• ঢাকা
  • বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

রপ্তানি সম্ভাবনায় বাংলাদেশের বাইসাইকেল


এস এম মুকুল অক্টোবর ২১, ২০২০, ০৩:১৮ পিএম
রপ্তানি সম্ভাবনায় বাংলাদেশের বাইসাইকেল

ঢাকা : মাথায় হেলমেট, হাতে গ্লাভস এবং পিঠে ব্যাগ নিয়ে অদ্ভুত সুন্দর কিছু দ্বিচক্রযানে করে কিছু ছাত্রও ক্যাম্পাসে আসছে। টিএসসি, কার্জন হল, কলা ভবন, হাকিম চত্বরসহ সমগ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এখন সাইকেলের আনাগোনা খুব বেশি দেখা যাচ্ছে। আকার-আকৃতিসহ সব দিক দিয়েই এসব বাইসাইকেল এখন অত্যাধুনিক এবং চোখ ধাঁধানো। বোঝা যাচ্ছে, পরিচিত এই বাহনটির ব্যবসা বেশ রমরমা। গত কয়েক বছরে যানজটের রাজধানীতে বাইসাইকেল ব্যবহারে ‘বিপ্লব’ ঘটেছে। তরুণদের গুরুত্বপূর্ণ বাহনে পরিণত হয়ে উঠেছে বাইসাইকেল।

বিক্রেতারা জানিয়েছেন, গত কয়েক বছরে দেশে সাইকেলের চাহিদা বেড়েছে ৪০ শতাংশের বেশি। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা বিপুল সংখ্যায় সাইকেল ব্যবহার করায় নগরীর বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে সাইকেলের নতুন দোকান এবং সাইকেল বিক্রির চেইন স্টোর। জানা গেছে, বাড়তি চাহিদার কারণে দেশে সাইকেলের টায়ার-টিউবসহ খুচরা যন্ত্রাংশের কারখানাও গড়ে উঠেছে।

পরিবেশবান্ধব বাহন : বাইসাইকেল একটি অতি পরিচিত ও জনপ্রিয় বাহন। জার্মানির ব্যারন কার্ল ভোন ১৮৬৮ সালে এই বাহনটি পৃথিবীকে উপহার দেন। তবে তার আবিষ্কৃত সাইকেলের রূপ দিন দিন পরিবর্তন হয়ে বর্তমান আকৃতিতে এসেছে।

এই বাহনটি সহজ, নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব, কম খরচ, চালনায় সহজবোধ্য সর্বোপরি শারীরিক শ্রমবান্ধব— যা শরীরের জন্য খুবই উপকারী। এসব বিবেচনায় বাইসাইকেল প্রাচীন জনপ্রিয় বাহন হিসেবে সুপরিচিত। এই বাইসাইকেল চালনার সঙ্গে অবশ্য তারুণ্যের উন্মাদনার বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে।

বিশ্বে বিভিন্ন দেশে এখন সাইকেল চালনাকে স্বাস্থ্যপ্রদ, নিরাপদ, সময় সাশ্রয়ী এবং যানজট নিরসনের উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এ কারণে পরিবেশবান্ধব বাহন হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে দুই চাকার বাইসাইকেল। বড় হচ্ছে সাইকেলের বাজার। অনেকে আবার সাইকেল আন্দোলনও করছেন। যারা চান সবাই সাইকেল চালাক। এতে জ্বালানি সাশ্রয় হবে, পরিবেশ দূষণ হতে রক্ষা পাবে, স্বাস্থ্য ঠিক থাকবে। এতকিছুর পরও কেন সাইকেল নয়!

জনপ্রিয়তা বাড়ছে বাইসাইকেলের : দেশে বাইসাইকেলের বৃহত্তম পাইকারি বাজারে সারাক্ষণই ক্রেতাদের ভিড় লেগে থাকে। গত কয়েক বছরে বাইসাইকেলে বিক্রি ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা জানালেন বর্তমানে দুই চাকার এই যানের বার্ষিক চাহিদার পরিমাণ প্রায় পাঁচ লাখ পিস। এখন বছরে প্রায় পাঁচ লাখ বাইসাইকেল বিক্রি হয় দেশের বাজারে।

দেশীয় উৎপাদকরা বাইসাইকেল রপ্তানির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতেও মনোযোগী হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশে বাইসাইকেলের সবচেয়ে বড় বাজার রাজধানীর বংশালে। সেখানে সাইকেলের প্রায় ২০০ দোকান রয়েছে।

ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে খুচরা বিক্রেতার সংখ্যা চার হাজারের বেশি। দেশের বাজারে কানাডা, ট্রেক, হিরো রেঞ্জার, ম্যাক্স, লক্স, জোহান, ফুজি ও তাইওয়ানের তৈরি মেরিডাসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সাইকেল পাওয়া যায়।

কার্বন বাইসাইকেল এক থেকে দেড় লাখ টাকা, অ্যালুমিনিয়ামের সাইকেল ২১ থেকে ৭০ হাজার টাকা, ইস্পাতের বাইক ৫ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকায় পাওয়া যায়। দেশে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সাইকেল তৈরির কারখানা গড়ে তুলেছে। এর মধ্যে রয়েছে মেঘনা গ্রুপ, আলিতা বাংলাদেশ লি., নর্থবেঙ্গল সাইকেল ইন্ডাস্ট্রিজ, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপও উল্লেখযোগ্য।

রপ্তানিতে আশা জাগাচ্ছে বাইসাইকেল : একসময় বাইসাইকেলের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ছিল আমদানিনির্ভর। এখন উৎপাদন খরচ আর গুণগত মানের বিবেচনায় বাংলাদেশের বাইসাইকেল বিশ্ববাজারে রপ্তানির জায়গা করে নিয়েছে।  বিশ্বমন্দার মাঝেও বাইসাইকেল রপ্তানিতে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, শুধু ইউরোপে বছরে ৩ কোটি বাইসাইকেল কেনা হয়। এছাড়া বছরে দুবার সাইকেলের টায়ার পরিবর্তন করতে হয় বলে বাংলাদেশ থেকে টায়ার রপ্তানিরও সুযোগ রয়েছে। ইউরোপসহ ব্রাজিল ও তাইওয়ানে এসব টায়ার রপ্তানি হচ্ছে। ইউরোপীয় দেশগুলোতে বাংলাদেশে তৈরি ব্যতিক্রমী বাইসাইকেল দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছে। সম্ভাবনাময় এ খাতের মাধ্যমে প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ পিস সাইকেল রপ্তানি করা সম্ভব।  

কোভিড-১৯ পরবর্তী বিশ্ববাজারে বেড়েছে দেশের বাইসাইকেল রপ্তানি। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে বাইসাইকেল রপ্তানি থেকে আয় এক কোটি ৮৭ লাখ ডলার বা প্রায় ১৫৯ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা হিসাবে)।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) আগস্ট মাসের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের বাইসাইকেলে রপ্তানি আগের বছরের আগস্টের চেয়ে বেড়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের আগস্টে লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক কোটি ৬৬ লাখ ১০ হাজার ডলার। লক্ষ্যমাত্রা থেকে আয় বেড়েছে ১৩.০৬ শতাংশ।

২০১৯-২০ অর্থবছরে বাইসাইকেল রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে আট কোটি ২৮ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরে বাইসাইকেল রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১০ কোটি ডলার।

আছে সুযোগ ও সম্ভাবনা : শ্রমঘন এই শিল্পে বিপুল সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে ব্যবসায়ীরা বলেন, সস্তা শ্রমিক ও প্রায় ৭০ শতাংশের বেশি কাঁচামাল স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয়। ৩০ শতাংশ খুচরা যন্ত্রাংশ আসে চীন, কোরিয়া, তাইওয়ান থেকে।

সাশ্রয়ী হওয়ার ফলে দেশের বাইসাইকেলের চাহিদা বাড়ছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলোতে। বর্তমানে দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ ও মেঘনা গ্রুপসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠান বাইসাইকেল উৎপাদন করে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার বাংলাদেশ থেকে বাইসাইকেল আমদানির ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রস্তাব করেছেন, বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা সেখানে গিয়ে যৌথভাবে বিনিয়োগও করতে পারেন।

এছাড়া সীমান্তবর্তী এলাকায় বাইসাইকেল তৈরির কারখানা গড়ে তুলতে পারেন বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা। তাতে করে পশ্চিমবঙ্গে আমদানি খরচ কমে আসবে। বাংলাদেশের উদ্যোক্তা এবং বাণিজ্য বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর এসব প্রস্তাব বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের জন্য কতটা বাস্তবসম্মত, সেটা ভেবে দেখার বিষয় আছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, উন্নত দেশগুলোতে বাইসাইকেলের বাজার যে আরো সম্প্রসারিত হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে পরিবেশগত। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে এখন পরিবেশসম্মত যানবাহনকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সেক্ষেত্রে বাইসাইকেল সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব। এসব দেশে বাইসাইকেলের চাহিদা যত বাড়বে বাংলাদেশের রপ্তানির বাজারও তত সম্প্রসারিত হবে।

আশার খবর হলো, বিশ্ব রপ্তানি বাজারে বাংলাদেশের বাইসাইকেল দিন দিন ভালো জায়গা করে নিচ্ছে। হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রকৌশল শিল্পজাত পণ্য রপ্তানিতে বাইসাইকেলের অবদান ৭.৫ শতাংশ।

ইপিবি সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের বাইসাইকেল রপ্তানি শুরু হয় ১৯৯৫ সালে। প্রথম দিকে মাত্র কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান রপ্তানি শুরু করলেও বর্তমানে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান বাইসাইকেল সহ খুচরা যন্ত্রাংশ রপ্তানি করছে।

মেঘনা গ্রুপ ছাড়াও জার্মান বাংলা, আলিতা ও নর্থবেঙ্গল নামের প্রতিষ্ঠানগুলো ঢাকা, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে তাদের কারখানা থেকে উৎপাদিত সাইকেল বিদেশে রপ্তানি করছে। মেঘনা গ্রুপের তিনটি বাইসাইকেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে যথাক্রমে ট্রান্সওয়ার্ল্ড বাইসাইকেল কো. লি., ইউনিগ্লোরি সাইকেল ইন্ডাস্ট্রিজ লি. এবং  মাহিন সাইকেলস লিমিটেড কোম্পানি। বেশ কয়েকটি দেশে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশের তৈরি সাইকেল।

যেমন- যুক্তরাজ্য,  জার্মানি, হল্যান্ড, ইতালি, গ্রিস, আয়ারল্যান্ড, বেলজিয়াম ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া, পর্তুগাল ও কানাডা। এছাড়া ছোট ছোট কিছু কোম্পানি আছে যারা সাইকেলের যন্ত্রাংশ তৈরি করে।

বংশালের উদ্যোক্তাদের মতে, ইউরোপের বাজারে প্রচলিত মূল্যের চেয়ে প্রায় অর্ধেক দামে বাইসাইকেল রপ্তানি করে কোটি কোটি ইউরো মুদ্রার বাজার দখল করা সম্ভব। বাইসাইকেল ছাড়াও এর বিভিন্ন খুচরা যন্ত্রাংশ রপ্তানির সুযোগ রয়েছে ইউরোপের বাজারে। বাইসাইকেল উৎপাদন শিল্পটি জ্বালানিনির্ভর না হওয়ায় এবং খুব বেশি প্রযুক্তিনির্ভর না হওয়ায় দ্রুত বিকাশ ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের টায়ার রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান মেঘনা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ ইউরোপের বাজারে প্রায় ৫০ কোটি টাকার টায়ার রপ্তানি করছে।

তাদের মতে, এ খাত থেকে বছরে অন্তত ৫০০ কোটি টাকা রপ্তানি আয় বাড়ানো সম্ভব। বাংলাদেশ থেকে এখন পর্যন্ত বাইসাইকেল রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে ইউরোপ। প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৭০ কোটি টাকার সাইকেল রপ্তানি হচ্ছে।

লেখক : কৃষি-অর্থনীতি বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক

Wordbridge School

অর্থনীতি বিভাগের আরো খবর

Link copied!