• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১০ মে, ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

দিনমজুরি ছেড়ে মৌচাষ, মাসে আয় লাখ টাকা


মেহেরপুর প্রতিনিধি ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২২, ০১:০০ পিএম
দিনমজুরি ছেড়ে মৌচাষ, মাসে আয় লাখ টাকা

ফাইল ছবি

মেহেরপুর: মেহেরপুর সদর উপজেলার সীমান্তবর্তী কুতুবপুর গ্রামে বাস রোকনুজ্জামানের। অভাব অনটনের মধ্যে এক মেয়ে নিয়ে চলছিলো কোনোরকমে সংসার। প্রথমে মাঠে কাজ করে চালাতেন সংসার। ২০০২ সালে মাঠের কাজ বন্ধ করে শুরু করেন গ্রামে গ্রামে কাপড় বিক্রি। ব্যবসায় সমস্যা হওয়ায় চিন্তায় পড়ে যান তিনি। মানুষের কাছে যে পরিমাণ টাকা পড়েছিলো সেটিও আদায় করতে ব্যার্থ হন। বেছে নেন ভ্যান চালানোর কাজ। কিন্তু তার পরিবার কিছুতেই এটি মেনে নেয়নি। কী করে সংসার চালাবেন এই ভেবে দিশেহারা হয়ে পড়েন তিনি।

২০০২ সালে খোঁজ পান গ্রামের জুয়েল হোসেনের। তিনি তার নিজ বাড়িতে কয়েকটি বাক্স নিয়ে মৌ চাষ করতেন। সেখান থেকে বিনা টাকায় একটি বাক্স নেন তিনি। শুরু করেন মৌ চাষ।

এক বছরের মধ্যে তার খামারে বাক্সের সংখ্যা দাঁড়ায় ৮টি। প্রথম তিন বছর কোনো লাভের মুখ দেখতে পারেননি তিনি। উল্টো লোকসানে পড়েছেন। তারপরও হাল ছাড়েননি। লোকসান মাথায় নিয়ে বাড়াতে থাকেন বাক্সের সংখ্যা। মাত্র তিন বছরে তার খামারে বাক্সের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭০টি। সেখান থেকে মাসে আয় করতেন ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা।

রোকনুজ্জামান বলেন, দেশি ছোট জাতের মৌঁমাছি চাষ করার পাশাপাশি খুঁজতে থাকি উন্নত জাতের মৌঁমাছি। অবশেষ ২০১৪ সালে মাগুরা জেলার আবু বক্করের সন্ধান পাই। সেখান থেকে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে মেলিফেরা নামের ৭টি বাক্স কিনে আনি। নবউদ্যোমে শুরু করি মৌ চাষ। মাত্র এক বছরের মাথায় খামারে বাক্সের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১০টি।

এক সময়ের দিনমজুর রোকনুজ্জামান মৌ খামার করে মাসে আয় করছেন লাখ টাকা। মৌ খামার করে শুধু নিজেরই ভাগ্য বদলাননি তিনি, কর্মসংস্থান জুগিয়েছেন আরও বেশ কয়েকজন যুবকের। এখন তার খামারে মৌ বাক্সের সংখ্যা ১১০টি। শুধু জেলা নয় ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনাসহ বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে তার উৎপাদিত মধু।

তিনি জানান, এর বেশি হলে বিভিন্ন জায়গায় বাক্স বিক্রি করতে থাকেন তিনি। একটি বাক্স বিক্রি করেন ৭ থেকে ১০ হাজার টাকায়। ছোট মাছির একটি বাক্স থেকে আগে সপ্তাহে ১ কেজি মধু সংগ্রহ করতে পারতেন। আর উন্নত জাতের এ মাছির বাক্স থেকে এখন সপ্তাহে ৪ কেজিরও বেশি মধু সংগ্রহ করতে পারেন তিনি।

তিনি জানান, ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত মাসে ৪০ মণ করে মধু উৎপাদন করেন তিনি। এ সময় মাঠে তেল জাতীয় ফসল, লিচু ও আমের মুকুল থাকায় বেশি মধু উৎপাদন করতে পারেন। এ সময় মৌমাছিকে খাবারও কম দিতে হয়। আর অন্য সময় নিজেকে খাবার তৈরি করে মধুর উৎপাদন করতে হয়। বছরের অন্য ৮ মাসে গড়ে মধু উৎপাদন হয় ২০ মণ করে।

তিনি বলেন, এখন তার খামারে কাজ করেন ৫ থেকে ৮ জন যুবক। তারা মাসে আয় করেন ১৫ হাজার টাকা করে।

তিনি আরও বলেন, এখন যে মধু উৎপাদন হচ্ছে তা বিক্রি করি ৫০০ টাকা কেজি দরে। চাহিদা থাকায় বাড়ি থেকে মধু বিক্রি হয়ে যায়। আবার দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মুঠোফোনে মধুর অর্ডার দেয়। কুরিয়ারে ঠিকানাসহ মধু পাঠিয়ে দিই। আমার উৎপাদিত মধু খাঁটি হওয়ায় বাজারে চাহিদাও রয়েছে।

তরুণ এ উদ্যোক্তা বলেন, এ চার মাস বাদে বাকি সময় ঔষধি মধু উৎপাদন করি। এক বিঘা জমির ওপর একটি ঔষধি বাগানও তৈরি করেছি। সেখানে উৎপাদন করি, তুলশি, বাসক, পুদিনা, গাইনোরা, থানকুনি, আমলকি, বহেরা, অর্জুন, শিউলি ফুল, লজ্জাবতি, মাধবিসহ ২৫ ধরনের ঔষধি গাছ। সে গাছের পাতাগুলো সংগ্রহ করে বাড়িতে নিয়ে এসে বেটে রস বের করি। সঙ্গে আদা, রসুন, পেঁয়াজ, দারুচিনি, লবঙ্গ, তেজপাতা গরম পানিতে সিদ্ধ করে রসের সঙ্গে মিশিয়ে চিনি দিয়ে মৌমাছির খাবার তৈরি করি। পরে সে খাবার প্রতিটি বাক্সের মৌমাছিকে খাওয়ায়। এখান থেকে যে মধু উৎপাদন হয় সেগুলো ঔষধি মধু হিসেবে বাজরে বিক্রি করি। এ মধুর চাহিদাও থাকে বেশি। এ সময় মধু কম উৎপাদন হলেও এক হাজার টাকা কেজি দরে মধু বিক্রি করি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এ মধু আমার কাছ থেকে কিনে নিয়ে যান। এ মধু চাষ করে আমি মাসে লাখ টাকার ওপরে আয় করি।

তিনি বলেন, মৌ চাষে ধৈর্য লাগে। অনেকেই আমার কাছ থেকে বাক্স কিনে নিয়ে যাওয়ার পরও টিকিয়ে রাখতে পারে না। আর সবচাইতে বড় সমস্যা এখন বিভিন্ন সবজি ও তেল জাতীয় ফসলে প্রচুর পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে মৌমাছি মারা যাচ্ছে। তবে আমি উন্নত জাতের যে মৌমাছি সংগ্রহ করেছি সেটি ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে তিন হাজার করে ডিম পাড়ে। আর অসময়ে ডিম পাড়ে দেড় হাজার পর্যন্ত। ছোট মাছিগুলো ডিম পাড়ে দিনে গড়ে ২শ থেকে ৩শ।

রোকনুজ্জামান বলেন, মৌ খামারে জেলা থেকে আমি কোনো প্রশিক্ষণ পাইনি। আমি সাতক্ষীরা ও মাগুরায় গিয়ে সশরীরে নিজ উদ্যোগে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। তবে বিসিক থেকে আমাকে একটি সার্টিফিকেট প্রদান করেছে।

মেহেরপুর শহরের মন্ডলপাড়ার হামিদুর রহমান বলেন, বাজারে মধু কিনলেই চিনি মেশানো থাকে। রোকনুজ্জামানের উৎপাদিত মধু একেবারেই খাঁটি। ফলে শহর থেকে এসে প্রতি মাসেই আমি এখান থেকে মধু কিনে নিয়ে যাই।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক স্বপন কুমার খাঁ বলেন, আমরা কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে রোকনুজ্জামানকে পরামর্শ দিয়ে থাকি। আর জেলার অন্য মৌখামারীদের আমরা প্রশিক্ষণ দিয়েছি। তবে এখন পর্যন্ত রোকনুজ্জামান ছাড়া মৌচাষে কেউ দাঁড়াতে পারেনি।

সোনালীনিউজ/এসআই

Wordbridge School
Link copied!