• ঢাকা
  • শুক্রবার, ০৩ মে, ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১
আজ বিশ্ব নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস

নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতে বড় বাধা অস্ত্রোপচার বাণিজ্য


বিশেষ প্রতিনিধি মে ২৮, ২০১৮, ১১:২৬ পিএম
নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতে বড় বাধা অস্ত্রোপচার বাণিজ্য

ঢাকা : স্বাভাবিকের তুলনায় অপ্রয়োজনে অস্ত্রোপচারের (সিজার) মাধ্যমে সন্তান জন্মানোর হার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। প্রচলিত আইন, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা ও বিদেশি সংস্থার পরামর্শ- কোনো কিছুই মানা হচ্ছে না। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশও অধিকাংশ হাসপাতালে উপেক্ষিত হচ্ছে। বাড়তি টাকা কামানোর জন্য সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক ও কর্মকর্তারা মিলে দেশজুড়ে চালিয়ে যাচ্ছেন অস্ত্রোপচার বাণিজ্য। ভয়ানক এই বাণিজ্য মা ও শিশুকে ভবিষ্যতে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। এভাবে সন্তান জন্মানোর পর মা ও সন্তান দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কার কথা নীতিমালা অনুযায়ী চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচারের আগে অভিভাবকদের জানাচ্ছেন না। অনেক হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের আগে প্রসূতির দরকারি পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা হয় না। ভুল চিকিৎসায় প্রসূতির জরায়ু কেটে ফেলা ও মৃত্যুর ঘটনাও দিন দিন বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, গর্ভধারণজনিত জটিলতা ও প্রসবকালে বা প্রসবের পর ৪২ দিনের মধ্যে কোনো প্রসূতির মৃত্যু হলে তাকে মাতৃমৃত্যু বলা হয়। এর পরের সময়কে হিসাবে ধরা হয় না। ৪২ দিন পর মাতৃমৃত্যুর তথ্য সরকারের কাছে থাকে না। এ হিসাবে মাতৃস্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম শুধু সন্তান প্রসবকেন্দ্রিক সেবার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের ৪২ দিনের পরও মায়েরা অস্ত্রোপচারজনিত মৃত্যু ও ভুল চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন জটিলতা ও স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়েন, এ বিষয়ে হিসাব করা হচ্ছে না। এ হিসাব করলে দেশে নিরাপদ মাতৃত্বের বিষয়ে প্রকৃত ধারণা পাওয়া যেত। নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতে অন্যতম বাধা চিকিৎসকদের অস্ত্রোপচার বাণিজ্য বলেও বিশেষজ্ঞদের মত।  

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশে মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ ও জনসচেতনতার ফলে মাতৃমৃত্যু আগের তুলনায় কমে আসার কথা বিশেষজ্ঞরাও বলেন। তবে বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী এক শ্রেণির চিকিৎসক ও ব্যবসায়ীর বাণিজ্যকেন্দ্রিক মানসিকতা। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জবাবদিহির অভাব ও যথাযথ ব্যবস্থা না থাকাকেও বিশেষজ্ঞরা দায়ী করেন। হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসকদের খেয়ালখুশি ও ইচ্ছেমতো চলছে অস্ত্রোপচার। এ পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলে মনে করেন দেশি ও বিদেশি বিশেষজ্ঞরা।  

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী জাহেদ মালেক এ প্রসঙ্গে রোববার (২৭ মে) বলেন, ‘রোগীর শারীরিক অবস্থা যাচাই না করে অস্ত্রোপচার করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চিকিৎসককে জরিমানাসহ হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হবে।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে শতকরা ৯০ ভাগ অস্ত্রোপচার একেবারেই অপ্রয়োজনীয়।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্বাভাবিক উপায়ে যে নারীর সন্তান জন্ম দেওয়া সম্ভব, তারা হাসপাতালে এলে শতকরা ৯০ জনই অস্ত্রোপচারের শিকার হচ্ছেন। টাকার লোভে তাদেরকে অস্ত্রোপচারের বলি হতে হচ্ছে। চিকিৎসক ও হাসপাতাল মালিকদের এ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় দিনে দিনে তা লাগামহীন হয়ে উঠছে। সরকারি হাসপাতালের তুলনায় বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার বেশি হচ্ছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সবশেষ হিসাব বলছে, দেশের সরকারি হাসপাতালে শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ শিশু অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম নেয়। বেসরকারি হাসপাতালে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ শিশুর জন্ম হয় অস্ত্রোপচারে। বেসরকারি হাসপাতালে এ হার ৮০ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে বলে গতকাল স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেকও স্বীকার করেন। বিডিএইচএসের ২০১৪ সালের জরিপ অনুযায়ী, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ১০টির মধ্যে ৬টি শিশুরই জন্ম হচ্ছে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে। ৮০ শতাংশ অস্ত্রোপচার হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ মতে, যেকোনো দেশে অস্ত্রোপচারে প্রসবের হার হওয়া উচিত ১০ থেকে ১৫ ভাগ। ২০১৬ সালের হিসাবেও এ দেশে তা ছিল শতকরা ৩১ ভাগ। দিনে দিনে পরিস্থিতি ভয়ানক হয়ে উঠছে। এ অবস্থায় সোমবার (২৮ মে) পালন হবে বিশ্ব নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস।

গত বছরের এক হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন গড়ে ১৪ মায়ের প্রসবজনিত জটিলতায় মৃত্যু হয়। এ হিসাবে বছরে ৫ হাজার ১১০ মা প্রসবজনিত জটিলতায় মারা যাচ্ছেন। ২০১৭ সালে স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রকাশিত হেলথ বুলেটিন মতে, এক বছরে সরকারি চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রে মোট ৪ হাজার ৮৯ মায়ের মৃত্যু হয়। আবার অদক্ষ দাইদের হাতে সন্তান জন্ম দিতে গিয়েও অনেক প্রসূতি মারা যাচ্ছেন। শতকরা ৪২ শতাংশ প্রসব দক্ষ দাইদের মাধ্যমে হচ্ছে। ৫৮ শতাংশ প্রসব বাড়িতে অপ্রশিক্ষিত দাইদের হাতে হচ্ছে।

স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে এ প্রসঙ্গে জানান, ‘প্রসবকালীন মাতৃমৃত্যু কমাতে তিন হাজার ধাত্রীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণ শেষে তাদের বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়োগ দেওয়া হবে।’

হাসপাতাল ঘুরে জানা যায়, স্বাভাবিকের চেয়ে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিলে চিকিৎসক ও হাসপাতাল অনেক বেশি টাকা পায়। তখন অস্ত্রোপচারের খরচ যোগ হয়। ওষুধও লাগে বেশি। প্রসূতিকে বেশিদিন হাসপাতালে থাকতে হয়। অস্ত্রোপচারের পর প্রসূতির শরীরে অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের জীবাণুর আক্রমণ দেখা দেয়। তখন আরো বেশি ওষুধ লাগে, রোগীকে আরো বেশিদিন হাসপাতালে থাকতে হয়।

স্বাভাবিক প্রসব হলে প্রসূতিকে বড়জোর দুই থেকে তিন দিন হাসপাতালে থাকতে হয়। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে হলে কমপক্ষে এক সপ্তাহ থাকতে হয়। ক্ষেত্রবিশেষে আরো বেশিও থাকতে হয়। এতে বাণিজ্য রমরমা হয়ে ওঠে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!