• ঢাকা
  • শুক্রবার, ০৩ মে, ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১

চলচ্চিত্রের সুদিন ফিরবে বলে আনোয়ারার বিশ্বাস


বিনোদন প্রতিবেদক অক্টোবর ১০, ২০২১, ০১:০২ পিএম
চলচ্চিত্রের সুদিন ফিরবে বলে আনোয়ারার বিশ্বাস

ঢাকা : শুরুতে নৃত্যশিল্পী ছিলাম। পরে নায়িকা থেকে বোন-ভাবি, মা-চাচি-খালা সবই হয়েছি। নায়ক আজিম আমাকে নৃত্যশিল্পী হিসেবে ‘আযান’ ছবিতে সুযোগ করে দেন। সে সময় নাচের বাইরে অন্য কোনো বিষয়ে ধ্যান-ধারণা ছিল না। মনে পড়ে ‘নাচঘর’ ছবির কথা। শবনম, নার্গিস, মুর্শিদা ও মালেকের সঙ্গে নেচেছিলাম একটা গানে। আরো একটি গানের কথা মনে পড়ে। কাওয়ালি ছিল। ক্যামেরার দিকে তাকালে মনে হতো, আমাকে ফলো করেই চিত্রায়িত হচ্ছে। কখনো নায়িকা হব এমন চিন্তা মাথায়ই আসেনি।

তখনকার ছবিগুলোতে মামা, খালা, চাচা, চাচি, ভাই, ভাবি থেকে শুরু করে বন্ধু-বান্ধব অনেক চরিত্র থাকত। এতগুলো চরিত্রে অভিনয় করার মতো অভিনেতা-অভিনেত্রী কই? জহির রায়হানের ‘সংগম’ ছবির কথাই বলি। তিন নায়িকা। সুমিতা দেবী আর রোজী সামাদ (আফসারী) মিলে গেল; কিন্তু অন্যজনকে খুঁজে পাচ্ছেন না জহির সাহেব। কী করবেন! শুটিং এগিয়ে এসেছে। আমাকেই জোর করে দাঁড় করালেন ক্যামেরার সামনে, নায়িকা করে। মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা। জহির সাহেব স্পটে প্রবেশ করা মাত্র সব চুপচাপ। তিনি কথা বলতেন কম, কাজ করতেন ঝটপট।

‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ ছবির ‘ময়না বু’ চরিত্রটির কথা এখনও ভুলতে পারি না। আমজাদ ভাইয়ের কথা মনে পড়লে বুকটা হু হু করে ওঠে। আজকের আনোয়ারা হওয়ার পেছনে খান আতা, আমজাদ হোসেন, চাষী নজরুল ইসলাম সবার অবদান সমান। কিন্তু কেউ বেঁচে নেই। কে আমাকে এখন নতুন চরিত্র দেবে! চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে! আর নিজেকে প্রমাণ করতে পারব না মনে হয়। ‘ময়না বু’ চরিত্রটি সবাই পছন্দ করেছিল। মিছিল উঠেছিল, যদি ‘ময়না বু’ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার না পায়, তাহলে ঘরে ঘরে আগুন জ্বলবে। আমজাদ ভাই ‘সুন্দরী’ ছবিতে আমাকে মেথরানির চরিত্র দিয়েছিলেন। সেটিও দর্শক পছন্দ করেছিল। তখন তো একটা কথা বেশ শোনা যেত, যে ছবিতে রওশন জামিল, আনোয়ারা আর ববিতা থাকবে, সে ছবি সুপার-ডুপার হিট। হয়েছেও তা-ই। সাত শ’র মতো ছবিতে কাজ করেছি। কিছু চরিত্র তো কালজয়ী হয়ে আছে। কেউ ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’র কথা বলে, কেউ বলে ‘সুন্দরী’র কথা।

কেউ যদি বলে ‘দেবদাস’, কেউ আবার ‘শুভদা’। কারো কাছে ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’, কিংবা ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’ ছবির চরিত্রটি। কিন্তু আমার পক্ষে নির্দিষ্ট করে বলা অসম্ভব।

কিন্তু চলচ্চিত্রের সেই সোনালি দিন হারিয়ে গেছে অনেক আগে। আমাদের সময়ে ভালো শিল্পী, ভালো নির্মাতা সবই ছিল। এখনো আছে, সংখ্যাটা খুবই কম। এর মধ্যে করোনার হানায় সব ওলট-পালট হয়ে গেছে। তবে চলচ্চিত্রের সুদিন ফিরবে বলে আমার বিশ্বাস। আমাদের সময়ে সহকর্মীদের মধ্যে হূদ্যতাও ছিল চমৎকার। শাবানা ও শবনমের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা তো ভোলার নয়। প্রথম দিকের বেশির ভাগ ছবিতে আমার সহকর্মী ছিলেন শবনম। তাঁর সঙ্গে খুব সখ্য ছিল। নৃত্যশিল্পী তো কী হয়েছে! আমাকে দেখলেই শবনম গেয়ে উঠতেন, ‘বাবু সালাম বারে বার।’ খুশিতে জড়িয়ে ধরতেন।

একটা গল্প না বললেই নয়, তখন খুব স্টেজ শো হতো। আমাকে আর শবনমকে প্রায়ই ডাকা হতো। শবনম বলতেন, ‘আনু, তুই সালাম বারে বার গানটি গাইবি, আমি নাচব।’ সেকি বেসুরো গেয়েছি! তবু দর্শক মাতোয়ারা। ষাটের দশকের একটা সময়ে তো শবনম পাকিস্তান চলে গেলেন। আমিও একা হয়ে গেলাম। কয়েক বছর পর হঠাৎ একদিন ল্যান্ডফোনে কল এলো। ভাবলাম কোনো পরিচালক হয়তো ফোন দিয়েছেন। রিসিভ করতেই ‘বাবু সালাম বারে বার’ গেয়ে উঠল ওপাশ থেকে। আমি যেন বেহুঁশ হয়ে গেলাম। চিৎকার করে বলে উঠলাম, ‘আপনি দেশে এসেছেন!’ এই হলো শবনম।

আর শাবানার সঙ্গে যোগাযোগটা আজও অক্ষুণ্ন। যদিও তিনি দেশের বাইরে থাকেন। তথাপি আমাকে প্রায়ই ফোন দেন। ফোন দিয়েই একটি নির্দিষ্ট বকা দেন। ভালোবাসার এই বকাটাও অনেক আগে থেকেই আমাকে দিয়ে আসছেন। গালি শুনেই আমি বুঝতে পারি, এটা শাবানা। এরপর তো গল্পে দুজনে মজে যাই। সহকর্মীদের এই বন্ধনও যেন বর্তমানে ফিকে হয়ে আসছে।

বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে আমি কাজ বন্ধ রেখেছি। গত দেড় বছরে অনেক প্রস্তাব আসলেও করোনার কারণে সেগুলো ফিরিয়ে দিয়েছি। গত বছর শুধু নাদিয়া আফরিনের বিশেষ অনুরোধে তার পরিচালনায় ‘জননী জন্মভূমি’ টেলিফিল্মে অভিনয় করি। তবে এখন জীবনের পড়ন্ত বেরায় এসে আমার কোনো খেদ নেই। আমার দাদা জমিদার ছিলেন।

কিন্তু বাবা তাঁর কাছ থেকে কিছু নেননি। ঢাকায় কষ্ট করে সংসার চালিয়েছেন। বাবা সবসময় আমার মাঝে স্বপ্ন দেখতেন। আমাকে নাচ শিখিয়েছেন। অভিনয়ে উৎসাহ জুগিয়েছেন। তখন গ্রাম থেকে আমাদের বাড়ি এসে মাসের পর মাস যারা থেকেছেন, আজ তাদের গুলশানের মতো জায়গায় কয়েকটা করে বাড়ি। অথচ আমাদের সেসব নেই। মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়।

তবে সান্ত্বনা দিই এই ভেবে, একজন আনোয়ারা তো হতে পেরেছি। সারা দেশের মানুষ আমাকে চেনেন, আমাকে জাতীয় সম্পদ ভাবেন। আর তা ভাবেন বলেই তো বাংলাদেশের খবরও তাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমাকে স্মরণ করেছেন। তাদের আগামীর যাত্রা শুভ হোক।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!