• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৪ মে, ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১

তিন মেগা প্রকল্প শেষ এ বছর


নিজস্ব প্রতিবেদক জানুয়ারি ৪, ২০২২, ০১:৩৯ পিএম
তিন মেগা প্রকল্প শেষ এ বছর

ঢাকা : চলতি বছরে চালু হতে যাচ্ছে তিনটি বড় অবকাঠামো প্রকল্প। যা বদলে দিবে বাংলাদেশের অর্থনীতির চেহারা। জুন থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে শুরু হবে যান চলাচল। একই সময় রাজধানীর উত্তর থেকে দক্ষিণে ছুটবে মেট্রোরেল। দেশের দক্ষিণ-পূর্বের বন্দরনগরী চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশের সুড়ঙ্গপথও চালু হয়ে যাবে তত দিনে। এই টানেল কক্সবাজারের সঙ্গে চট্টগ্রামের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার কমিয়ে দেবে।

শুরু হবে অবকাঠামো সামর্থ্যে ভিন্ন এক বাংলাদেশের যাত্রা। ২২ বছর আগে ১৯৯৮ সালের জুনে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু চালুর পর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক দুর্দান্ত গতি সঞ্চার হয়েছিল। শুরু হয়েছিল এক ভিন্ন বাংলাদেশের যাত্রা।

ওই সেতুর প্রধান ঋণদাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক তখন বলেছিল, এটি চালু হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আগের চেয়ে দশমিক ৬০ শতাংশ অতিরিক্ত গতি পাবে। তবে বাস্তবে দেখা যায়, প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে ১ থেকে দেড় শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি যোগ করে চলেছে বঙ্গবন্ধু সেতু।

এবার তারা বলছেন, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল এবং বঙ্গবন্ধু টানেল চালু হলে কম করে হলেও বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ২ শতাংশ বাড়তি যোগ হবে। আর তাতেই ডাবল ডিজিট অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে হাঁটা শুরু করার সুযোগ সৃষ্টি হবে বাংলাদেশের। এভাবে এগোতে থাকলে ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংক বলছে, এবার প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। আইএমএফ বলেছে, ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হবে। আর এডিবি বলেছে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হবে। এসব পূর্বাভাস সরকারের লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি। এবার সরকার ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছে।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, জুনে পদ্মা সেতু, এরপর কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল এবং ডিসেম্বরে এমআরটি-৬ প্রকল্পের আওতায় মেট্রোরেল উদ্বোধন করা হবে।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেছেন, আমরা যদি একটু ঠান্ডা মাথায় হিসাব করি, তা হলে দেখতে পাবো, ২০২২ সালের মধ্যে করোনা পরিস্থিতি যদি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে আসে, আমাদের অর্থনীতি যদি আগের অবস্থায় ফিরে আসে, তাহলে ২০১৯-২০ অর্থবছরের মতো ৮ শতাংশের ওপরে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ফিরে যাবে বাংলাদেশ। তার সঙ্গে এই তিন মেগা প্রকল্পের অর্থনৈতিক প্রাণচাঞ্চল্য যোগ হলে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি দুই অংকের (ডাবল ডিজিট) মাইলফলকের ঘরে নিয়ে যেতে পারব। তখন আর আমাদের পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। উন্নয়নের উল্লম্ফন অব্যাহত থাকবে। ২০৩১ সালের মধ্যেই উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হব আমরা।

অর্থনীতির গবেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, করোনার ধাক্কা সামলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। রপ্তানি আয় বাড়ছে। আগামী দিনে আরো বাড়বে বলেই আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ইউরোপ-আমেরিকায় করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় আমাদের পোশাক রপ্তানিকারকরা প্রচুর অর্ডার পাচ্ছেন। দামও বেশি পাচ্ছেন আমাদের রপ্তানিকারকরা।

তিনি বলেন, আশার কথা হচ্ছে, পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে আগামী বছরেই যানবাহন চলাচল করবে। মেট্রোরেলও পুরোদমে চলতে শুরু করবে। কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণকাজও শেষ হবে। এই তিনটি বড় প্রকল্প বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় ভিন্নমাত্রা যোগ করবে।

সে পরিস্থিতিতে ২০২৩ সাল থেকে ভিন্ন বাংলাদেশ পাবে দেশবাসী। আর এসব উন্নয়নযজ্ঞকে কেন্দ্র করে বিনিয়োগের ছক কষছেন উদ্যোক্তারা। সে সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতেই প্রয়োজনীয় পণ্য-সরঞ্জাম আমদানি করছেন। বাড়ছে আমদানি। সবকিছু ঠিকঠাক মতো চললে ২০২৩ সাল থেকে বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে আরো মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন আহসান এইচ মনসুর।

বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, সত্যিই সাহস পাচ্ছি আমরা। প্রচুর অর্ডার আসছে। গত অর্থবছরের চেয়েও এবার বেশি হবে রপ্তানি আয়। এরই মধ্যে এই তিন মেগা প্রকল্প চালু হলে তার সামগ্রিক প্রভাব রপ্তানি বাণিজ্যসহ অর্থনীতির সব খাতেই পড়বে। ২০২৩ সাল থেকে এক নতুন, ভিন্ন বাংলাদেশ পাব আমরা।

দেশের অবকাঠামো খাত নিয়ে গবেষণা করা অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক জায়েদ বখত বলেন, দেশের দক্ষিণাঞ্চলে পদ্মা সেতুর প্রভাব হবে অপরিসীম। সবচেয়ে বড় কথা হলো সড়কপথ ও রেলপথে যোগাযোগের সময় চার ঘণ্টা কমে যাবে। এতে মানুষের যাতায়াত সহজ হবে। নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠবে।

তিনি বলেন, সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার আগে প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে আমরা অনুমান করেছিলাম, এই সেতু হলে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। তবে এখনকার বাস্তবতা সেই অনুমানের চেয়ে অনেক বেশি। অর্থাৎ অর্থনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধির হার এর চেয়েও বেশি হবে। দেশের অর্থনীতি চাঙা হবে, সম্প্রসারিত হবে বাজার। এত দিন সেখানে কৃষিপণ্যের বাজার ছোট ছিল, এখন সেই বাজার বড় হবে। কৃষকরা ঢাকায় ফসল পাঠাতে পারবেন। ধারণা করা যায়, দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের আয় দ্বিগুণ হয়ে যাবে।

এই সেতুর কারণে মোংলা বন্দর গতি পাবে। এত দিন এই বন্দর তেমন একটা ব্যবহূত হতো না। এখন যোগাযোগ গতি পেলে এই বন্দরের ব্যবহার বাড়বে। যোগাযোগ উন্নত হলে স্বাভাবিকভাবে দক্ষিণাঞ্চলে নতুন শিল্পায়ন হবে। অনেক মানুষ কাজ পাবে। বেকারত্ব কমবে, কমবে মানুষের ঢাকায় আসার প্রবণতা।

এদিকে মেট্রোরেলের পরীক্ষামূলক যাত্রা দেশবাসীর মধ্যে আশাবাদ এবং উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরি করেছে। জাপানের অর্থ ও কারিগরি সহায়তায় ঢাকাবাসীর স্বপ্নের প্রকল্প মেট্রোরেলের দৈর্ঘ্য ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার। রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ছুটে বেড়াবে ট্রেন।

বর্তমানে উত্তরা থেকে মতিঝিলে যেতে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে। কিন্তু মেট্রোরেলে লাগবে মাত্র ৩৮ মিনিট। এতে প্রতিদিন ৫ লাখ যাত্রী যাতায়াত করতে পারবে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতে, মেট্রোরেল চালু হলে ঢাকার যানজট যেমন কমবে, তেমনি জিডিপিও ১ শতাংশ বাড়বে। ঢাকার অসহনীয় যানজটে শুধু মানুষের দুর্ভোগই বাড়ছে না, দেশও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

অন্যদিকে সরকারের জন্য অনেক বেশি গর্ব করার মতো প্রকল্প হচ্ছে কর্ণফুলী নদীর নিচের সুড়ঙ্গপথ বঙ্গবন্ধু টানেল। এ ধরনের পথ দেশের ইতিহাসে প্রথম। পানির তলায় এই সুড়ঙ্গপথটি কক্সবাজারের সঙ্গে চট্টগ্রামের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার কমিয়ে দেবে। কক্সবাজার ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের গাড়ি চট্টগ্রাম শহরকে এড়িয়ে সুড়ঙ্গপথ দিয়েই রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে চলাচল করতে পারবে। তাহলে চট্টগ্রাম নগরীর যানজটও অনেকাংশে কমবে।

টানেলটি চালু হলে বদলে যাবে চিরচেনা চট্টগ্রাম। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ আবাসন ব্যবস্থা সম্প্রসারিত হবে। চীনের সাংহাই নগরীর মতো চট্টগ্রাম হবে ওয়ান সিটি-টু টাউন। যার প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে।

১০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এ টানেল চীনের সঙ্গে জি-টু-জি ভিত্তিতে নির্মাণ করা হচ্ছে। এ প্রকল্পে চীনা-সহায়তা প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে চীনের একটি প্রতিষ্ঠান।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!