• ঢাকা
  • বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বে প্রতি ৪৮ ঘণ্টায় একটি মাতৃভাষার মৃত্যু!


সাহিত্য সংস্কৃতি প্রতিবেদক ফেব্রুয়ারি ২, ২০১৭, ০৯:২৪ পিএম
বিশ্বে প্রতি ৪৮ ঘণ্টায় একটি মাতৃভাষার মৃত্যু!

ঢাকা: সারাবিশ্বে সাড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অন্তত তিন হাজার জীবন্ত মাতৃভাষা। এসব ভাষায় কথা বলে অসংখ্য মানুষ। তবে এসব ভাষার অস্তিত্ব নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। নতুন কোনো মাতৃভাষার জন্ম তো হচ্ছেই না বরং প্রতিবছরই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে অনেক মাতৃভাষা।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, প্রতি বছর প্রায় দুইশ মাতৃভাষার মৃত্যু হচ্ছে। এ হিসেবে প্রতি দুই দিন অর্থাৎ প্রতি ৪৮ ঘণ্টায় একটি করে মাতৃভাষার মৃত্যু হচ্ছে। এসব ভাষাভাষী মানুষও অন্যভাষা গ্রহণ করায় অপেক্ষাকৃত অপ্রচলিত ভাষার বিলুপ্তি হচ্ছে। বিশ্বে মোট ভাষার সংখ্যা ৬ থেকে ৭ হাজার। দুশ বছর আগে এই সংখ্যা ছিল হাজারের বেশি। তবে ইতোমধ্যেই প্রায় দেড় হাজার ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। শুধু ভারতেই গেল ৫০ বছরে লোপ পেয়েছে দু’শতাধিক ভাষা।

বছর চারেক ব্যাপী চালানো এক সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে, জীবিকার সন্ধানে মানুষের শহরে গমন এবং যাযাবর উপজাতি লোকদের মধ্যে তাদের ঐতিহ্যগত ভাষায় কথা বলার শঙ্কাই এর জন্য দায়ী। সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভারতে ২শ ৩০টি ভাষা লোপ পেয়েছে। বিচিত্র ও দ্রুত আধুনিকায়নসমৃদ্ধ ভারতে সময়ের আবর্তে উত্তীর্ণ হয়েছে ৮শ ৭০টি ভাষা। ভারতে এখনও ৪শ ৮০টি ভাষায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কথা বলে। বিলুপ্ত প্রায় ১০টি ভাষার দলিল প্রমাণাদি পরীক্ষা করে দেখা গেছে এগুলোর মধ্যে রয়েছে লোকগীতি ও গল্প।

মাতৃভাষা অর্জন একটি জটিল প্রক্রিয়া এবং ভাষাবিজ্ঞানী এর প্রকৃতি সম্পর্কে এখনও পুরোপুরি জানতে পারেননি। ছোট শিশুদের মধ্যে প্রবৃত্তিগতভাবেই কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে যা তাদের শিশু বয়সেই মাতৃভাষা অর্জনের উপযোগী করে তোলে। এই বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে আছে বাগনালীর গঠন, যার মাধ্যমে শিশু তার মাতৃভাষার বিভিন্ন শব্দ উৎপাদন করে। এছাড়া শিশুদের সাধারণ ব্যাকরণিক মূলনীতিগুলি এবং বাক্যগঠনের স্তরগুলি বোঝার ক্ষমতা থাকে। শিশুরা কোনো নির্দিষ্ট ভাষা শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয় না। বরং যে ভাষা তাদের আশেপাশে বলা হয়, তারা সেই ভাষাই শিখে ফেলে, এমনকি যদি তাদের পিতামাতা অন্য কোনো ভাষাতে কথা বলে, তা হলেও। প্রাথমিক ভাষা অর্জনের একটি কৌতূহলোদ্দীপক বৈশিষ্ট্য হল শিশুরা প্রথম প্রথম বাক্যের গঠনের চেয়ে অর্থের উপর বেশি জোর দেয়। যেই পর্যায়ে তারা সচেতনভাবে সুসংগঠিত বাক্য বলতে আরম্ভ করে, সেই পর্যায়েই মনুষ্য শিশুরা ভাষিক দক্ষতায় পশু-পাখি-মাছ জাতীয় প্রাণীদের ছাড়িয়ে যায়।

মূলত, সভ্যতার আলো যতোই প্রসারিত হচ্ছে নানা জাতি গোষ্ঠী বা উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর লোকেরা তাদের জীবিকা বা কর্মসংস্থানের প্রয়োজনে ততোই শহরে ভিড় করছে। এদের মাতৃভাষাই দিন দিন লোপ পাচ্ছে। বিশেষ করে যাযাবর জনগোষ্ঠী এবং পাহাড় বা বনাঞ্চল থেকে শহরে চলে আসা উপজাতীয় নৃগোষ্ঠীর ভাষা এর বেশি শিকার। যাযাবররা তাদের জীবনপদ্ধতি ত্যাগ করে শহরে আশ্রয় নিয়ে শহরের মূলধারা থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার আশঙ্কায় তাদের নিজস্ব সামাজিক আচার ও সংস্কৃতি এবং ভাষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. জীনাত ইমতিয়াজ আলী জানান, বিভিন্ন গবেষণা ও বিশ্বের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায়, পৃথিবীতে মোটাদাগে দু’রকম ভাষা আছে। একটা সংখ্যাগরিষ্ঠের আর অপরটি সংখ্যালঘিষ্ঠের ভাষা। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা সব সময় সংখ্যালঘিষ্ঠের ভাষাকে হত্যা করে। ব্যাপক যোগাযোগের জন্য সংখ্যালঘিষ্ঠ ভাষাভাষীকে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা শিখতে হয়।

আধুনিকতার পাশেই যাযাবর জীবন

অধ্যাপক ড. জীনাত ইমতিয়াজ বলেন, বাংলাদেশে ১৩ থেকে ১৪টি ভাষা এমনই শোচনীয় পর্যায়ে রয়েছে যে, আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে এদের অনেকগুলো হারিয়ে যাবে। কারণ এ ভাষাগুলোর কথ্য ও লিখিত রূপ যথেষ্ট জোরাল অবস্থায় নেই। মানে এগুলো আর ভালোভাবে কথিত বা চর্চিত হয় না।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক বলেন, মানুষের মৌলিক যতগুলো পরিচয়চিহ্ন রয়েছে, সে সবের মধ্যে ভাষা অন্যতম। একটি জাতি আলাদা হচ্ছে তার সংস্কৃতির জন্য। এ সংস্কৃতির অপরিমাপ্য উপাদান বা সম্পদ হচ্ছে ভাষা।

ইংরেজির মতো ভাষাকে যে কোনো দেশের মানুষের মাতৃভাষার ওপর চাপিয়ে দেয়াকে সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা বলে মনে করেন ড. ইমতিয়াজ। এটাকে লিঙ্গুয়িস্টিক ইমপেরিয়ালিজম বা ভাষিক ঔপনিবেশিকতাও বলা হয়ে থাকে। ঔপনেবেশিক প্রভুরা বা শাসকগোষ্ঠী সব সময় চেয়েছে তাদের ভাষা সঞ্চারিত করতে, অন্যদের ওপর আধিপত্য কায়েম করতে। আর সেজন্যই তারা বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ওপর ভাষিক আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা করেছে।

শাসকের নিজেদের ভাষাকে চাপিয়ে দিতে পারলে, ভাষিক আধিপত্য শাসিত জনগোষ্ঠীর ওপর কায়েম করতে পারলে স্থায়ীভাবে শাসন ও শোষণটাও করা যায়। কোনো সভ্য ও সুবুদ্ধির মানুষ এটাকে প্রশ্রয় দিতে পারে না। সবাই নিজের ভাষা আগে শেখে। মানুষ যখন মাতৃগর্ভে থাকে, তখনই মাতৃভাষা সম্পর্কে তার ভেতরে সংবেদন সৃষ্টি হয়।

অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ বলেন, অমর একুশে ফেব্রুয়ারি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা আমাদের একটা ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেছে।

সোনালীনিউজ

Wordbridge School
Link copied!