• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৭ মে, ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে আলেমসমাজ


মোঃ হুসাইন আহমদ ডিসেম্বর ২১, ২০২০, ০২:২৪ পিএম
মুক্তিযুদ্ধে আলেমসমাজ

ঢাকা : ডিসেম্বর মাস। বিজয়ের মাস। বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় সোনালী একটি মাস একাত্তরের ডিসেম্বর মাস। রক্তনদী পেরিয়ে বাংলার দামাল ছেলেরা একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল। বাংলার আকাশে সেদিন উদিত হয়েছিল বিজয়ের রক্তিম সূর্য। লালসবুজের পতাকা নিয়ে পথচলা শুরু হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের। এই সূর্য এখনো আলোড়িত করছে বাংলার প্রতিটি নাগরিক ও জনপদকে।

স্বাধীনতা প্রতিটি জিনিসের জন্মগত মৌলিক অধিকার। কিন্তু খোদাপ্রদত্ত এ মৌলিক অধিকারে অনেক সময় হস্তক্ষেপ করে ক্ষমতায় উন্মত্ত কিছু মানুষ। আর তখনই অপরিহার্য হয়ে উঠে মুক্তি-সংগ্রামের। জানবাজি রেখে লড়াই করে পৃথিবীতে যারা অধিকার আদায় করে নিয়েছে, বাঙালি জাতি তাদের অন্যতম। স্বাধীনতার এ সংগ্রামে সেদিন কোনো বিভেদ ছিল না। ছিল না দল, মত বা ধর্মের কোনো বিভাজন। হাতে হাত ও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তির এ মহান লড়াইয়ে। মূলত মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালির জীবনসংগ্রাম ও বেঁচে থাকার একটি প্রেরণা ও চেতনার মূলউৎস। জামিআ মাদানিয়া খুলনার প্রিন্সিপাল ও শায়খুল হাদিস মাওলানা ইমদাদুল্লাহ কাসেমী এবিষয়ে বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধটা ছিল মূলত স্বপক্ষ শক্তির লড়াই। এ দেশ ও জাতির অধিকার রক্ষার এবং নিজস্ব স্বপ্ন বাস্তবায়নে এ ছিল এক অবধারিত বাস্তবতা। অস্ত্রশস্ত্র ও কলাকৌশলে দুর্বল ও ছোট হওয়া সত্ত্বেও সময়ের প্রয়োজনে পুরো জাতি একতাবদ্ধ হয়েছিল মুক্তির এ সংগ্রামে।

সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তাহীনতা ও মৌলিক অধিকারে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অবৈধ হস্তক্ষেপই সশস্ত্র একটি লড়াইয়ের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। এটা স্বাভাবিক যে, যখনই জুলুম নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়, মাজলুমদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাও তখন তীব্র হয়। একাত্তরের এ মহান সংগ্রাম ছিল জালিমের বিরুদ্ধে মাজলুমের লড়াই। জুলুমি শক্তির মুকাবিলায় ’৭১-এ ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো দৃঢ়ভাবে। এতেই আমাদের ভৌগোলিক মুক্তি অর্জিত হয়েছে। কিন্তু নৈতিকতার চরম অবক্ষয় ও চারিত্রিক অধঃপতনের কারণে আমরা যেন সেই আগের অবস্থানেই ফিরে গিয়েছি। যে সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্নে মুক্তিকামী জনতা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতার সংগ্রামে, তা এখনো অধরাই রয়ে গেছে। বরং নিত্য নতুনপন্থায় সমাজ আরো কলুষিত হয়েছে। তাই স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমাদের সামাজিক সংস্কারটা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। এজন্য আলেম-ওলামাসহ সমাজের দায়িত্বশীল সবার এ বিষয়টির প্রতি লক্ষ করা উচিৎ। কারণ নৈতিক অবক্ষয়ই পরাধিনতাকে টেনে আনে ও বরণ করে নেয়।

আমাদের পূর্ববর্তী আলেমদের নেতৃত্বে ব্রিটিশবিরোধী যে সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল, এর পরিসমাপ্তিই হলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। ১৮৩১ সালে বালাকোটে মুক্তির যে প্রেরণা নিয়ে শহীদ হয়েছিলেন সৈয়দ আহমদ শহীদ (র.) ও মুজাহিদীনরা। তারই ধাাবাহিকতায় ১৮৫০ সালের আজাদী ১৮৫৭ সালের আজাদী আন্দোলন। তারপর রেশমী রুমাল আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল শাইখুল হিন্দ (র.)-এর হাতে। তার পরে হজরত শাইখুল হিন্দের সুযোগ্য উত্তরসূরী হজরত হুসাইন আহমদ মাদানীর আপসহীন সংগ্রামে ব্রিটিশ বেনিয়া মুক্ত হয়েছিল ভারতের মাটি। কিন্তু বাংলার মানুষের তখনো মুক্তি আসেনি, বরং নতুনভাবে ভিনদেশি আক্রমণের শিকার হয়েছিল বাংলার জনগণ। এরই প্রেক্ষিতে শুরু হয় একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ।

এ মুক্তিযুদ্ধেও আলেমদের সক্রিয়া অংশগ্রহণ ছিল। ভারতের আলেমরাও সাহায্য করেছিল আমাদের এ মুক্তির সংগ্রামে। বিশেষভাবে ফিদায়ে মিল্লাত আসাদ মাদানী (র.) এ ক্ষেত্রে বেশ জোরালো ভূমিকা পালন করেছিলেন। বাংলাদেশ থেকে যে বিপুলসংখ্যক শরণার্থী ভারতে গিয়েছিল, তাদের জন্য অর্থসংগ্রহ করে রিলিফের ব্যবস্থা করেন তিনি। তাছাড়া বাংলাদেশ অভিমুখে আমেরিকার সপ্তম নৌবহর পাঠানোর প্রতিবাদে তিনি দশ হাজারেরও বেশি মানুষ নিয়ে দিল্লিস্থ মার্কিন দূতাবাস ঘেরাও করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তার অকৃত্রিম এই ভালোবাসার প্রেক্ষিত অতি সমপ্রতি বাংলাদেশ সরকার তাকে বিদেশি বন্ধু স্বাধীনতা সম্মাননা প্রদান করেছে। ২০১৩ সালে জাতীয় স্বাধীনতা পদক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে তার পক্ষে এ পদক গ্রহণ করেন তার সুযোগ্য সন্তান সাইয়্যিদ মওদুদ মাদানী। তাই একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলন শুধু এ দেশের ভূখণ্ডকেন্দ্রিক কোনো সংগ্রাম নয়; বরং সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ বেনিয়াদের কবল থেকে মুক্তির শেষ ধাপও বটে।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যদিও পুরো জাতির অংশগ্রহণ ও সমর্থন ছিল। তবে এর বিরোধিতাও করা হয়েছিল। ইসলামের নাম ভাঙিয়ে কিছু মানুষ এ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু হাক্কানী আলেমসমাজ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল। কারণ যেখানেই জুলুম নির্যাতন ও শোষণ হয়েছে, সেখানেই আলেমসমাজ প্রতিবাদ করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মাওলানা হুসাইনুল বান্না বলেন, নির্দিষ্ট একটি দল ইসলামের লেভেল লাগিয়ে ইসলামের বিরোধিতা করেছিল। কোনো হাক্কানী আলেম মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে সভা সমাবেশ বা সক্রিয় কোনো কার্যক্রম করেনি।

বিজয় ও মুক্তির সুন্দর এক স্বপ্ন নিয়ে বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে। হাজারও ত্যাগ ও জীবনের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। স্বাধীনতা যেমন আল্লাহর প্রদত্ত সব সৃষ্টির মৌলিক অধিকার তেমনি তা অর্জনও হয়েছে সবার সম্মিলিত প্রচষ্টায়। অতএব, শিক্ষিত অশিক্ষিত, কৃষক শ্রমিক চাকুরে, বণিক, আলেমসমাজসহ সবার দায়িত্ব হলো কষ্টে পাওয়া এই বিজয়কে রক্ষা করা। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন তথা সুখীসমৃদ্ধ অসামপ্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলাটাই এখন মূখ্য বিষয়। বিজয়ের আনন্দে হারিয়ে যাওয়ার চেয়ে বিজয়মাল্য বয়ে বেড়ানো কঠিন। প্রয়োজন আত্মার বলীষ্ঠতা। আর সুন্দর ও বলিষ্ঠ আত্মবিনির্মাণে কাজ করেন উলামায়ে কেরাম।

লেখক : শিক্ষার্থী, তাকমিল (মাস্টার্স ডিগ্রি) দারুস-সুন্নাহ টাংগাইল       

Wordbridge School
Link copied!