• ঢাকা
  • রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক আচরণ করবে বাংলাদেশ


নিজস্ব প্রতিবেদক নভেম্বর ২৬, ২০১৬, ১১:২৮ এএম
রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক আচরণ করবে বাংলাদেশ

মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালাচ্ছে দেশটির সেনাবাহিনী। ১০ বছরের বেশি বয়সীদের গুলি করে হত্যা করছে দেশটির সেনারা। রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গারা এ অবস্থা থেকে প্রাণে বাঁচতে দলে দলে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে ছুটছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে।

এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল শুক্রবার (২৬ নভেম্বর) জানিয়েছেন, অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক আচরণ করবে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকারকে আহ্বান জানানো হবে।

মিয়ানমারে অব্যাহত নির্মম ও নৃশংস নির্যাতন পরিস্থিতিতে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছে শত শত রোহিঙ্গা শরণার্থী। সীমান্তে কড়া পাহারার মধ্যেও বিভিন্নভাবে ঢুকে পড়ছেন অনেকে। এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সরকারের সহানুভূতি রয়েছে।

এদিকে বিবিসির এক সংবাদে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এক বিবৃতি উল্লেখ করে বলেছে, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ দেশটির সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের সমষ্টিগতভাবে শাস্তি দিচ্ছে। এ থেকে বাঁচতে নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করলে তাদের পুশব্যাক করছে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ। বিবৃতিতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ উভয়ের আচরণকেই নিষ্ঠুর আখ্যা দিয়ে সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এটি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।

সিএনএনের প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী লালু বেগম নামে এক মহিলার সাক্ষাৎকারের তথ্য দিয়ে। যিনি বর্তমানে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে কক্সবাজারের কুতুপালং এলাকায় অবস্থান করছেন। প্রতিবেদনে ওই নারীর বরাত দিয়ে বলা হয়, ১০ বছরের বেশি বয়সীদের মিয়ানমারের সেনাবাহিনী হত্যা করছে। আর বেশি বয়স্ক বা বৃদ্ধ পুরুষদের ট্রাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে রাখাইন সম্প্রদায়ের নারীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে, পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হচ্ছে।

সিএনএনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে লালু বেগম জানান, সেনাবাহিনী যখন আসে তখন আমরা নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাই। আমি জানি না আমার স্বামী জীবিত আছেন নাকি মৃত। তিনি জানান, তার গ্রামের বহু নারী সেনাবাহিনীর ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। লালু বেগম বলেন, তারা কোনো সুন্দর নারী দেখলেই তাদের কাছে পানি চায়। এরপর ঘরে ঢুকে তাদের ধর্ষণ করে।

লালু বেগম বলেন, আমাদের গ্রাম যখন জ্বালিয়ে দেয়া হয় তখন আমরা অন্য গ্রামে চলে যাই। অব্যাহতভাবে অবস্থান বদলাতে থাকি। এভাবে আসতে আসতে আমরা নদীতীরে আসি। এই আসার পথে অনেকেই তাদের পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছেন। লালু বেগমের ভাবি নাসিমা খাতুন সিএনএনকে বলেন, যাত্রা শুরু করার সময় আমরা ছয়জন ছিলাম। পরিবারের তিন সদস্যকে হারিয়েছি আমরা। আমার স্বামী ও এক পুত্রকে হত্যা করা হয়েছে। আরেক পুত্র নিখোঁজ রয়েছে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিবৃতিতে সংস্থার দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক পরিচালক চম্পা প্যাটেল বলেছেন, মিয়ানমার থেকে আসা লোকজন, যারা নাফ নদীতে বা ভূমিতে আত্মগোপন করে আছে, তারা খাবার, পানি ও জরুরি চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থী ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলে অ্যামনেস্টি জানতে পেরেছে, মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে নিরাপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গা পুরুষদের হত্যা করছে, নারীদের ধর্ষণ করছে, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ চালাচ্ছে।

সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, এরই মধ্যে অন্তত দুই হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে আশপাশের সীমান্তবর্তী গ্রামে, শরণার্থী শিবিরে এবং বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে। যে কারণে তাদের সঠিক সংখ্যা নিরূপণ সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন প্যাটেল। এদিকে, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন, মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধন অভিযান চালাচ্ছে। গত ৯ অক্টোবর ৯ জন সীমান্তরক্ষীকে হত্যার পর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমান অধ্যুষিত মংডুতে অভিযান শুরু করে।

রাখাইন রাজ্যে আনুমানিক ১০ লাখ রোহিঙ্গার বাস। জাতিসংঘের ভাষায়- এরা বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী। এমনকি বংশপরম্পরায় হাজার বছর ধরে সেখানে বসবাস করে আসা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব পর্যন্ত দেয়নি মিয়ানমার সরকার। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা শব্দটি পর্যন্ত ব্যবহার করতে রাজি নয়। তারা এ সম্প্র্রদায়ের মানুষদের অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী হিসেবে বিবেচনা করে। অথচ বহু মানুষই মিয়ানমারে তাদের পূর্বপুরুষদের শিকড় প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন।

জাতিসংঘ শরণার্থী-বিষয়ক সংস্থার কর্মকর্তা জন ম্যাককেসিক বলেছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বর্ডার গার্ড এবং পুলিশ রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের ওপর ‘যৌথ নিপীড়ন’ চালাচ্ছে। জাতিসংঘের হিসাবে সাম্প্র্রতিক সহিংসতায় ৮৬ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে কমপক্ষে ৩০ হাজার মানুষ। শরণার্থী সংস্থার মুখপাত্র ম্যাককেসিক আরো বলেন, ৯ অক্টোবর ৯ জন পুলিশ নিহত হওয়ার ঘটনায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সীমান্তরক্ষীরা মিলে ‘সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘবদ্ধ প্রতিশোধ’ নিচ্ছে। তারা দাবি করছে, রোহিঙ্গারাই ওই হত্যার সঙ্গে জড়িত। তিনি বিবিসিকে বলেন, নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বাহিনী রাখাইন রাজ্যে ‘মানুষকে গুলি করে হত্যা করছে, শিশুদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে, নারীদের ধর্ষণ করছে, ঘরবাড়িতে আগুন দিচ্ছে, লুটপাট চালাচ্ছে, নদী পেরিয়ে তাদের পালিয়ে যেতে বাধ্য করছে।’

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১২ সালে মিয়ানমার সরকারের মদদপুষ্ট উগ্র জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধদের তাণ্ডবে প্রায় ২০০ রোহিঙ্গা মারা যায়। ঘর ছাড়তে বাধ্য হন এক লাখেরও বেশি মানুষ। আর এ বছরের অক্টোবর মাসের ৯ তারিখে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ এলাকায় সন্ত্রাসীদের সমন্বিত হামলায় ৯ পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার পর তার দায় চাপানো হয় রোহিঙ্গাদের ওপর। আর তখন থেকেই শুরু হয় সেনাবাহিনীর দমন প্রক্রিয়া। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের দাবি, এর পর থেকেই রাখাইন রাজ্যে ক্লিয়ারেন্স অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছে তারা। রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নিপীড়নকে ইসলামী চরমপন্থা দমনে কাজ করছে বলে দাবি করছে তারা। আর তা এমন নৃশংস প্রক্রিয়ায় চালানো হচ্ছে যে, সেখানে সংবাদমাধ্যমকেও প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না।

রাখাইন রাজ্যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টির পরও চলমান দমন প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিজেদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি অস্বীকার করে দায় এড়াতে চাইছে দেশটির সরকার। রোহিঙ্গারা নিজেরাই নিজেদের বাড়িঘর পোড়াচ্ছে বলেও দাবি করছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। তবে আন্তর্জাতিক সম্প্র্রদায় নিশ্চিত করেই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবেই চেনে। জাতিসংঘের অবস্থানও আলাদা নয়। সে কারণেই মিয়ানমারকে জাতিগত নিধন চালিয়ে যাওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে সংস্থাটি।

বুধবার বাংলাদেশে নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে নিয়ে ভর্ৎসনা করেছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। রাখাইন রাজ্যে সেনা দমনকে ‘গভীর উদ্বেগ’-এর বিষয় হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে, ৪০ দিন ধরে রাখাইন রাজ্যে অবরুদ্ধ হয়ে থাকা এক লাখ ৫০ হাজার মানুষকে ত্রাণ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো। জাতিসংঘের শরণার্থী-বিষয়ক সংস্থা এই ত্রাণ কার্যক্রমের সমন্বয় করছে।

এদিকে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে, তা বরাবরই অস্বীকার করে আসছে মিয়ানমার। রাখাইনে নতুন করে গঠিত ইনফরমেশন টাস্কফোর্সের সদস্য এবং প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র দাবি করেন, এ নিয়ে তারা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন, তবে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশের কোনো আলামত তারা পাননি।

রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের জন্য দালালরা দায়ী : বিজিবি মহাপরিচালক

সীমান্তে কঠোর নিরাপত্তা থাকার পরও কিছু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। এ জন্য সীমান্তে এক শ্রেণির দালালকে দায়ী করেছেন বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন। মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের কারণে শুক্রবার সীমান্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে টেকনাফে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি।

বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, নতুন করে রোহিঙ্গারা যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সে জন্য সীমান্তে বিজিবি টহল আরো জোরদার করা হয়েছে। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন বিজিবি চট্টগ্রাম রিজিওনাল কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফরিদ হাসান, বিজিবি কক্সবাজার সেক্টরের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার কর্নেল আনিসুর রহমান, বিজিবি টেকনাফ-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুজার আল জাহিদ।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমটিআই/এমএইউ

Wordbridge School
Link copied!