• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সোহাগদের আরাভ বানায় কারা?


মুহাম্মদ আলম মার্চ ১৯, ২০২৩, ০১:২৮ পিএম
সোহাগদের আরাভ বানায় কারা?

ঢাকা : বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে বারোটায় গোপালগঞ্জ শহর থেকে রওনা করলাম কাজুলিয়া গ্রামে। তার পাশেই আশুটিয়া গ্রাম। এটা পড়েছে কোটালীপাড়া উপজেলায়। আর কাজুলিয়া গোপালগঞ্জ সদরে। পথে আশুটিয়ার নাম বলতে মুরব্বী গোছের একজন বলে উঠলেন, আরে টুপুরিয়ার উল্টো পাশে।

টুপুরিয়া নাম শুনেই বুক কেঁপে উঠলো। ওই গ্রামটা আমার পরিচিত। ছাত্র বয়সেই শুনেছি ওই গ্রামের নাম। কমুউনিস্ট পার্টির জনপ্রিয় নেতা ওয়ালিউর রহমান লেবু, কমলেশ বেদজ্ঞ এবং ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মানিক ও বিষ্ণুকে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে এ গ্রামেই নৃশংষভাবে হত্যা করা হয়। আজও যার বিচার হয়নি। কমলেশ বেদজ্ঞ এর মেয়ে সুতপা বেদজ্ঞ এখনো অপেক্ষায় আছেন। জানি না তাদের এই অপেক্ষা কবে শেষ হবে।

টুপুরিয়ার উল্টো দিকে অলি গলির মতো ছোট সড়ক পেরিয়ে হিরণ ইউপির চেয়ারম্যানের বাড়ি। জানলাম চেয়ারম্যানের বাড়ির পাশে আলোচিত দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী রবিউল ওরফে আপন এবং সর্বশেষ নাম আরাভ খানের বাড়ি। দুপুর ২টা নাগাদ আমরা পৌঁছালাম সেই বাড়িতে। ততোক্ষণে চাউর হয়ে গেছে সব। আরাভের মানে বাংলা সিনেমার কাহিনী এ গ্রামে সত্য হয়ে ধরা দিয়েছে। হয়ত একদিন আরাভের কাহিনী নিয়ে সিনেমা হবে। হয়ত তার নাম হবে -ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীর ছেলে কেন কোটিপতি। তবে সোহাগ নিজে ফেসবুকে তার সম্পদের যে বর্ণনা দিয়ে তার দাম শত শত কোটি টাকা।

আমাদের আগে আরো এক দল সাংবাদিক এ গ্রাম ঘুরে গেছেন। নিয়ে গেছেন আরাভ খানের অতীত জীবনের তথ্য-উপাত্ত। আমরা পৌঁছেই সোহাগ খানের সম্পর্কে চাচাতো ভাইয়ের কাছে জানলাম, তার চাচা বাজারে মাছ বিক্রি করতে গিয়ে গ্রামের মানুষের তোপের মুখে পড়ে ফিরে এসেছেন। চাচা মানের আরাভের আপন চাচা মাছ ধরে এবং তা বিক্রি করে সংসার চালান। বাজারের ব্যবসয়ীরা বলেছেন, তোমার ভাতিজা দুবাই শত কোটি টাকার মালিক। তুমি কেন মাছ বিক্রি করবা। ভয়ে চাচা কোনো প্রতিবাদ করেননি। কিন্তু আগামীতে তাঁর সংসার কীভাবে চলবে এ নিয়ে তিনি চিন্তিত। এই হলো ৪৫ কোটি টাকা ব্যয় করে সোনার ঈগল বানানো আরাভের রুট। আমার মনে বার বার প্রশ্ন জাগে, গ্রামের সোহাগদের দুবাইয়ে আরাভ কে বানায়? কারা এদের খুঁটি? কোনো দিন কী আমরা জানতে পারবো?

আরাভের বাবা মতিউর রহমান মোল্লা ছোটবেলা থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে ভাঙ্গারি মালামাল কেনাবেচা করতেন। অতি সাধারণ একটি পরিবার। মতিউরের তিন ছেলে-মেয়ে। দুই মেয়ে এবং এক ছেলে আরাভ। কয়েক দিন আগে বাবা-মা ও বোনকেও সে নিয়ে গেছে দুবাই। গ্রামের বাড়িতে তিন শতাংশ জয়গা ও এক বিঘার মতো জমি আছে তাদের। বাবা মায়ের দেয়া নাম সোহাগ। বিয়ে কয়টা আরাভের? জানতে চাইলে আরেক আত্মীয় বলেন, ওর ঠিক নাই। তবে দশটা তো হবেই। ওর চেহারা নায়ক ফেল। যেখানে যায় একটা বিয়ে করে। সপ্তম শ্রেণি অবধি লেখাপড়ার দৌড় তার। পরে ঢাকা চলে আসেন। নাম বদলে রাখেন আপন খান। অল্পদিনেই আঙুল ফুলে কলাগাছ। বনানীতে বাসা ভাড়া নেন। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে তার বাড়িতেই খুন হন পুলিশ পরিদর্শক মামুন। পরিদর্শক মামুন হত্যার আসামি রবিউল ওরফে আরাভ।  তারপর ফেরার। পরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে একটি গ্রামে ভাড়া থাকেন। সেখানকার নিরীহ বাড়িওয়ালাকে বাবা-মা ডেকে প্রথমে তাদের মন কেড়ে নেন। পরে তাদের সাথেও প্রতারণা করেন। ভারতের পাসপোর্টে ওই সহজ সরল দম্পতির নাম বাবা-মা হিসাবে ব্যবহার করেন। তাদের আধার কার্ডও ব্যবহার করেন।

ভারতের পাসপোর্ট নিয়ে দুবাই যাবার পর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি কোটালীপাড়ার সোহাগকে। অনেক সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যাংক লুটেরা তার সাথে যোগাযোগ করে ব্যবসা শুরু করেছেন।  

মতিউর রহমান মোল্লা বিয়ে করেন বাগেরহাটে চিতলমারী উপজেলার মুলাদী গ্রাম। আরাভের দুই বোন শারমিন ও নাজনীন দুজনেরই বিয়ে হয়েছে বাগেরহাট মোল্লারহাট উপজেলায়। এক সময় মতিউর রহমান ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলায় নলুয়া গ্রামে শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন।

১০ বছর আগে অর্থাৎ ২০১২-১৩ খ্রিষ্টাব্দে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার হিরন ইউনিয়নের আশুতিয়া গ্রামে নিজ বাড়িতে ঘর নির্মাণ করেন। এখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তবে আরাভের যোগাযোগ বেশি ছিলো মামা বাড়ি মোল্লারহাটেই বেশি। ওখানকার রাঘব বোয়ালদের সাথেও ছিলো তার সুসম্পর্ক। একটি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যানের সাথে ছিল তার জানাশোনা।
সোহাগ মোল্লা কোটালীপাড়া আশুতিয় ২০১৩ থেকে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পাঁচ বছর যাতায়াত ছিলো গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার আশুতিয়ায়।

গ্রামের লোকের সঙ্গে রবিউলের ভালো যোগাযোগ নেই। ওই পাঁচ বছরে মাঝে মাঝেই আসতেন দু’একদিন থেকে আপনজনদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে আবার চলে যেতেন। তার উত্থান এলাকার কেউ জানতেন না এবং সে কোথায় কি করছেন কোথায় থাকেন তাও জানতেন না। সব থেকে বেশি যোগাযোগ ছিলো তার বাবা-মায়ের সঙ্গে। তবে আপনজন অর্থাৎ আপন চাচা-চাচি কেউ যদি তার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন বা কোন সাহায্য চাইতেন, তাদের কাউকেই নিরাশ করেননি। এমন মনে হয়েছে তার বড় চাচি ও ছোট চাচির সঙ্গে কথা বলে।

সোহাগের গ্রামের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে তার বড় চাচি  মনোয়ারা বেগম চাচাতো বোন লাইজু আক্তার, ছোট চাচিসহ আরো দুজন তার  ছোট চাচা মিলন মোল্লার  ঘরের সামনে বসে আছেন। আরো চার-পাঁচ জন লোক এসেছিলো সোহাগের খোঁজ নিতে। তাদের সবাই জানতে চেয়েছে..সোহাগ এত টাকার মালিক কিভাবে হলো? আমরা এ বিষয়ে কিছুই জানিনা।

মিলন মোল্লার ঘরের পাশের ঘরটি সোহাগের বড় চাচা হায়দার মোল্লার। তার পশ্চিম পাশের ঘর সোহাগের বাবা মতিউর রহমান মোল্লার। ঘর তালাবদ্ধ আছে৷ ঘরের দোতলার জানালাগুলো খোলা রয়েছে। ঘরে লোক না থাকায় ঘরের সামনে  অপরিষ্কার।  সোহাগের বড় চাচা হায়দার আলী মোল্লার  স্ত্রী মনোয়ারা বেগম বলেন, আমাদের বাড়ির লোক রবিউলকে সোহাগ নামেই জানেন। তার মামা বাড়ির লোক তাকে রবিউল নামে ডাকে। ছোটবেলা থেকেই সে মামা বাড়িতে বেড়ে ওঠে। বাড়িতে তেমন একটা না আসায় সবাই তাকে ভালোভাবে চেনে না।

আমার দুই ছেলে সৌদিতে থাকে। তারা বিদেশ যাওয়ার সময় সোহাগের কাছে টাকা চেয়েছিলাম। সে আমাদের ৩ লাখ টাকা দিয়েছিলো। আমার ছেলেরা পড়ে তার শোধ করে দেয়। তবে রোজা বা কোরবানির ঈদের সময় এলাকায় অনেক লোককে কাপড় দেয়। কোরবানির সময় দুই, তিনটা গরু কোরবানি দেয়, তবে সে বাড়িতে আসে না।

আরো বলেন, আমার স্বামী মাছ বিক্রি করেন। আজ সকালে বাজারে মাছ বিক্রি করতে করতে গেলে বাজারের লোক তাকে ওই বাজারে মাছ বিক্রি করতে দেয় না। তারা বলে, তোমার ভাতিজা হাজার কোটি টাকার মালিক তুমি কেন মাছ বিক্রি করবে। আমরা আসলে জানিনা.. সে এত টাকার মালিক।

কথা হয় সোহাগের চাচাতো ভাই ফেরদাউস মোল্লার সাথে। তিনি বলেন, এক সপ্তাহ আগে সোহাগ তার বাবা মতিউর রহমান মোল্লা বোন শারমিন আক্তার ও ছেলে স্বপ্ন মোল্লাকে দুবাইতে নিয়ে যান। সোহাগের বাবা মতিউর রহমান মোল্লা ভাঙ্গারি ব্যবসা করতেন। পাঁচ বছর হল তিনি কোন কাজ করেন না। গায়ের সাদা পাঞ্জাবি আর গালভরা পান এই নিয়ে চলে তার দিন।

ওই ভাই আরো জানালো, আমার সঙ্গে সোহাগের দেখা হয় ঢাকাতে। সে আমাকে মোটরসাইকেল কিনে দিতে চেয়েছিলো। আমি তার প্রস্তাবে রাজি হইনি। সোহাগ নাকি দুবাইতে অনেক বড় দোকান করেছে। তার বিরুদ্ধে নাকি মামলা আছে। আজ লোকমুখে জানতে পারলাম, সোহাগ ফেসবুক লাইভে এসে তার মামলা সম্পর্কে বলছে। সে কিভাবে এত টাকার মালিক হলো..জানতে চাইলে ফেরদৌস মোল্লা বলেন, সে এত টাকার মালিক কিভাবে হলো..তা আমাদের জানা নেই।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!