বিএনপি-জামায়াতের আসন বণ্টনে জটিলতা, জরিপে পাল্টে গেল সমীকরণ

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৬, ২০২৫, ০৪:০৬ পিএম
বিএনপি-জামায়াতের আসন বণ্টনে জটিলতা, জরিপে পাল্টে গেল সমীকরণ

ফাইল ছবি

আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সামনে রেখে কৌশলে বড় পরিবর্তন এনেছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। মিত্র দলগুলোর মধ্যে আগে যে পরিমাণ আসন ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দুই দলই দিয়েছিল, নির্বাচনের মাঠ আঁচ করতে গিয়েই সেই অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে এসেছে তারা। বিএনপি যেখানে আগে ৫০টি আসনের কথা বলেছিল, এখন প্রাথমিকভাবে মাত্র ১৩টি আসন নিশ্চিত করেছে। অন্যদিকে জামায়াত ১০০টি আসনের প্রতিশ্রুতি দিলেও, এখন বলছে আগের ঘোষণা আনুষ্ঠানিক ছিল না।

আগামী নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতে পারে-এমন আভাস পেয়ে বিএনপি ও জামায়াত দু’দলই নিজেদের কৌশল বদলেছে বলে জানিয়েছেন জ্যেষ্ঠ নেতারা। তপশিল ঘোষণার আগ মুহূর্তে আসন বণ্টন নিয়ে দলগুলোর মধ্যে টানাপোড়েন বাড়ছে। এরই মধ্যে ক্ষুব্ধ হয়ে জোট ছেড়ে গেছে বিএনপির কয়েকটি মিত্র দল। আরও কয়েকটি দল সম্পর্ক ত্যাগ করতে পারে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছে। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এ অবস্থায় ক্ষুব্ধ দলগুলোর নতুন গন্তব্য হতে পারে জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোট। তবে জামায়াতও অবস্থান পরিবর্তন করায় ছোট দলগুলোর জন্য পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।

জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে তরুণ নেতৃত্বে থাকা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) কোন জোটে যাবে-তা এখনও স্পষ্ট নয়। ঐক্যমত্য কমিশনের আলোচনায় ছাত্র নেতৃত্বকে বিএনপি ৩০টি আসন ছাড়ার কথা বললেও এখন এনসিপিকে আটটির বেশি দিতে রাজি নয়। জামায়াতও অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় ৬০-৭০ আসনের কথা বললেও পরে তা কমিয়ে ৩০-৩৫ এ নামিয়েছে।

কাঙ্ক্ষিত আসন না পেয়ে গতকাল বিএনপির ১৮ বছরের পুরোনো শরিক লেবার পার্টি জোট ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছে। নাগরিক ঐক্য ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টিও প্রকাশ্যে ক্ষোভ জানিয়েছে। এর আগে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন গণতন্ত্র মঞ্চ ছেড়ে চলে গেছে।

গত জানুয়ারি থেকে ২৯৯ আসনের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করে জামায়াত। পরে ইসলামী আন্দোলনসহ আট দলের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতার উদ্যোগ নেয় তারা। আরও কয়েকটি দল যুক্ত হতে পারে। তবে ইসলামী আন্দোলন ইতোমধ্যে ৩০০ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এর সহযোগী বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসও শখানেক আসনে প্রার্থী দিয়েছে।

এদিকে বিএনপি ২৭২ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। দলের ভেতরে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকায় ১৩টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়নি। মিত্রদের জন্য ১৩টি আসন রাখা হয়েছে। বাকি দুটি নিয়ে আলোচনা চলছে।

৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগবিহীন নির্বাচনে বিএনপির একতরফা জয়ের সম্ভাবনা দেখে দলটি যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের নিয়ে সরকার গঠনের ঘোষণা দিয়েছিল। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন তখন বলেছিলেন, শরিকদের ৫০টি আসন দেওয়া হবে। এখন দলের নেতারা বলছেন, সেই সময়কার পরিস্থিতি ছিল আলাদা। বর্তমানে ভোটের মাঠে সে বাস্তবতা নেই, ফলে নতুন হিসাব করতে হচ্ছে।

মিত্র দলগুলো বিএনপির অবস্থান পরিবর্তনে হতাশ। নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, আগে বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশ আসন জেতার কথা বলত, এখন তারা অর্ধেক আসন নিয়েও নিশ্চিত নয়। জোট ছেড়ে যাওয়া লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, গত দেড় বছরে বিএনপির কার্যক্রমে আস্থা কমেছে। একা ১৫১ আসনও পাবে কিনা সংশয় রয়েছে।

জরিপ নিয়েও টানাপোড়েন বাড়ছে। শরিক দলের নেতারা বলছেন, বিএনপির ভেতরকার কোন্দল ও অভিযোগের সুযোগে জামায়াত এখন জোট রাজনীতিতে সমান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে চাইছে। আইআরআই–এর জরিপেও এর প্রতিফলন দেখা গেছে-৩৩ শতাংশ ভোটার বিএনপিকে এবং ২৯ শতাংশ জামায়াতকে ভোট দিতে পারে। জামায়াত অবশ্য দাবি করছে, তাদের সমর্থন আরও বেশি।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কয়েক মাস ধরেই নেতাকর্মীদের সতর্ক করে আসছেন যে নির্বাচন কঠিন হবে। দলের জ্যেষ্ঠ নেতারাও এখন একই কথা বলছেন। আর আরপিও সংশোধনের কারণে মিত্রদের আসন ছাড়া আরও কঠিন হয়ে গেছে। নিজেদের প্রতীকে নির্বাচন করে জেতার সম্ভাবনা কম হওয়ায় ছোট দলগুলোকে বেশি আসন দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছে বিএনপি।

দলের নেতারা জানান, শরিকদের ছেড়ে আসন হারানোর ঝুঁকি নেওয়া হবে না। তবে মূল্যায়ন ও আলোচনার প্রক্রিয়া এখনো শেষ হয়নি।

জামায়াত দলীয়ভাবে তিনটি জরিপ করেছে। সর্বশেষ জরিপ নভেম্বর মাসে ২০১টি আসনে করা হয়েছে। জরিপে দেখা গেছে—অতীতে যেখানে পাঁচ হাজার ভোটও পেত না, এখন সেখানে জয়ের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। তাই নির্বিচারে আসন ছাড়ার সুযোগ নেই। আসন সমঝোতা হবে জরিপের ফল ও মাঠের বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে।

বিএনপির শরিকরা অন্তত ২২২টি আসনে প্রার্থীর তালিকা দিয়েছিল। বিএনপির প্রাথমিক তালিকায় শরিকদের জন্য যেসব আসন রাখা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬, ঢাকা-১৭, পিরোজপুর-১, ঢাকা-১৩, পটুয়াখালী-৩, ঝিনাইদহ-২, বগুড়া-২, লক্ষ্মীপুর-১, লক্ষ্মীপুর-৪, চট্টগ্রাম-১৪, কুমিল্লা-৭, সিলেট-৫ ও নারায়ণগঞ্জ-৪। এর মধ্যে জাপা ও বিএলডিপির নিবন্ধন না থাকায় তারা বিএনপির প্রতীকে নির্বাচন করবে। বাস্তবে বিএনপি ছাড়ছে ১১টি আসন।

জমিয়তের জন্য নীলফামারী-১ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসন নিয়েও আলোচনা চলছে। সম্মানজনক আসন না পেলে জোট ছাড়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে দলটি।

গণ অধিকার পরিষদ ২৫টি আসনের তালিকা দিলেও এখন পর্যন্ত দুইটি আসনই নিশ্চিত হচ্ছে। তারা বলছে, আলোচনার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানো হবে।

বিএনপির মিত্র হিসেবে এখনো আছে প্রায় ৫৭টি দল ও জোট। তবে বেশির ভাগ দলেরই নিবন্ধন নেই। অনেকে বিএনপি তালিকা চাওয়ার পর নিজেদের দাবি জানিয়েছিল-এলডিপি ৪০, ১২-দলীয় জোট ২১, গণফোরাম ১৫, বিজেপি ৫, লেবার পার্টি ৬, এনডিএম ১০টি আসন চেয়েছিল।

বৃহস্পতিবার বিএনপি জানিয়েছে, অচিরেই বাকি ২৮টি আসনের ঘোষণা দেওয়া হবে। তবে মিত্রদের অভিযোগ, আগে যেসব আসনে তাদের সহায়তার চিঠি দেওয়া হয়েছিল, এখন সেসব আসনেও বিএনপি প্রার্থী দিয়েছে-যা তারা বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখছে।

অন্যদিকে জামায়াত বলছে, ছোট দলগুলোর জন্য তাদের দরজা খোলা। ৮ ডিসেম্বর থেকে আসন নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হবে। জরিপ, মাঠের অবস্থা ও রাজনৈতিক বাস্তবতার ওপর নির্ভর করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

এসএইচ 

Link copied!