মাত্র ২০ পর্যটক নিয়ে প্রথম যাত্রায় বরিশাল পৌঁছেছে শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী স্টিমার ‘পিএস মাহসুদ’। শুক্রবার (২৮ নভেম্বর) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় নগরীর ত্রিশ গোডাউন জেটিতে নোঙ্গর করেছে স্টিমারটি।
শনিবার সকালে স্টিমারটি বরিশাল থেকে চাঁদপুর হয়ে ঢাকার সদরঘাটে যাবে বলে জানিয়েছেন বিআইডব্লিউটিএর বরিশাল আঞ্চলিক কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক মো. জসীম উদ্দীন। শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮টায় স্টিমারটি সদরঘাট থেকে ৪১ জন যাত্রী নিয়ে রওনা দেয়। মাঝে চাঁদপুর ঘাটে নেমে যান ২১ যাত্রী।
ব্যবস্থাপক জসীম উদ্দিন বলেন, প্রথম দিনে মোট ৪১ যাত্রীর সবাই প্রথম শ্রেণির ছিলেন। বরিশাল থেকে ঢাকা যাওয়ার জন্য নয়টি প্রথম শ্রেণির কেবিন বুকিং দেওয়া হয়েছে। স্টিমারটি ঘাটে পৌঁছালে যাত্রীদের অভ্যর্থনা জানাতে আসেন বরিশালের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মো. আহসান হাবীব এবং বরিশাল জেলা প্রশাসক খায়রুল আলম সুমন।
এ সময় প্রথম যাত্রার যাত্রী যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমার বাড়ি মোড়লগঞ্জ। স্টিমারের সঙ্গে অনেক স্মৃতি জড়িত। এটা একটি হেরিটেজ। আবার যখন শুরু হল তাই সুযোগটি প্রথমেই নিতে চেয়েছি। মা-বোনসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসেছি।
এটা শুধু জার্নি নয়। এটা একটি অনুভুতি। যার সঙ্গে অনেক কিছুই জড়িত। এখানে অনেক আধুনিক লঞ্চ রয়েছে। এর সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনা করলে হবে না। যারা ভ্রমণপিপাসু, নদী দেখতে ভালোবাসেন, দৃশ্য দেখতে ভালোবাসেন, তাদের জন্য এটা ভালো একটি সুযোগ।
পর্যটন বিকাশে এ জেলার বিখ্যাত স্থান ও খাবারের ব্রান্ডিং করা প্রয়োজন মন্তব্য করে মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, শুধু বরিশালবাসী নয়, সারাদেশের মানুষদের আকৃষ্ট করতে হবে। একটা ঐতিহ্যকে মূল্যায়ন করতে হয়। এর মাধ্যমে একটা নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে।
বরিশালের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মো. আহসান হাবীব বলেন, নদীপথের যাত্রায় একটা নতুন সুচনা হয়েছে। পর্যটন শিল্পের বিকাশের জন্য এটা করা হয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পরে নৌপথের জনপ্রিয়তা হারিয়ে গিয়েছিল। এটা আবার ফিরে আসবে।
বিআইডব্লিউটিসির মেরিন অফিসার মো. হানিফ বলেন, শতবর্ষী জলযান ‘পিএস মাহসুদ’। এটা দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। নিজস্ব ডকইয়ার্ডে মেরামত করা হয়। আধুনিকায়ন করা হয়েছে। আগের চেয়ে অনেক সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। যাত্রীরা আগের চেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা পাবেন। আগের চেয়ে গতিও বাড়ানো হয়েছে। আগে ঘণ্টায় আট থেকে সাড়ে আট কিলোমিটার যেত। এখন সাড়ে ১০ কিলোমিটার যেতে পারে।
১৬ নভেম্বর সদরঘাটে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘পিএস মাহসুদ’ এর উদ্বোধন করেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন। এরপর ২১ নভেম্বর থেকে এর যাত্রা শুরুর কথা ছিল। কিন্তু যাত্রীর অভাবে তা সম্ভব হয়নি।
কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রতি শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮টায় ঢাকা থেকে ছেড়ে চাঁদপুর ঘাট যাবে। পরে সন্ধ্যায় বরিশাল ঘাটে এসে ভিড়বে। পরদিন শনিবার সকাল সাড়ে ৮টায় আবার ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যাবে।
আপাতত বিআইডব্লিউটিসি এটি পরিচালনা করবে। পরে ইজারা দেওয়া হবে। সপ্তাহে দুদিন বাদে বাকি দিনগুলোতে স্টিমারটি নৌ বিহারের জন্যও ভাড়া দেওয়া হবে। বিআইডব্লিউটিসির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে সেটি ভাড়া নেওয়া যাবে।
স্টিমারে তিন শ্রেণির সিট রয়েছে। দ্বৈত শয্যার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রতি কেবিনের ভাড়া দুই হাজার ২৬০ টাকা; সঙ্গে ৩৩০ টাকা ভ্যাট। দ্বিতীয় শ্রেণির দ্বৈত শয্যার কেবিনের ভাড়া এক হাজার ৬৫০ টাকা এবং সুলভ শ্রেণির চেয়ার ৬০০ টাকা।
এ ভাড়া ঢাকা থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত যথাক্রমে ৭৮৩ টাকা, ৫৬০ টাকা এবং ১৪০ টাকা। চাঁদপুর থেকে বরিশাল পর্যন্ত যথাক্রমে এক হাজার ১৭৩ টাকা, ৮৪০ টাকা এবং ২৬০ টাকা। স্টিমারটি বাণিজ্যকভাবে যখন চলত তখন ৭০০ অধিক যাত্রী ধারণক্ষমতা ছিল।
কালের সাক্ষী ‘পিএস মাহসুদ’ ১৯২৮ সালে কলকাতার গার্ডেন রিচ ওয়ার্কশপে নির্মিত হয়। বেলজিয়ামের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় ১৯৮৩ সালে নারায়ণগঞ্জের ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ লিমিটেডের মাধ্যমে স্টিমারটির স্টিম ইঞ্জিনকে ডিজেল ইঞ্জিনে রূপান্তর করা হয়।
১৯৯৫ সালে এটিকে মেকানিক্যাল গিয়ার সিস্টেমে রূপান্তর করা হয়। ২০২২ সালে চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে একে আবার চলাচল উপযোগী করা হয়েছে। এই স্টিমারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কয়েক প্রজন্মের গল্প। ব্রিটিশ আমল, ১৯৪৭ সালের দেশভাগ, এরপর পাকিস্তান আমল, তারপর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ।
এম
আপনার মতামত লিখুন :