বাড়ির পাশে টাইগার মুরগীর খামার গড়ে স্বাবলম্বী আলাল 

  • গাজীপুর প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: নভেম্বর ১৯, ২০২৩, ০৪:৩৪ পিএম
বাড়ির পাশে টাইগার মুরগীর খামার গড়ে স্বাবলম্বী আলাল 

গাজীপুর: আমাদের দেশে একটা চির চালিত প্রচলন রয়েছে। ছেলে কিংবা মেয়ে যে কোন তরুণ-তরুণীরা পড়ালেখা শেষ করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সরকারি বা বেসরকারি চাকরি খোঁজার পেছনেই বেশিরভাগ সময় ব্যয় করে থাকেন। তবে আমাদের এই সমাজে এমন কিছু তরুণ উদীয়মান যুবক রয়েছে। যারা চাকরির পিছনে সময় নষ্ট না করে নিজে উদ্যোগক্তা হয়ে কিছু একটা করে নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি পরিবার ও সমাজের মানুষের কাছে ভাল অবদান রাখতে চান। 

তেমনি এক তরুণ উদীয়মান উদ্যোক্তা গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বাসন, মুন্সি বাড়ী এলাকার বাসিন্দা মো: আলাল উদ্দিন। তিনি শিক্ষা জীবন শেষ করে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি জীবন শুরু করেন। মাত্র ২০ হাজার টাকা বেতনে কিন্তু তার এই ২০ হাজার টাকা দিয়ে কোন ভাবেই তিনি পেরে উঠতে পারছিলেন না সংসারের ব্যয়বহন করতে। পরে একদিন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে। নিজে উদ্যোগী হয়ে কিছু একটা করার জন্য। 

এ রকম অবস্থা যখন চলছে। তখন একদিন হঠাৎ করেই বন্ধু মহল ও পরিবারের জমানো কিছু টাকা একত্রিত করে। সর্বসাকুল্যে ৫০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে বাড়ির পাশেই স্বল্প পরিসরের জায়গায় একটি টাইগার মুরগীর সেট তৈরি করলেন। এর পরে বাজার থেকে টাইগার মুরগী কিনেন ১ হাজার পিস। এবার শুরু হলো তার পথচলা। প্রথমে তিনি মুরগী থেকে ডিম উৎপাদনের উদ্দেশ্য কাজ শুরু করলেও। পরে তিনি তার ফার্ম থেকে উৎপাদিত ডিম থেকে বাণিজ্যিক ভাবে বাচ্চা প্রজন্ম শুরু করেন।

তার এই সেট তৈরি ও সংগ্রামী পথচলার সময়টা ২০১৯ সালের শেষের দিকের কথা। ভাগ্যের কি পরিহাস এমনিতেই নতুন একটা পথচলা ও নতুন উদ্যোগক্তা। এর মাঝেই ২০২০ সালে সারা দেশেই শুরু হলো করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাব। থমকে গেলো যেনো তার উদ্যোগক্তার মিশন। এর পরেও তিনি হাল ছাড়েননি টাইগার মুরগীর ফার্মের কাজ। প্রবল মনোবল ও সৎ সাহস নিয়ে। চালিয়ে যেতে থাকেন ফার্ম মিশন। 

যাতে করে কোন ভাবেই যেনো তার ফার্মে কোন ভাইরাস জনিত রোগ হানা দিতে না পারে। সেজন্য এই অধম্য উদ্যোগক্তার নিরাপত্তার যত কলা কৌশল সব প্রদক্ষেপ নেন। 

শীতকালে মুরগির ঠান্ডাজনিত হাঁচি, কাশি, সর্দি, মাথা ফুলে যাওয়াসহ বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দেয়। কিন্তু করোনা মহামারি কালীন সময়ে এ ধরনের রোগের ঝুঁকি তৈরি হয়। তাই আলাল উদ্দিন কোন চিকিৎসক নয়। নিজের বুদ্ধি ও মেধা দিয়ে। ভাইরাস সংক্রামিত রোগ থেকে ফার্মকে বাঁচাতে তিনি ফার্মের বায়ো সিকিউরিটি জোড়দার করেন। ব্যাপক ভাবে খামারের চারিপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করেন। শেডের ভিতর ও বাহিরে ৩:১ অনুপাতে চুন এবং ব্লিচিং পাউডার প্রয়োগ করেন। এক থেকে দুই দিন পর পর জীবানুনাশক শেডের ভিতর এবং বাহিরে স্প্রে প্রয়োগ করেন। মেঝের লিটার সবসময় শুকনা ও ঝরঝরে রাখার ব্যবস্থা করেন। এরকম আরও বিশেষ কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করে পুরো করোনা মহামারি কালীন সময়ে শক্ত ভাবে ভাইরাসের হাত থেকে ফার্মকে নিরাপদ রাখেন। 

করোনা মহামারি কালীন সময়ে পেরিয়ে এবার দেখা দিয়েছে তার সফলতার মূখ। চোখে মূখে শুধু স্বপ্নের জলকানি যেনো ভেসে উঠেছে। ২০২১ সালের শুরুতেই তার ফার্মে সকল মুরগিরই ডিম উৎপাদনে চলে আসে। প্রথমেই এখানে তিনি প্রায় দেড় হাজার ডিমের দেখা পান। 

আস্তে-আস্তে তার ডিমের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। পরে ডিম বিক্রি করেই তিনি আরও কয়েক,শ টাইগার মুরগীর বাচ্চা কিনেন। এই বাচ্চা গুলোও একটা পর্যায়ে এসে ডিম দিতে থাকে। পরে আলাল উদ্দিন চিন্তা করেন। ডিম উৎপাদন করতে গেলে মুরগিরর প্রতি যে খরচ হবে। তাতে তিনি ডিম বিক্রি করে সব খরচ বাদে তেমন লাভবান হতে পারবেন না। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন। এবার তিনি একটা ইনকিউবেটর কিনবেন। তার ফার্ম থেকে যে ডিম উৎপাদন হবে এ গুলো ইনকিউবেটরে ফুটিয়ে বাচ্চা বিক্রি করতে পারলেই একজন সফল উদ্যোগক্তা হওয়া সম্ভব হবে। 

এর পরে তিনি প্রায় অর্ধলাখ টাকা দিয়ে একটি ইনকিউবেটরে ক্রয় করেন। পরে এই ইনকিউবেটরের মাধ্যমে বাচ্চা উৎপাদন শুরু করেন। এর পর থেকেই একজন সফল উদ্যোক্তার খাতায় নাম বসান। চলতি ২০২৩ সালের নভেম্বরে তার খামারে গিয়ে জানা যায়। এখন তিনি প্রতি মাসে তার খামার থেকে প্রায় ৬ হাজার পিস ডিম উৎপাদন করছেন। এগুলো পুরো ডিম ইনকিউবেটরের মাধ্যমে ফুটিয়ে বাচ্চা বিক্রি করছেন।০-৭ দিনের বাচ্চা বিক্রি করছেন ১০০ টাকা থেকে ১৩০ টাকা পর্যন্ত। এর মাধ্যমে তার খামার থেকে প্রতি মাসে প্রায় লাখ টাকার অর্থ উপার্জন হচ্ছে। শুধু তাই নয় প্রথমে একাই ফার্মে কাজ শুরু করলেও এখন তার ফার্মের কাজের জন্য পাঁচ জন বেকার লোকজনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে দিয়েছেন এই উদ্যোক্তা। 

আলাল উদ্দিনের ফার্মে মান সম্পূর্ণ বাচ্চা উৎপাদন সারা দেশের তরুণ উদীয়মান উদ্যাগক্তাদের কাছে ব্যাপক ভাবে প্রশংসনীয় হয়ে উঠেছে। আর তাই গাজীপুরের বাহিরে থেকেও অনেকেই তার ফার্মের বাচ্চা কিনতে প্রতি দিন এখানে ছুটে আসছেন। সুদূর সিরাজগঞ্জ আসা এক তরুণ উদীয়মান উদ্যোগক্তা সোনালী নিউজকে জানান, আমি নতুন একজন খামারী উদ্যোগক্তা। আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলাল উদ্দিন ভাইয়ের মুরগী পালন করে স্বাবলম্বী হওয়ার কথা শোনে এখানে এসেছি। আমি শোনেছি আলাল উদ্দিন ভাইয়ের মুরগীর বাচ্চা গুলো মানে অনেক ভাল। তাই এখান থেকে কিছু বাচ্চা কিনতে এসেছি এবং আলাল ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু পরামর্শ নিবো। তিনি আরও বলেন, পড়ালেখার পাশাপাশি মুরগির খামার গড়ে আমি সংসারের হাল ধরতে চাই।  

অধম্য তরুণ উদীয়মান খামারী আলাল উদ্দিন। সব সময় একটা কথাই ভাবতেন। চাকরি করবো না চাকরি দিবো। পরের অধীনে অল্প বেতন চাকরি না করে যদি নিজে এমন একটা কাজ করা যায়। যেখানে ভাল মুনাফা পাওয়ার পাশাপাশি আরও বেকার কিছু মানুষের কাজের ব্যবস্থা করা যাবে। অনেক সাধনার পরে হলেও তার সেই সোনালী স্বপ্ন আজ বাস্তবে রূপ ধারণ করেছে।এমনটিই জানিয়েছেন সোনালি নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে উদ্যােগক্তা আলাল উদ্দিন। 

তিনি জানান,আমি যখন চাকরি করতাম। তখন দেখতাম সারাদিন অনেক কষ্ট করার পরেও বড় বড় স্যারদের বকা ঝকা শোনতে হতো। আবার বেতনও মাত্র ২০ হাজার টাকা। তাই নিজে সিদ্ধান্ত নেই আমি নিজেই এমন একটা কিছু করবো। যেখানে আমি যেনো সমাজের কিছু বেকার লোকজনেরও কর্মসংস্থান করতে পারি। এর পরে আমি ২০১৯ সালে এই সংগ্রাম শুরু করি।পরবর্তীতে করোনা মহামারি কাটিয়ে আজ ২০২৩ সাল অতিবাহিত হতে চলছে। 
আল্লাহর রহমতে এখন আমি সফল।  

এলাকাবাসীরা জানিয়েছেন উদ্যোগক্তা হয়ে জীবনে নতুন যে কোন কাজ শুরু করলে শুরুটা অনেকটা কষ্টের ও বাঁধা বিপত্তির হলেও। একটা পর্যায়ে এবং কোন একটা সময়ে এসে সফলতা যে ধরা দেয়। তারই জলন্ত প্রমাণ গাজীপুরের খামারী উদ্যোগক্তা আলাল উদ্দিন। 

সোনালীনিউজ/এমএস/এসআই

Link copied!