• ঢাকা
  • শুক্রবার, ০৩ মে, ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১
ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনাল

জট কমাতে মামলা যাবে জজ আদালতে


আদালত প্রতিবেদক ডিসেম্বর ১, ২০১৯, ০৩:২৭ পিএম
জট কমাতে মামলা যাবে জজ আদালতে

ঢাকা : ২০১৭ সালে ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে মামলার সংখ্যা ছিল আড়াই লাখ।

সর্বশেষ হিসাবমতে, মামলার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় তিন লাখ। দুই বছরের ব্যবধান প্রায় ৫০ হাজার মামলা বেড়েছে। তবে বছরের পর বছর যাচ্ছে। কিন্তু ট্রাইব্যুনালে চলা মামলা নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না। নানা সংকটে ট্রাইব্যুনাল ঘিরে বাড়ছে ভোগান্তি। এমন পরিস্থিতিতে আইন সংশোধন করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

সূত্রগুলো বলছে, জাতীয় সংসদের আগামী অধিবেশনেই আইনের সংশোধনী পাস হতে পারে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, আমরা আশা করছি আগামী অধিবেশনেই আইনটি পাস হবে। এতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমবে।

তিনি বলেন, বর্তমানে একজন যুগ্ম জেলা জজ ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ পরিচালনা করেন। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল হওয়াতে নির্দিষ্ট বিচারক ছাড়া অন্যরা কেউ মামলা পরিচালনা করতে পারছেন না। এতে দুর্ভোগ হচ্ছে। মামলা চলছে বছরের পর বছর। আমরা আইন সংশোধন করে বিচারিক অধিক্ষেত্র বাড়াতে উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে একজন বিচারকের জায়গায় অনেক বিচারক মামলা পরিচালনা করতে পারবেন। মামলা নিষ্পত্তি দ্রুত হবে।

আইনমন্ত্রী জানান, সারা দেশে প্রতি বছর মামলার সংখ্যা বাড়ছে। এজন্য ভূমি ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাইজেশন করার দিকেও যাচ্ছে সরকার। আমাদের ভূমি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ এ বিষয়ে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছে।

বিচারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একজন বিচারকের পক্ষে মাসে ১৫টি মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব। বছরজুড়ে ১৬৫টি মামলা নিষ্পত্তি করতে পারে। এভাবে বিচার চললে ঢাকার ট্রাইব্যুনালের মামলা নিষ্পত্তি হতে ৩৩ বছর প্রয়োজন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বারবার কৌশল পাল্টেও মামলাজট কমানো যাচ্ছে না ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে। আবার দেশের সব জেলায় এই ট্রাইব্যুনাল নেই। ৬৪ জেলার মধ্যে প্রথমে ৩২টি ট্রাইব্যুনাল ছিল। ২০১২ সালে আরো ১২টি গঠন করা হয়। বর্তমানে এর সংখ্যা ৪৪।

কিন্তু মামলাজট বেড়েই চলছে। এ অবস্থায় মামলাজট কমাতে পাল্টানো হচ্ছে কৌশল। শুরু হয়েছে ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্ত করে সিনিয়র সহকারী জজদের ট্রাইব্যুনালের দায়িত্ব দেওয়ার প্রক্রিয়া।

তবে সহকারী জজরা দেওয়ানি ও পারিবারিক মামলাসহ অন্যান্য মামলার বিচার করেন। সেখানেও বিপুলসংখ্যক মামলা বিচারাধীন। এ অবস্থায় এ কৌশল কতটা কাজে আসবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

অবশ্য যদি নীতিমালা করে দেওয়া হয়, তারা যেদিন ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালের মামলার শুনানি গ্রহণ করবেন, সেদিন অন্য মামলার শুনানি করবেন না এবং সপ্তাহে অন্তত দুই দিন ভূমি জরিপ-সংক্রান্ত মামলার শুনানি করবেন, তাহলে হয়তো এ কৌশল কাজে দেবে।

বিএসআর (বাংলাদেশ রিভাইজ রেকর্ড অব রাইটস) জরিপের ভুল সংশোধন করতে ভূমি মালিকদের যেতে হয় ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে। ট্রাইব্যুনাল ভূমির মালিকানা-সংক্রান্ত আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত মালিকদের মালিকানা ফিরিয়ে দেন।

দুই বছর আগে দেশের ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালের মধ্যে কিশোরগঞ্জের ট্রাইব্যুনালে সর্বাধিক ৪৪ হাজার ১৫২টি মামলা বিচারাধীন।  ময়মনসিংহের ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে ৩২ হাজার ৬৭৬টি, জামালপুরে ১৭ হাজার ৯৫১টি, ঢাকা মহানগরে সাত হাজার ৪৩৮টি, সাতক্ষীরায় ছয় হাজার ৯৮৩টি, চাঁদপুরে নয় হাজার ১২৬টি, নেত্রকোনায় ২১ হাজার ৮৬৩টি, টাঙ্গাইলে ১০ হাজার ৮০৯টি, শেরপুরে ৬ হাজার ৪৬৭টি, বরগুনায় ৬ হাজার ২২২টি মামলা বিচারাধীন।

এভাবে দেশের ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন আড়াই লাখ মামলা। গত দুই বছরে বেশ কিছু মামলা নিষ্পত্তির পাশাপাশি নতুন মামলাও হয়েছে। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে দুই লাখ ৯৭ হাজার মামলা বিচারাধীন।

আবার যেসব মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, তার প্রায় সব কটিই সরকার বা ব্যক্তি ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আবেদন করেছে। ফলে মামলার সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

দেশে বিএসআর জরিপ শুরু হয় ১৯৮৪ সালে। এই জরিপ এখনো চলছে। যেসব এলাকায় শেষ হয়েছে, সেখানে দেখা দিয়েছে নানা ধরনের ত্রুটিবিচ্যুতি। মাঠ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, দায়িত্বে অবহেলা এবং অসতর্কতায় ভুলে ভরা ভূমি জরিপের খেসারত গুনতে হচ্ছে জমির মালিকদের। পরচা আর মানচিত্রে ভুল আর ভুল। কারো জমি পরচায় আছে তো মানচিত্রে নেই। আবার মানচিত্রে থাকলে পরচায় নেই।

জরিপে জমির মালিকের নামের ভুল, নামের বানানে ভুল, জমির পরিমাণে ভুল এবং গরমিলসহ অসংখ্য ত্রুটি রয়ে যাচ্ছে। যুগের পর যুগ ভোগদখল করে এলেও জরিপে প্রকৃত মালিকের পরিবর্তে নাম দেখানো হয়েছে অন্যের। এসব কারণে ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।

সব ধরনের খতিয়ানে ব্যক্তির নাম থাকার পরও কোনো জমি যদি সরকারের নামে রেকর্ডভুক্ত হয় এবং ট্রাইব্যুনাল সরকারের বিরুদ্ধে রায় দেন, তাহলে তা সংশিষ্ট ব্যক্তির নামে নামজারি করে দিতে হবে। কিন্তু এ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালের কোনো রায়ের পর নামজারি করে দিতে দেখা যায়নি।

১৯৮৪ সালে সরকার একটি পরিপত্র জারি করে, সরকারের বিরুদ্ধে কোনো রায় গেলে তা সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ করে তারপর রায় অনুযায়ী কাজ করা হবে। পুরনো এই আদেশ গত ১৫ সেপ্টেম্বর বাতিল করে নতুন পরিপত্র জারি করা হয়। নতুন পরিপত্রে ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালের রায় বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

পরিপত্রে বলা হয়েছে, ট্রাইব্যুনালের রায় পরীক্ষা করে যদি দেখা যায় কোনো ব্যক্তির পক্ষে রায়টি সঠিক, তাহলে আর উচ্চ আদালতে যাওয়ার দরকার নেই। নতুন এই পরিপত্রের কারণে ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে মামলার সংখ্যা কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আপিলেট ট্রাইব্যুনাল নেই : ভূমি জরিপ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালে মামলার যেকোনো আদেশের বিরুদ্ধে আপিলেট ট্রাইব্যুনালে যেতে হবে। আইনের ১৪৫ (বি) ধারায় আপিলেট ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান রয়েছে।

কিন্তু এ পর্যন্ত আপিলেট ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়নি। এ কারণে  বিচারপ্রার্থীদের ট্রাইব্যুনালের যেকোনো আদেশ বা রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট আবেদন করতে হয়। উচ্চ আদালতে যাওয়া অনেক ব্যয়বহুল। আপিলেট ট্রাইব্যুনাল গঠন হলে ব্যয় ও সময় কম লাগত। হাইকোর্টে কম সময়ের মধ্যে আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়ায় চরম ভোগান্তিতে বিচারপ্রার্থীরা।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনিরুজ্জামান হাওলাদার বলেন, ‘ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালের আদেশে সংক্ষুব্ধ বিচারপ্রার্থীকে হাইকোর্টে গিয়ে রিট আবেদন করে ট্রাইব্যুনালের আদেশকে চ্যালেঞ্জ করতে হয়।

এসব রিট যেমন দিনের পর দিন চলতে থাকে, রিট নিষ্পত্তি না হওয়ায় ট্রাইব্যুনালে দায়ের হওয়া মামলাগুলোও নিষ্পত্তি হয় না। ফলে মামলার জট বাড়ছে। আপিলেট ট্রাইব্যুনাল থাকলে বিচারপ্রার্থীরা তাৎক্ষণিক প্রতিকার পেত।’

ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের সুপারিশের বাস্তবায়ন নেই : ২০১৬ সালে জাতীয় বিচার বিভাগীয় সম্মেলনে বিচারকরা ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালের বেশ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেন।

কিন্তু ওই সব সমস্যা সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিচারকরা মতামত দেন, মাত্র ৪৩ জন বিচারক নিয়ে বিশাল মামলাজট নিষ্পত্তি করা অসম্ভব। প্রতি এক হাজার ৫০০ মামলার জন্য একজন বিচারক প্রয়োজন। মামলা পরিচালনায় ট্রাইব্যুনালে যে পরিমাণ লোকবল প্রয়োজন, তা-ও নেই।

প্রতি ট্রাইব্যুনালে যে পরিমাণ মামলা, তাতে পাঁচ থেকে সাতজন জারিকারক প্রয়োজন। নেই সেরেস্তদার। ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করতে সরকার এ পর্যন্ত কোনো বিধিমালাও তৈরি করেনি।

ঢাকা মহানগর ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনাল : ঢাকার ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি মামলা বিচারাধীন। একটি ট্রাইব্যুনালের পক্ষে এত মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব নয়।

সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, একটি মামলার শুনানির জন্য তিন থেকে পাঁচ মাস পর পর তারিখ ধার্য করা হয়। ফলে দীর্ঘ সময়েও মামলা নিষ্পত্তি হয় না।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!