঘটনা হিসেব করতে গেলে দেখা যাবে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল দেশের সবচেযে বড় মানবসৃষ্ট বিপর্যয় ছিলো রানা প্লাজা ধস। এই ঘটনায় ১ হাজার ২৩৬ জন মারা গেছেন। অবশ্য আগুনের ঘটনায় ১১৭ জনের মৃত্যু ছিলো কষ্টদায়ক।

পুরান ঢাকার নিমতলীতে ২০১০ সালের ৩ জুন কেমিক্যালের গোডাউন থেকে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ বনানীর এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডে ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সিলিন্ডার বিস্ফোরণে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ৭১ জন মারা যায়।

এর আগে, ২০১০ সালের ২ জুন তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়ী এলাকায় একটি অনুমোদনহীন ভবন ভেঙে ২৫ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীতে ভবন ভেঙে দুজনের মৃত্যু হয়। ২০২১ সালের ২৭ জুন মগবাজারে একটি ভবনের নিচে পাইপলাইনে জমে থাকা গ্যাসের কারণে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। এতে ৮ জনের মৃত্যু হয়।

রোববার (৫ মার্চ) সায়েন্সল্যাবে সকাল সাড়ে ১০টায় একটি বাণিজ্যিক ভবনের তিন তালায় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে মৃত্যু হয় তিন জনের। হাসপাতলে চিকিৎসা নিচ্ছেন কমপক্ষে ১০ জন। যার ম্যধ্যে শেখ হাসিন বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি ৬ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ঠিক তার একদিন পর মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে চারটায় গুলিস্তানে একটি বাণিজ্যিক ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এতে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ২১ জন। হাসপাতালে ভর্তি আছেন আরো অন্তত ৩০ জন।

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন সোনালীনিউজকে বলেন, ‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বছরে গড়ে ১০ থেকে ১৫ হাজার ভবনের অনুমোদন দেয়, কিন্তু গড়ে প্রতিবছর ৯০ হাজারের বেশি ভবন তৈরি হচ্ছে। তাহলে বাকিটা কীভাবে হচ্ছে? তাই যারা ভবন তৈরি করছেন, তাদের অনুরোধ করব, বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) অনুযায়ী যেন তৈরি করেন।’

তিনি আরো বলেন, নগরীতে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা হচ্ছে গ্যাসলাইন থেকে। গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকেও মাঝেমধ্যে দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবু নাঈম মো. শাহিদউল্লাহ বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, জনসচেতনতার অভাব ও দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথভাবে কাজ না করায় দিন দিন নগরে ঝুঁকি বাড়ছে।

তিনি বলেন, লাইনে গ্যাস যেন কোনোভাবেই জমা না হতে পারে, এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে। নিয়মিত গ্যাসের লাইন পরিষ্কার করা উচিত। অথচ লাইনের দায়িত্বে যারা আছেন, তারা তা করছেন না। নিজ থেকেও গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পানির লাইন নির্দিষ্ট সময়ে ঠিক রাখা উচিত।

এ বিষয়ে নগর ও পরিবেশবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘রাজধানী ঢাকা একটি টাইমবোমার মতো বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। ভূমিকম্পের পর অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে। কারণ, অসংখ্য গ্যাসলাইন নগরীর তলদেশে জালের মতো ছড়িয়ে আছে। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের কাছে তার নকশাও নেই। তারা জানেও না কোথায় কোথায় গ্যাসলাইন রয়েছে। আবার সেগুলোর সংস্কারও করা হচ্ছে না।

এই নগর বিশেষজ্ঞ বলছেন, ‘ঢাকা এখন টাইমবোমায় পরিণত হয়েছে। যে কোনো সময় ঘটতে পারে বড় বিপর্যয়। আর এ জন্য সেবা সংস্থাগুলোর দায়িত্বে অবহেলা ও জনগণের অসচেতনতাই দায়ী।’

রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি গ্যাসলাইন দুর্ঘটনার কথা উল্লেখ করে ঢাকা ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক দিনমনি শর্মা বলেন, আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প-কারখানায় গ্যাস লাইনের লিকেজ থেকে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে। কোথাও গ্যাস জমে থাকার পর যদি মশার মারার ব্যাটও ব্যবহার করা হয়, তাহলে আগুন লেগে যেতে পারে। এ ছাড়া স্যুয়ারেজ লাইনে মিথেন গ্যাস জমে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে।

প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুটি দুর্যোগের কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মাকসুদ হেলালি বলেন, মানুষের তৈরি দুর্যোগ আধুনিক সভ্যতার অংশ। সময়ের কারণে আগুনের ব্যবহার বাড়বে। এজন্য সবাইকে সতর্ক হয়ে ব্যবহার করতে হবে। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা ছাড়া রাজধানীতে চলমান দুর্ঘটনাগুলো প্রতিরোধ সম্ভব নয়। সেইসঙ্গে ব্যবহারে সর্বোচ্চ সতর্ক হওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্ট এই নগরবিদ।

ক্ষতি প্রতিরোধে ভূমিকম্প সহায়ক ও বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণের পরামর্শ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও নগরবিদ ড. নূরুল ইসলাম নাজেম বলেন, জরাজীর্ণ ভবনগুলোর কারণে ভূমিকম্প হলে সাংঘাতিক ক্ষয়ক্ষতি হবে। কাজেই এ ব্যাপারে আগাম করণীয় ঠিক করতে হবে। তিনি বলেন, আমরা আইন মেনে কিছু করি না। যারা আইন মানাবে তারাও উদাসীন। নাগরিক সুরক্ষায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও সিটি করপোরেশনের কাজ অনেক। তারা তা পালন করছে না।

সোনালীনিউজ/এআর

Wordbridge School
Link copied!