• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১
আলোচনা করবে ১৩ দফার ভিত্তিতে

ইসি পুনর্গঠনে আজ শুরু হচ্ছে সংলাপ


নিজস্ব প্রতিবেদক ডিসেম্বর ১৮, ২০১৬, ১১:৫৮ এএম
ইসি পুনর্গঠনে আজ শুরু হচ্ছে সংলাপ

দশম জাতীয় নির্বাচন বর্জনকারী এবং জাতীয় সংসদের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের সংলাপ শুরু করতে যাচ্ছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।

আজ রবিবার (১৮ ডিসেম্বর) বিকেল সাড়ে ৪টায় বঙ্গভবনে এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বিএনপির আজকের আলোচনায় প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সূত্রমতে, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনার সময় নতুন ইসি গঠনের জন্য ‘সার্চ কমিটি ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনার’ নিয়োগের জন্য বেশ কয়েকটি নাম প্রস্তাব করতে পারেন খালেদা জিয়া।

এরপর আগামীকাল সোমবার জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, মঙ্গলবার লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি ও কৃষক-শ্রমিক জনতা লীগ এবং বুধবার জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের (ইনু) সঙ্গে আলোচনায় বসবেন রাষ্ট্রপতি। তারপর পর্যায়ক্রমে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ দেশের অন্যান্য নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও আলোচনা করবেন তিনি।

বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেস উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) তার গুলশানের বাসভবন ‘ফিরোজা’ থেকে আজ (রবিবার) বিকেল ৩টায় বঙ্গভবনের উদ্দেশে রওনা দেবেন। এরপর প্রথমে তিনি নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যাবেন। সেখান থেকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ প্রতিনিধিদলের সদস্যদের নিয়ে বঙ্গভবনে যাবেন তিনি। বিএনপি চেয়ারপারসনের নেতৃত্বাধীন এই প্রতিনিধি দলে রয়েছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, লে. জে (অব.) মাহবুবুর রহমান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। এ ছাড়া নতুন ইসি গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনায় প্রতিনিধিদলে আরো তিন নেতাকে যুক্ত করার অনুরোধ জানিয়ে বঙ্গভবনে চিঠি পাঠিয়েছে বিএনপি। আজকে বিকেলে (রবিবার) অনুষ্ঠেয় এই সংলাপে অংশ নিতে এর আগে ১০ নেতার তালিকা বঙ্গভবনে পাঠিয়েছিল বিএনপি। এখন তার সঙ্গে দলের স্থায়ী কমিটির আরো তিন সদস্য তরিকুল ইসলাম, মির্জা আব্বাস ও ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার নাম যোগ করার অনুরোধ করা হয়েছে। নতুন তিন নেতাকে প্রতিনিধিদলে অন্তর্ভুক্ত করতে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল স্বাক্ষরিত একটি চিঠি রাষ্ট্রপতি কার্যালয়ের সচিবকে পাঠানো হয়েছে বলে গতকাল শনিবার বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানান। তবে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বিএনপির এ চিঠির কোনো জবাব আসেনি বঙ্গভবন থেকে। দলের নেতাদের প্রত্যাশা, বৈঠকের আগেই বিএনপির প্রতিনিধিদলে সদস্যসংখ্যা বাড়ানোর ব্যাপারে ইতিবাচক জবাব আসবে রাষ্ট্রপতির দফতর থেকে। এদিকে গত বৃহস্পতিবার বিএনপির আগের চিঠি পাওয়ার পর বঙ্গভবনের এক কর্মকর্তা বলেন, দলটির প্রতিনিধিদলে আরো চার-পাঁচজন সদস্য যোগ হতে পারেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, বিএনপির প্রতিনিধিদলের সদস্য বাড়ানো হলে অন্যান্য দলের প্রতিনিধিও বাড়তে পারে।

অন্যদিকে নতুন ইসি গঠন নিয়ে ‘রাষ্ট্রপতির রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ’ প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী  বলেছেন, ‘খাঁচায় পোষা’ নয়, মুক্ত ইসি চাই আমরা। সব দলের মতামতের ভিত্তিতে সরকারের প্রভাবমুক্ত একটি নির্বাচন কমিশন আশা করছে বিএনপি। যাদের অধীনে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

তিনি বলেন, জনগণের প্রত্যাশা একটি নিরপেক্ষ-স্বাধীন নির্বাচন কমিশন। যা তাদের সোনার খাঁচার মধ্যে পোষা একটা পাখি হবে না। এটা সত্যিকার অর্থেই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হবে। যে প্রতিষ্ঠান সরকারের রক্তচক্ষু অথবা তাদের অশুভ ইচ্ছাকে অস্বীকার করে জনগণের ভোট গ্রহণ নিশ্চিত করবে।

রিজভী বলেন, আমরা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রত্যাশা করব, সেই ধরনের নির্বাচন কমিশন তিনি গঠন করবেন। যে ধরনের কমিশনের প্রতি সব দলের আস্থাসহ দশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপিরও আস্থা থাকবে।

নতুন নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে গঠনের ওপর জোর দিয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব বলেন, সব দলের আস্থা ছাড়া বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী বা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী যদি শুধু শাসক দলের অনুগত লোক খোঁজেন, তাহলে তো এটা আস্থাশীল কোনো ঘটনা হবে না।

২০১২ সালেও বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার আগে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। সেই আলোচনায়ও বিএনপি অংশ নিয়েছিল। তবে কাজী রকিবউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে কমিশনকে শুরু থেকেই মেনে নিতে পারেনি বিএনপি। কাজী রকিবের নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষে আগামী ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব নেবে নতুন ইসি। ওই কমিশনের অধীনেই ২০১৯ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ২০১২ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ‘সার্চ কমিটি’র মাধ্যমে যেভাবে ইসি গঠন করা হয়েছিল, এবারও একই পদক্ষেপ নিয়েছেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।

প্রসঙ্গত, সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ চূড়ান্ত করলেও এ ক্ষেত্রে তাকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মেনে চলতে হবে। কারণ, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া অন্য সব কাজেই তাকে সরকারপ্রধানের পরামর্শ মেনেই কাজ করতে হয়।

আলোচনা হবে খালেদা জিয়ার ১৩ দফার ভিত্তিতেই: নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দেয়া ১৩ দফার ভিত্তিতেই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনা করবে বিএনপি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দেয়া ১৩ দফা প্রস্তাবনার ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আমরা আলোচনা করব। যে বিষয়গুলো সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে তুলে ধরা হয়েছে, সে বিষয়গুলো নিয়েই রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলবেন খালেদা জিয়া।

দলীয় সূত্রমতে, বিএনপির হাইকমান্ড মনে করেন, নতুন ইসি গঠনের আগে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংলাপ কার্যকর কোনো ভূমিকা পালন করে না। তার পরও রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসেবে ইসি গঠনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে ডেকে কথা বলেন রাষ্ট্রপতি। আদতে প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের লোক দিয়েই গঠন করা হয় ‘সার্চ কমিটি’। প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগসহ অন্যান্য কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে থাকে। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই গতানুগতিক আলোচনায় না গিয়ে রাষ্ট্রপতিকে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এরই পরিপ্রেক্ষিতে দলের শীর্ষ কয়েকজন নেতা, বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ১৩ দফা প্রস্তাব তৈরি করেন তিনি।

দফাগুলোর মধ্যে ছিল- ১) ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠন ২) প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের খুঁজে বের করতে ‘পাঁচ সদস্যের বাছাই কমিটি’ গঠন ৩) বাছাই কমিটির আহ্বায়ক হবেন অবসরপ্রাপ্ত কর্মক্ষম একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি, যিনি বিতর্কিত নন এবং অবসর সময়ে সরকারের কোনো লাভজনক পদে আসীন হননি ৪) বাছাই কমিটির অন্য সদস্যরা হবেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ৫) বাছাই কমিটি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের জন্য দুইজন ও চারজন নির্বাচন কমিশনারের জন্য আটজনের নামের তালিকা দেবে। এই তালিকা থেকে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও চারজন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেবেন ৬) নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দল অথবা স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক দলগুলোর মতৈক্যের ভিত্তিতে ইসি গঠন ৭) কমিশনে অন্তত একজন প্রবীণ মহিলা কমিশনার রাখা ৮) জাতীয় নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা প্রদানের বিধান কমিশনের আরপিওতে সংযোজন ৯) নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল অথবা স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক দলগুলো ২ জন করে ব্যক্তির নাম বাছাই কমিটির কাছে প্রস্তাব করবে ১০) বাছাই কমিটিই প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন ১১) কেউ যদি দায়িত্ব পালনে অসম্মতি প্রকাশ করে, তাহলে একই প্রক্রিয়ায় পুনরায় কমিশনার নিয়োগ ১২) প্রধান কমিশনারসহ অন্য কমিশনারদের হতে হবে দলনিরপেক্ষ, সর্বজনশ্রদ্ধেয় সৎ ব্যক্তি এবং ১৩) নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন সচিবালয় গঠন।

এসব প্রস্তাব তৈরি হওয়ার পর ১৮ নভেম্বর রাজধানীর একটি হোটেলে জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে দেশবাসীর উদ্দেশে এই ১৩ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন খালেদা জিয়া।

আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে কাজী রকিবউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এই মেয়াদ শেষের আগেই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য এসব প্রস্তাব দেন বিএনপি চেয়ারপারসন। এরপর এই প্রস্তাব নিয়ে জোর তৎপরতা চালায় বিএনপি। গত ৫ ডিসেম্বর বিএনপির সিদ্ধান্ত ছিল, এক সপ্তাহের মধ্যে আলোচনার জন্য রাষ্ট্রপতির সম্মতি না পেলে, বিকল্প পথে প্রস্তাব পৌঁছে দেয়া হবে। সে অনুযায়ী দলের ভাইস চেয়ারম্যান রুহুল আলম চৌধুরী ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বঙ্গভবনে গিয়ে প্রস্তাব দিয়ে আসেন গত সপ্তাহে।

দলটির নেতারা মনে করছেন, নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে বিগত দিনের অভিজ্ঞতা ভালো না হলেও এবার ভালো কিছু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, এবার যে কমিশন গঠন হবে, তার অধীনেই হবে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার ব্যাপারে সরকারের ওপর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপ থাকবে। আর গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পূর্ব শর্ত নিরপেক্ষ ও যোগ্য নির্বাচন কমিশন- যে কথাটি খালেদা জিয়ার দেয়া ১৩ দফা প্রস্তাবে বারবার বলা হয়েছে।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমটিআই/এমএইউ

Wordbridge School
Link copied!