• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১
পিলখানা হত্যাকাণ্ড

১৫ বছরেও অজানা ‘মাস্টারমাইন্ড’


বিশেষ প্রতিনিধি ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২৪, ০৩:৫২ পিএম
১৫ বছরেও অজানা ‘মাস্টারমাইন্ড’

ঢাকা : ২০০৯ থেকে ২০২৪। মাঝখানে পেরিয়ে গেছে ১৫ বছর। রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) বিদ্রোহের নৃশংস ঘটনায় করা হত্যা মামলার বিচার এখনো চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পথে যায়নি। নির্মম ও বিয়োগান্ত ওই বিদ্রোহের ‘ঘটনার পেছনের ঘটনা’ বা এ ঘটনায় করা জড়িত তা উদঘাটন করতে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হাইকোর্টের রায়ে তাগিদ ও সুপারিশ ছিল চার বছরের বেশি সময় আগে। তারও কোনো অগ্রগতি হয়নি। ফলে জানা যায়নি বিদ্রোহের নামে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনের প্রাণ কেড়ে নেওয়ার ‘কুশীলব’ কারা ছিলেন।

দেশের ফৌজদারি বিচারের ইতিহাসে সর্বোচ্চসংখ্যক আসামির এই হত্যা মামলাটি বিচারিক আদালত হয়ে হাইকোর্টে নিষ্পত্তি হতে লেগেছে আট বছর। হাইকোর্টের রায়ের পর মামলাটি আপিল নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে ছয় বছর ধরে।

অন্যদিকে একই ঘটনায় বিস্ফোরক আইনে মামলাটির বিচারকাজ এখনো বিচারিক আদালতেই শেষ হয়নি। মামলা দুটোর বিচারকাজ নিকট ভবিষ্যতে শেষ হবে এমন সম্ভাবনার কথাও শোনাতে পারেননি সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা।

আপিল বিভাগে বিচারপতি স্বল্পতার কথা জানিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন গত সপ্তাহে সাংবাদিকদের বলেছেন, চারজনের একটি বেঞ্চ হলে ৪০-৫০ কার্যদিবসে হত্যা মামলার আপিল নিষ্পত্তি হতে পারে।

অন্যদিকে বিস্ফোরক মামলায় ১৩০০ সাক্ষীর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের সাক্ষ্য নিয়ে চলতি বছরে বিচার নিষ্পত্তির আশাবাদ শোনালেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।

ছয় বছর ধরে আপিল শুনানির অপেক্ষা : পিলখানায় হত্যাকান্ডের ঘটনায় অভিযোগপত্রে আসামি করা হয় ৮২৯ জনকে। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর বিচারিক আদালতের রায়ে ১৫২ জনকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। ১৬০ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদন্ড। ২৫৬ আসামিকে ১০ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। আর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পান ২৭৮ জন।

এরপর ফাঁসির আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদন্ড অনুমোদন), আপিল, জেল আপিল, অপর্যাপ্ত সাজার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল নিষ্পত্তি করে ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর দুদিন বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের (ইতিমধ্যে অবসরে) নেতৃত্বে গঠিত হাইকোর্টের একটি বৃহত্তর বেঞ্চ রায় দেয়। এতে বিচারিক আদালতে ফাঁসির সাজা পাওয়া ১৩৯ আসামির দন্ড বহাল রাখা হয়।

এ ছাড়া আটজনকে মৃত্যুদন্ড থেকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা। বিচারিক আদালতে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত পাঁচজনকে খালাসের রায় দেওয়া হয়। আর বিচারিক আদালতে ১৬০ জন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে হাইকোর্টে ১৪৬ জনের যাবজ্জীবন সাজা বহাল থাকে। এ সাজা থেকে খালাস দেওয়া হয় ১৪ জনকে।

এ ছাড়া বিচারিক আদালতে ৬৯ জনের খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল মঞ্জুর করে ৩১ জনকে যাবজ্জীবন সাজা দেয় হাইকোর্ট। হাইকোর্টে ১৮৫ জনের যাবজ্জীবন সাজার রায় হয়। হাইকোর্টের রায়ের দুই বছরের কিছু বেশি সময় পর তিন বিচারপতির সই করা ২৯ হাজার ৫৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি প্রকাশিত হয়।

উচ্চ আদালতে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের তথ্য অনুযায়ী, হাইকোর্টের রায়ে ৬৩ জন মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামির পক্ষে আপিল বিভাগে ৩৫টি আপিল করা হয়েছে। এ ছাড়া যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ১৩২ জনের পক্ষে ২৯টি আপিল করা হয়।

অন্যদিকে হাইকোর্টে খালাস পাওয়া এবং মৃত্যুদন্ড থেকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে, এমন ৮৩ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ২০টি আপিল করেছে।

এ ছাড়া মৃত্যুদন্ড ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আর বেশ কিছু আসামির পক্ষে আপিল ও জেল আপিল হলেও আসামি ও আপিলের সংখ্যা নিয়ে নিশ্চিত তথ্য মেলেনি।

আসামিপক্ষের আইনজীবীরা জানান, বিচারিক আদালত থেকে খালাস পেয়েছিলেন ২৭৮ জন। রাষ্ট্রপক্ষের আপিলে হাইকোর্ট তাদের ২২ জনকে ১০ বছর পর্যন্ত সাজা দেয়। ইতিমধ্যে তাদের সাজা খাটা শেষ হয়ে গেছে। সে হিসেবে হত্যা মামলায় খালাসপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা এখন ২৫৬ জন। তবে, এরা সবাই বিস্ফোরক মামলার আসামি হিসেবে এখনো কারাগারে আছেন।

আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, বিস্ফোরক মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় হত্যা মামলায় খালাসপ্রাপ্তরা বিনা বিচারে জেল খাটছেন। এর তো সুরাহা হওয়া উচিত। তেমনি হত্যা মামলায় যারা আপিল করেছেন তাদের বিষয়টিও নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন।

তিনি বলেন, এখন আপিল বিভাগে মাত্র ছয়জন বিচারক আছেন। এর মধ্যে একজন বিচারক (বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী) হাইকোর্টে এই মামলা শুনছিলেন। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী তিনি এখন এই মামলা শুনবেন না। তাই নতুন বিচারক নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত এ মামলার শুনানি হয়তো সম্ভব হবে না।

অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা ন্যায়বিচারের স্বার্থে সুপ্রিম কোর্ট এ বিষয়ে শিগগির উদ্যোগ নেবে।’

গত বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এএম আমিন উদ্দিন সুপ্রিম কোর্টে তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, যেহেতু হাইকোর্টে তিনজন বিচারপতি এই মামলা শুনেছিলেন, এখন আপিল বিভাগে এই মামলা শুনতে চারজন বিচারক লাগবে। কিন্তু আপিল বিভাগে এখন পর্যাপ্তসংখ্যক বিচারক নেই।

রাষ্ট্রপক্ষের উদাসীনতায় বিচার বিলম্ব হচ্ছে আসামিপক্ষের এমন অভিযোগ সঠিক নয় দাবি করে তিনি বলেন, ‘শুধু আমরা নই, তারাও তো (আসামিপক্ষ) চাইছে এই মামলা দ্রুত শুনানি ও শেষ করতে। আশা করি অচিরেই বিচারক নিয়োগ হবে এবং এটি হলে শুনানি শুরু ও নিষ্পত্তি হবে।’

উদঘাটিত হয়নি ‘ঘটনার পেছনের ঘটনা’ : চার বছর আগে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে নারকীয় এই হত্যাযজ্ঞের বিষয়ে বলা হয়, ‘বিডিআরের বিভাগীয় কতিপয় উচ্চাভিলাষী সদস্য ও একটি স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনা ও উসকানিতে সাধারণ ও নবাগত সৈনিকরা প্ররোচিত ও বিভ্রান্ত হয়ে বিদ্রোহ ও হত্যাকান্ডের এ ঘটনা ঘটিয়েছে। ওই ঘটনায় ইন্ধনদাতা গোষ্ঠী দুদিনব্যাপী স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিদ্রোহীদের উৎসাহ জুগিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে এরা কারা?’

আদালত আরও বলে, ‘পিলখানায় সংঘটিত সামরিক কর্মকর্তাদের নির্মম হত্যাকান্ড দ্বারা বিডিআরের দন্ডিত সদস্যদের বাইরে কোনো গোষ্ঠী বা স্বার্থান্বেষী মহলের সুবিধালাভের সুযোগ ছিল কি না? যদি থাকে তাহলে তারা কারা?’

হাইকোর্ট বলে, ‘ঘটনার পেছনের ঘটনা’ উদঘাটন করে জাতির সামনে প্রকৃত স্বার্থান্বেষী মহলের চেহারা উন্মোচনের জন্য সরকার জনস্বার্থে প্রয়োজন মনে করলে আইনসম্মতভাবে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের দ্বারা তদন্ত কমিশন গঠনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে।

একই সঙ্গে পিলখানার ওই ঘটনার ব্যাপারে বাহিনীর অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা ইউনিটের ব্যর্থতা তদন্ত করে জনসম্মুখে তা প্রকাশের তাগিদ দেয় হাইকোর্ট। হাইকোর্টের এ সুপারিশ বাস্তবায়ন নিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলেও তার বক্তব্য জানা যায়নি।

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘যারা হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিলেন, তাদের পরিবারগুলো তো ভুক্তভোগী। তাদের তো জানার অধিকার আছে যে, কেন তারা স্বজনদের হারিয়েছেন। হাইকোর্টের সুপারিশ বা তাগিদ তো অনেকটা নির্দেশনার মতোই। এখন কেন তা হচ্ছে না?’

বিস্ফোরক মামলায় সাক্ষ্য এখনো চলছে : এ মামলায় তদন্ত শেষে ২০১০ সালের ২৭ জুন অভিযোগ গঠন করে ঢাকার সংশ্লিষ্ট বিচারিক আদালত। অভিযোগপত্রে সাক্ষী করা হয় ১ হাজার ৩৫৭ জনকে।

আইনজীবীদের তথ্য অনুযায়ী, এখন প্রতি মাসে চারটি তারিখে সাক্ষ্যগ্রহণ হচ্ছে। চলতি মাসের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি সব শেষ সাক্ষ্যগ্রহণ হয়। ইতিমধ্যে ২৭৩ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। আগামী ২৮ ও ২৯ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণ হবে। মামলাটির বিচারকাজ চলছে পুরান ঢাকার বকশীবাজারে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকার এক নম্বর মহানগর বিশেষ ট্রাইব্যুনালের অস্থায়ী আদালতে।

সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থন এবং এ প্রক্রিয়া শেষে মামলার সবশেষ ধাপ যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আসবে।

এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, ‘হত্যা মামলায় এক হাজারের বেশি সাক্ষী ছিলেন। সেখানে ৬০০-এর মতো সাক্ষীর সাক্ষ্য নিয়ে ওই মামলাটি নিষ্পত্তি হয়েছিল। বিস্ফোরক মামলায় ৪০০-এর মতো সাক্ষীর সাক্ষ্য পেশ করব।’

অভিযোগ গঠনের পর দীর্ঘ সময়েও এই মামলাটি কেন নিষ্পত্তির পথে যায়নি, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে তিন বছর বিচারকাজ প্রায় বন্ধ ছিল। আর এ ধরনের বড় মামলায় সাক্ষী বেশি থাকে। তাদের জেরা করতে হয়। এসব নানা কারণে বিচারকাজ বিলম্ব হয়েছে। তবে, আমরা আশাবাদী যে চলতি বছরের মধ্যে বিচার নিষ্পত্তি হবে।’

এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!