• ঢাকা
  • বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

চোখের সামনেই পুড়ছিল সন্তান, করুণ পরিণতি দেখলেন বাবা-মা


নিজস্ব প্রতিবেদক জানুয়ারি ৩, ২০২০, ১০:১১ এএম
চোখের সামনেই পুড়ছিল সন্তান, করুণ পরিণতি দেখলেন বাবা-মা

ঢাকা: সন্তানের শরীরের চারপাশে আগুনের কুণ্ডলী। বাঁচার জন্য বারবার আকুতি জানিয়ে বলছিলেন, 'আম্মু আগুন লেগেছে। আমাকে বের করো। বাবা আমাকে বের করো। আমাকে বাঁচাও।' ধীরে ধীরে আগুনে সন্তানের স্নেহমাখা মুখ, শরীর ও হাত পুড়ে যাচ্ছিল। ১০-১৫ মিনিট 'বাঁচাও বাঁচাও' চিৎকার করার একপর্যায়ে সন্তানের কণ্ঠ থেমে যায়। সন্তানকে মা-বাবা বলছিলেন, 'বাবা জামা-কাপড় খুলে ফেল। গেঞ্জি খুলে ফেল।' এতটুকু বলতে পারছিলেন তারা। একটু পরই ফ্ল্যাটের ব্যালকনির লোহার গ্রিল ধরে দাঁড়ানো সন্তানের শরীর নিস্তেজ হয়ে কুঁচকে পড়ছিল। হাতের প্রায় নাগালে অন্য ব্যালকনিতে সন্তানের এমন করুণ পরিণতি দেখে কী করে সহ্য করবেন মা-বাবা! নিরুপায় হয়ে তাদের হাহাকার ও আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠছিল আশপাশের পরিবেশ। কিন্তু সন্তানকে বাঁচাতে তাদের করার ছিল না কিছুই। ফ্ল্যাটের দরজা ভেতর থেকে অটো লকের মাধ্যমে বন্ধ থাকায় প্রাণপণ চেষ্টা করেও বাইরে থেকে তা কেউ খুলতে পারছিল না। তাই সন্তান যে ব্যালকনিতে পুড়ছিল, অদূরে একই ফ্ল্যাটের পাশের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দুঃসহ সেই দৃশ্যপট দেখতে হচ্ছিল তাদের। একপর্যায়ে চোখের সামনেই সন্তান চলে গেল না ফেরার দেশে।

এমন মর্মন্তুদ আর হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারী) রাজধানীর আফতাবনগরে। সেখানে একটি ফ্ল্যাটে আগুন ধরে যায়। আগুন থেকে বাঁচতে ব্যালকনিতে চলে আসেন ২৬ বছরের যুবক স্বপ্নীল আহমেদ পিয়াস। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মা-বাবা, প্রতিবেশীদের চোখের সামনেই পুড়ে অঙ্গার স্বপ্নীল। অনেকে সেই মর্মন্তুদ ঘটনার ভিডিও করছিল। একমাত্র সন্তানের এমন অকালমৃত্যুতে শোকে পাথর তার বাবা মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নু ও মা শাহিনা হোসেন পল্লবী। স্বপ্নীলকে ঘিরে তাদের স্বপ্নও পুড়ে খানখান।

স্বপ্নীলের বাবা নান্নু বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ক্র্যাব) সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং গ্লোবাল টিভির অপরাধ ও ইনভেস্টিগেশন সেলের প্রধান। স্বপ্নীলের এমন মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে সংবাদকর্মী ও পরিচিতজনদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে অনেকে হাসপাতাল ও বাসায় ছুটে যান।

বৃহস্পতিবার ভোর ৫টা ১৫ মিনিটে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। এরপর তাদের পাঁচটি ইউনিট সাড়ে ৫টার দিকে দুর্ঘটনাস্থল আফতাবনগর বি ব্লকের তিন নম্বর সড়কের ৪৪-৪৬ নম্বর ভবনের ১০/এ নম্বর ফ্ল্যাটে ছুটে যায়। সেখানে গিয়ে তারা দেখে, ততক্ষণে স্বপ্নীল অঙ্গার হয়ে গেছে। পৌনে ৬টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। পরে বাসার দক্ষিণ দিকের বারান্দা থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায় পুলিশ। হাসপাতাল থেকে দুপুর ১টায় আফতাবনগরের বাসায় নেওয়া হয় তারপর। সেখানে জানাজা শেষে নানার গ্রামের বাড়ি যশোরের বাঘারপাড়া থানার ভাঙ্গুরায় নেওয়া হয়। ফায়ার সার্ভিস বলছে, প্ল্যাগ লাগানো ল্যাপটপ, এসির সংযোগস্থল বা কক্ষের বৈদ্যুতিক লাইনে শর্টসার্কিট থেকেও আগুন লাগতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত তাদের কাছে জোরালোভাবে মনে হয়েছে, শর্টসার্কিট থেকেই আগুনের সূত্রপাত।

স্বপ্নীল একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ শেষে ব্যবসা করছিলেন। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম প্রোভেন্স লিমিটেড। সেখানে সিসি ক্যামেরাসহ ইলেকট্রিক্যাল সামগ্রী আমদানি ও বিক্রি করা হতো। আফতাবনগরের বাসায় বাবা-মায়ের সঙ্গে বসবাস করতেন তিনি। তার বেডরুমেই আগুন লাগে প্রথমে। তিনি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলেন। আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে গিয়ে ধোঁয়ায় তার বাবা নান্নুও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এবং আহত হন। পড়ে গিয়ে তিনি মাথায় আঘাত পান।

স্বপ্নীলের বাবা মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নু ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বুধবার একটি অনুষ্ঠান শেষে গভীর রাতে স্ত্রী ও ছেলে স্বপ্নীলকে নিয়ে বাসায় ফেরেন। স্বপ্নীল নিজের বেডরুমে ঘুমিয়ে পড়েন। পাশের ঘরে তারা স্বামী-স্ত্রী ঘুমান। ভোর ৫টার দিকে বিকট শব্দ ও ছেলের চিৎকারে তাদের ঘুম ভাঙে। ততক্ষণে পুরো বাসা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। স্বপ্নীলের ঘরের দরজায় অটো ইলেকট্রিক্যাল লক ছিল। ডাইনিং রুম থেকে তিনি দরজা খোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এক পর্যায়ে ফায়ার এক্সটিংগুইশার দিয়ে দরজার নিচে ফাঁকা স্থান দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। পরে নিজেদের বেডরুম সংলগ্ন বারান্দায় ছুটে গিয়ে দেখেন, স্বপ্নীল তার বেডরুমের বারান্দায় ছটফট করছে। গায়ের গেঞ্জিতে আগুন জ্বলছে এবং বাবা বাঁচাও, আম্মু বাঁচাও বলে চিৎকার করছেন। তিনি ছেলেকে গেঞ্জি খুলে ফেলে দিতে বলেন। গেঞ্জি খোলার পরও স্বপ্নীলের শরীর দাউদাউ করে আগুন জ্বলছিল। বাবা-মা পাশের বারান্দা থেকে এই দৃশ্য দেখলেও সেখানে গিয়ে তাকে উদ্ধার করার মতো সুযোগ পাননি।

শোকার্ত বাবা মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নু আর্তনাদ করে বলেন, 'আমাদের একমাত্র সন্তানকে ঘিরেই সুখ-শান্তি ছিল সংসারে। বাবা-মায়ের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। সেই সন্তান আমাদের সামনেই পুড়ে শেষ হয়ে গেল। আমাদের ছেড়ে চলে গেল। গায়ে আগুন লাগা অবস্থায় বাঁচার আকুতি জানালেও আমরা তাকে বাঁচাতে পারিনি। অনেক চেষ্টা করেও সে গায়ের আগুন নেভাতে পারেনি। চোখের সামনে আগুনে অঙ্গার হয়ে গেল। ওকে ছাড়া আমরা বাঁচব কী করে!'

একমাত্র সন্তানের মৃত্যুতে বারবার মূর্ছা যান মা শাহিনা হোসেন পল্লবী। জ্ঞান ফিরেই আর্তনাদ করতে থাকেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, 'বাবু (স্বপ্নীল) আমাকে খুঁজছে। আমার বাবু কই? তোমরা আমার বাবুকে এনে দাও। বাবু একা থাকতে পারবে না। আমাকে ডাকছে। বাবুকে বুকে ফিরিয়ে দাও।' গতকাল দুপুরে স্বপ্নীলের মৃতদেহ নিয়ে লাশবাহী গাড়ি দাঁড়িয়েছিল আফতাবনগরে তাদের বাসার সামনের রাস্তায়। এ সময় তার মা পল্লবী গাড়িটি দেখেই চিৎকার করে ওঠেন, 'ওই গাড়িতে আমার বাবু আছে। আমার বাবুকে তোমরা ফিরিয়ে দাও। বাবু গাড়িতে একা ভয় পাবে।'

বারিধারা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের সিনিয়র অফিসার আবুল কালাম আজাদ জানান, ভোর সোয়া ৫টায় তারা অগ্নিকাে র খবর পান। তাদের দুটি ও খিলগাঁওয়ের তিনটি ইউনিট দ্রুত ছুটে যায় সেখানে। পৌনে ৬টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। বারান্দা থেকে পিয়াসের পুড়ে যাওয়া মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। তিনি বলেন, একটি বেডরুমে বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে আগুনের সূত্রপাত। ঘরের দরজাটি লোহার হওয়ায় আগুন দ্রুত বাসার অন্যান্য ঘরে ছড়িয়ে পড়েনি। একটি ডাইনিং ও একটি বেডরুমের সব আসবাব পুড়েছে বলে জানান তিনি।

বাসায় সরেজিমনে দেখা যায়, স্বপ্নীলের কক্ষসহ ডাইনিং রুমের আসবাবপত্র পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। বাসার অন্যান্য ঘরের আসবাবও পুড়েছে আংশিক। এসি, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, সাউন্ড সিস্টেম ও অন্যান্য আসবাবপত্র পোড়া অংশ আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। প্রায় ৫০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে ওই ফ্ল্যাটে। পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা ইসাহাক হক জানান, ভোর ৫টার দিকে বিকট শব্দে তাদের ঘুম ভাঙে। দরজা খুলে ধোঁয়া দেখতে পান। এরই মধ্যে ভবনে আগুন লাগার সাইরেন শোনেন তারা। পরে দ্রুত পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভবন থেকে নেমে যান।

আটতলার বাসিন্দা রেজাউল করিম জাহাঙ্গীর জানান, অগ্নিকাণ্ডের খবর শোনার পরই তিনি দারোয়ানকে আগুন লাগার সাইরেন বাজাতে বলেন। ভবনের সব বাসিন্দা দ্রুত নেমে যান। তিনি বাইরে বের হয়ে দেখেন, ১০ তলায় নান্নুর বাসার একটি বারান্দা দিয়ে আগুন ও ধোঁয়া বের হচ্ছে। স্বপ্নীলের গায়ে আগুন জ্বলছে। স্বপ্নীলের মৃত্যুতে গতকাল এক বিবৃতিতে শোক প্রকাশ করেছে ক্র্যাব।

নান্নুর স্বজনরা জানান, যশোরের বাঘারপাড়া থানার ভাঙ্গুরায় নানার গ্রামের বাড়িতে লাশ দাফন করা হবে। বাড্ডা থানার ওসি পারভেজ ইসলাম জানান, মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নুর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ বিষয়ে থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়েছে।

সোনালীনিউজ/এইচএন

Wordbridge School
Link copied!