বাবা হয়ে সন্তানের লাইফ সাপোর্ট খোলার অনুমতি দিলাম

  • নিউজ ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২০, ০৫:১২ পিএম
বাবা হয়ে সন্তানের লাইফ সাপোর্ট খোলার অনুমতি দিলাম

ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: আপনাদের কাছে বিনীত অনুরোধ দয়াকরে সবাই লেখাটা পড়বেন। আমার একমাত্র পুত্র সন্তান শাফি হোসেন চিশতী ইউশা জন্ম গ্রহণ করে ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০০৭ সালে। তারপর থেকে আমাদের পরিবারে আনন্দের আর সীমা নাই। ইউশা নিজের ছেলে বলে বলছি না, সে ছিল সম্পুর্ন ব্যাতিক্রম ধমী একটা বাচ্চা, নম্র, ভদ্র, শান্ত, বিনয়ী। যারা তার সাথে মিশেছেন, তাকে দেখেছেন তারা ভালো বলতে পারবেন।সে কাউকে তুই বা আপনি বলতো না, তুমি করে বলতো। 

সে কোন দিন কাউকে গালি দেয় নাই, সে গালি দেওয়া পারত না। ২০০৮ এর ২৫ ফেব্রুয়ারী থেকে, এই দিনটি আমাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য ছিল ঈদের দিন,বড় ও জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান করে পালন করতাম ওর জন্মদিন।কত আনন্দ। সারাবছর এই দিনটির জন্য আমরা অপেক্ষা করতাম। ইউশা ছিল অসম্ভব মেধাবী, স্কুলে সবসময় ১-৩ এর মধ্যে থাকতো।

সারাজীবনে আমি কখনো ওকে বকা দেই নাই, একবার স্কুলে পরীক্ষায় ৫ম হয়েছিল, তাকে বকা দিয়েছিলাম।সে কখনো কাঁদে নাই, সে কাদতে পারতো না, সেদিন আমার বকা খেয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, আর তার ২ চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পরছিল। বাবা আমি যদি জানতাম তুমি চলে যাবে,তাহলে তোমাকে সেদিন বকা দিতাম না। আমার ভাই বোন ২ টা ছিল তার বন্ধু, খেলার সাথী।

তারা স্কুলে পড়া অবস্থায় টিফিনের টাকা জমিয়ে তার জন্য খেলনা আনতো। প্রতি ২৫ ডিসেম্বর ক্রীসমাসে তার জন্য গিফট আনতো আমার ভাই বোন,আর বলতো শান্তাক্লজ আনছে,সে বিশ্বাস করতো। তার জন্মথেকেই ছিল এ্যাজমা,প্রচন্ড শ্বাস কষ্টের সময় সে নেবুলাইজ করার সময়েও তাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করতো বাবা তুমি কেমন আছে? ও বলতো আলহামদুলিল্লাহ। তাকে সবসময় কেমন আছো জিজ্ঞেস করলেই, বলতো আলহামদুলিল্লাহ। 

প্রতিদিন আমি অফিস থেকে ফেরার পর বাসায় ঢুকার সময় আমাকে বলতো, আসসালামু আলাইকুম। সে ১৮ পাড়া পবিত্র কোরআন মজিদ মুখস্ত করেছিল। এখন আর বাসায় আসলে কেউ সালাম দেয় না। সে শুধু আমার সন্তান ছিল না, ছিল বন্ধু। তার যত আবদার, চাহিদা, পাওয়া না পাওয়া, সব আমার কাছে।এখন আর কেউ কিছু চায় না। প্রতিদিন দুপুরে আমাকে ফোন করে বলতো আব্বু ভাত খাইছ? কি দিয়া খাইছ? 

এখন আর কেউ জিজ্ঞেস করে না। ও খেতে খুব ভালবাসতো, মাশাআল্লাহ তার শারীরিক বৃদ্ধি খুব বেশি ছিল, আমার গেঞ্জি, জুতা, পেন্ট তার হতো। ফ্লাইড চিকেন তার সবচেয়ে প্রিয় ছিল। ওকে নিয়ে আমাদের কত স্বপ্ন, আশা, কত ভালবাসা, আনন্দ। 

২০১৭ সালে সে পিএসসি পরীক্ষাথী ছিল, সবগুলো টেস্ট পরীক্ষায় সে ৯০ উপরে নাম্বার পেয়েছিল। ২০১৭ সেপ্টেম্বর এ ছিল কোরবানির ঈদ, ঈদের পরের দিন আমার নানীর বাড়ী কুমিল্লা গিয়েছিলাম। সারাদিন কত আনন্দ, নানা পদের মুখরোচক খাবার। পরের দিন ইউশার জ্বর আসে, ১দিন পর এপোলো হাসপাতালে তাকে ডাক্তার দেখাই। ডাক্তার তাকে ভতি না করে মারাত্মক ভুল করে। তার হয়েছিল ডেঙ্গু ডাক্তার তা ধরতে পারে নাই। তাকে ঔষধ দিয়ে ছেড়ে দেয়। 

৭ তারিখ রাতে তার শরীর প্রচন্ড খারাপ করে, শেষ বারের মত তার মার হাতে ফ্লাইড রাইস আর চিকেন খায় সামান্য। আমার আম্মু ও ওয়াইফ আমাকে ফোন দিলে আমি দ্রুত অফিস থেকে বাসায় আসি, এসেই ওকে নিয়ে যাই হাসপাতালে, ওকে শেষবারের মত আমার আম্মু ৪ টা লাল আঈুর খাওয়ায়। আমার আম্মু আর ওয়াইফ বাসায় গিয়েছিল ওর জন্য কাপড় আনতে।

এ সময় আমি ওর পাশে এশার নামাজ পড়ি, হঠাৎ তার যেন কি হয়, সে আমার হাত ধরে কি যেন বলতে চাইছিল, তখন তার ডেঈু শক হয়েছিল,আমরা বুঝতে পারি নাই। সে কিছু বলতে পারছিলনা, আমি চিৎকার দিয়ে আল্লাহ কে ডাকি, ওর আম্মু আর দাদী আসে, ওকে আমাদের সিএনজি ড্রাইভার জসিম সহ দ্রুত ইউনাইটেড হসপিটালের আইসিইউ তে নিয়ে যাই।রাত ২.৩০ টায় ওর অবস্থার অবনতি হয়, তাকে লাইফ সাপোর্ট দেয়, আমি তখন আইসিইউর ডাক্তার কে তার সাথে থাকার জন্য অনুরোধ করি, ওনারা বলেন সম্ভব না। 

আমি তাদের পায়ে ধরি। তারা আমাকে থাকতে দেয়। রাত ৪.৩০ এ তার সব কিছু ফল্ট করে, তখন আমি, আমার ওয়াইফ, আমার ছোট ভাই, তার ওয়াইফ সবাই আইসিইউর ভিতরে ওর পাশে দাড়িয়ে থাকি, তার গলা ফুটো করে পাইপ, মুখে পাইপ, বারবার বুকে প্রচন্ড শক্তি দিয়ে পাম করছে তার হাডরেট পাওয়া যাচ্ছে না। ওফফ আল্লাহ কি ভয়ানক কষ্ট, চোখের সামনে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় মানুষটির কষ্ট ও চলে যাওয়ার মুহূর্ত। 

আমাদের ২ চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরছে আর আমরা সবাই মহান আল্লাহ পাক কে ডাকছি, কিন্তু আল্লাহ পাক আমাদের ডাক শুনতে পেলেন না। ডাক্তাররা পাম করতে করতে ক্লান্ত হয়ে আমাকে বললেন ভাই রে কোন আশা নেই, বড় মানুষ হলে আমরা ফেলে রাখতাম, কিন্তু এই ফুটফুটে সুন্দর, নিস্পাপ বাচ্চাটাকে আর কষ্ট দিতে চাই না। ডাক্তার বললো আপনি অনুমতি দিলে আমরা লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলতে চাই।

 

আমি পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষের মতো লাইফ সাপোর্ট খুলার অনুমতি দিলাম। আমার বাবার নিথর, নিস্পার্ন দেহটা আইসিইউর বেডে, আমি তার কাছে গেলাম, তাকে বুকে জড়িয়ে নিলাম, কি নরম তুলতুলে দেহটা, হায় আল্লাহ, তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে পাপীকেও এমন শাস্তি দিও না, পৃথিবীতে এর চেয়ে কষ্ট আর কারো নাই, যার এই রকম ১০ বছরের সন্তান হারিয়েছে সেই বুঝবে। আমার বাবাকে তারা সাদাকাপড়ে জড়িয়ে দিল, ১০ বছর ৮ মাস বয়সে ৫ম শ্রেনীতে পড়া অবস্থায় পৃথিবীর মায়া, বাবা, মা আত্মীয় স্বজন সব ছেড়ে, মহান আল্লাহ পাক এর হুকুমে সে, চলে গেল। 

আমি পৃথিবীর কত বড় হতভাগা আমার বাবাকে আমি কবরে শুইয়েছি ২০০৮ সালের নভেম্বর এর ১২ তারিখ আর সেই আমি ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ শুক্রবার জুম্মার নামাজের পড় নিজ হাতে আমার পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় মানুষ আমার একমাত্র সন্তান ইউশাকে কবরে শুয়ালাম। এ যে আমার জন্য কতটা কষ্টের, কি যে অনুভূতি আপনারা কেউ বুঝবেন না। আমি নি:স্ব হয়ে গেলাম, আমার সব শেষ হয়ে গেল। মহান আল্লাহ পাক আমাকে অনেক সম্মান, ক্ষমতা দিয়েছেন, আলহামদুলিল্লাহ। 

কিন্তু নিয়েছেন তার চেয়ে অনেক বেশী। তারপর ও আমি আমার কলিজার টুকরো, যাকে রাতে জড়িয়ে ধরে না শুলে ঘুমাতে পারতাম না, তাকে ছাড়া বেঁচে আছি। খাচ্ছি, দাচ্ছি, ঘুমাচ্ছি, অফিস, কাজ, সংসার সব করছি। আল্লাহ আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা দিয়েছেন, সে পরীক্ষা দিচ্ছি। অনেকের সাথে হঠাৎ খারাপ ব্যবহার করি, অফিস কলিগদের বকাঝকা দেই, এলোমেলো আচার-আচরণ করি।

আপনারা আমাকে মাফ করে দিবেন, আমি যে বেচে আছি এটাই কি বেশী না? এখন আর টাকা- পয়সা, ক্ষমতা, সম্মান, চাকরি, ক্যারিয়ার, রাজনীতি কিছুই ভালো লাগে না। কোন কিছুর প্রতি আর আগ্রহ নেই, কি হবে এগুলো দিয়ে? কার জন্য এগুলো?

যে কয়দিন হায়াত আছে কোন ভাবে সময়টা পার করতে চাই। আমি মহান আল্লাহ পাক এর কাছে তওবা করেছি, আপনারাও আমাকে মাফ করে দিবেন। আমি কোন রকম বাকী জীবনটা কাটাতে চাই। আমার সকল ভুলগুলো, খারাপ ব্যবহার গুলো, বকাঝকা গুলো মাফ করে দিবেন। আমি আমার আমল নিয়ে যেতে চাই, কারণ পবিত্র কোরআন হাদিস মতে আমার ইউশা জান্নাতের পাখী, আমি আমার ইউশার সাথে জান্নাতে দেখা করতে চাই, তার সাথে থাকতে চাই।হে মহান আল্লাহ পাক আমাকে আপনি মাফ করে দিন। 

আজ যদি ইউশা বেচে থাকতো তার বয়স হতো ১৩ বছর, সে ক্লাস ৮ এ পড়তো। কেমন হতো ইউশা? কত লম্বা হতো?, দেখতে কার মতো হতো? ওকি আগের মতো মোটাসোটা থাকতো? কেউ কি আমার এই প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে পারবেন?

এই লেখা যখন লিখছি তখন আমার বুক ফেটে যাচ্ছে,কান্নায় নিজেকে ঠিক রাখতে পারছিলাম না। কষ্ট এযে কি কষ্ট তা বলে বোঝানো সম্ভব না।সবাই কে পড়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। দয়াকরে লাইক না দিয়ে,আমার ছেলে ইউশার জন্য দোয়া করবেন সে যেনে কবরের দেশে শান্তিতে থাকে,জান্নাতবাসী হয়।

সোনালীনিউজ/এমএএইচ

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Link copied!