ষড়যন্ত্রের আশ্রয়ে প্রত্যাবর্তনের খোঁজে আওয়ামী লীগ

  • নিউজ ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: আগস্ট ৭, ২০২৫, ১১:০৬ এএম
ষড়যন্ত্রের আশ্রয়ে প্রত্যাবর্তনের খোঁজে আওয়ামী লীগ

ঢাকা: ক্ষমতা হারানোর পর এক বছর পেরিয়ে গেলেও আওয়ামী লীগ এখনও সরকার পতনের ঘটনাকে ‘দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার কৌশল নিচ্ছে। দলটির মতে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকে পরিকল্পিতভাবে উৎখাত করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগ এখন অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতাকেও রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে চাইছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, দুর্বল প্রশাসনসহ নানা দিক থেকে এই সরকারের ব্যর্থতা জনগণের মাঝে আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতি তৈরি করছে বলে দলের অনেক নেতাই মনে করেন।

তবে জুলাই-অগাস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দমন-পীড়ন ও হত্যাকাণ্ডের জন্য এখনো দলটির পক্ষ থেকে কোনো অনুশোচনা বা দুঃখ প্রকাশ দেখা যায়নি। বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গনে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের শাসনে ক্ষমতার অহংকারে আওয়ামী লীগ নিজেকে জনবিচ্ছিন্ন করে তুলেছিল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়।

ক্ষমতা হারানোর আগে পর্যন্ত দমননীতি ও একক কর্তৃত্বের কারণে আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখন বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি এবং অন্তর্বর্তী সরকার সবাই আওয়ামী বিরোধী অবস্থানে রয়েছে।

দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের বড় একটি অংশ বর্তমানে দেশত্যাগ করে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে। অনেক নেতা গ্রেফতার হয়ে বিচারের মুখোমুখি, অন্যরা আত্মগোপনে। ফলে মাঠপর্যায়ে সংগঠনের কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে পড়েছে।

এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠছে—ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও অন্যদের ব্যর্থতার ওপর ভরসা করে আওয়ামী লীগ আদৌ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি না?

বিশ্লেষকরা বলছেন, ভুল স্বীকার না করে, কিংবা জনগণের আস্থার সংকট কাটানোর চেষ্টা ছাড়া রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ সীমিত।

তবে দলটির অভ্যন্তরীণ সূত্র জানিয়েছে, এখনও শেখ হাসিনার হাতে দলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। তার নেতৃত্বেই ভার্চুয়ালি যোগাযোগ এবং সংগঠনের পুনর্গঠনের চেষ্টা চলছে।

এ ছাড়া তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এখন দলের রাজনীতিতে আরও সক্রিয় হয়েছেন। দলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় তাকেই সামনে রাখা হচ্ছে।

অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে। আওয়ামী লীগ এবং এর মিত্রদের অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ না থাকায় দলটি আন্তর্জাতিক মহলে বিষয়টি উত্থাপন করছে।

তাদের মতে, আওয়ামী লীগের একটি বড় ভোটব্যাংক আছে—তাদের বাদ দিয়ে নির্বাচন হলে সেটি গ্রহণযোগ্য হবে না। তবে সামাজিক মাধ্যমে দলটি যতটা সক্রিয়, মাঠের রাজনীতিতে ততটাই নিষ্ক্রিয়।

তৃণমূলের অনেক নেতা-কর্মী এখনো আত্মগোপনে। যদিও তারা বিশ্বাস করেন, সরকার পতনে ষড়যন্ত্র হয়েছিল।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দলীয় ভুল ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় এড়াতেই আওয়ামী লীগ ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে আঁকড়ে ধরেছে।

একইসঙ্গে বলা হয়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভুল স্বীকারের সংস্কৃতি নেই—এমনকি জামায়াত ইসলামীর মতো দলও যুদ্ধাপরাধের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেনি।

দলটির নেতারা মনে করছেন, এখন দুঃখ প্রকাশ করলে নেতাকর্মীদের মনোবলে চিড় ধরবে। যদিও দলীয় অভ্যন্তরে আন্দোলন দমনে গৃহীত পদক্ষেপ নিয়ে সমালোচনা হয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদের মতে, “ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে, কোনো অনুশোচনা না দেখিয়ে আওয়ামী লীগ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারবে না। বাস্তবতা বিবেচনায় কৌশল নির্ধারণ জরুরি।”

অন্যের ব্যর্থতা আওয়ামী লীগের পক্ষে কতটা সহায়ক হবে—এ নিয়েও প্রশ্ন আছে। বিশ্লেষকেরা বলেন, শুধু অন্যের ব্যর্থতার ওপর নির্ভর করে রাজনীতিতে ফেরা সম্ভব নয়।

কারণ, শাসনামলে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলগুলোর কণ্ঠরোধ করেছে, নির্বাচনি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে, দলীয়করণ করেছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান।

এছাড়া দলে ঢুকেছিল অনেক সুবিধাবাদী। সরকার পতনের পর অনেকে ছাত্রলীগ ছেড়ে ইসলামী ছাত্র শিবিরে নাম লেখায়।

তবে পালিয়ে থাকা অবস্থায়ও শেখ হাসিনা ভারতে থেকে ভার্চুয়ালি দল চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে তিনি যোগাযোগ রক্ষা করছেন।

যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রিত দলের মুখপাত্র মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেন, “শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত আমাদের যোগাযোগ বেড়েছে, দল আরও সংগঠিত।”

গোপালগঞ্জে এনসিপির কর্মসূচিকে ঘিরে সহিংসতায় আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের সাধারণ মানুষের সমর্থন পাওয়ায় দলের মনোবল বেড়েছে বলে দাবি করা হয়।

তবে সেই ঘটনার পর দলটিকে আবারও কঠোর ক্র্যাকডাউনের মুখে পড়তে হয়—১৫ হাজারের বেশি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়।

এখন দলটি শক্তি ক্ষয় না করে সংগঠিত হওয়ার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন পেতে সক্রিয়।

দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ও এখন বেদখল হয়ে আছে।

শেখ হাসিনা সম্প্রতি ভারতে তার সঙ্গে থাকা কয়েকজন নেতার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। দলটির অভ্যন্তরীণ সূত্র জানায়, তিনি ধারাবাহিকভাবে নির্বাহী কমিটির সঙ্গেও বৈঠক করবেন।

তার ছেলে জয়ও এখন আন্তর্জাতিক মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন এবং দল গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছেন। তবে দলের নেতৃত্ব শেখ হাসিনার হাতেই থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলেন, শেখ পরিবার ছাড়া আওয়ামী লীগে ভাঙন দেখা দিতে পারে—এ বিবেচনাও হয়তো দলটির কৌশলের পেছনে কাজ করছে।

এখন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা চলমান। দলটির নিবন্ধন স্থগিত, নৌকা প্রতীক বাতিল করা হয়েছে।

স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নিলেও সরকারি ও বিরোধী দলের বাধার মুখে পড়বে—এমন আশঙ্কা দলটির নেতাদের মধ্যে রয়েছে।

তাই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমর্থন পেতে চেষ্টা চালাচ্ছে আওয়ামী লীগ।

বিশ্লেষকদের মতে, দলটি যদি ভুলের দায় স্বীকার না করে, মানুষের ক্ষোভ দূর না করে, তাহলে রাজনীতিতে ফিরে আসা কঠিন হয়ে পড়বে।

সূত্র: বিবিসি

ওএফ

Link copied!