• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০২ মে, ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১

লাশের ছেলে অথবা বৌ লাগবে!


ফেসবুক থেকে ডেস্ক জানুয়ারি ১২, ২০১৮, ০১:৪৪ পিএম
লাশের ছেলে অথবা বৌ লাগবে!

প্রতিকি ছবি

ঢাকা: পরশু রাতের ঘটনা। অফিসের কাজ শেষ করে বাসায় এসে বাইকটা রেখে চা পান করতে বের হলাম। পরিচিত চা স্টল। এখানে কাজ শেষ করে বাসার দিকে রওনা দিয়ে একটু সামনে আসতেই দেখলাম একটা লোক মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। রাস্তা দিয়ে লোকজন যেতে পথে অনেককেই টাকা পয়সাও দিতে দেখলাম।

বিষয়টা জানতে আরেকটু সামনে গিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। দেখি লোকটা মারা গেছে। আশপাশে কাউকে দেকছি না জিজ্ঞেস করার মতো। যারা আছে তারাও আমর মতোই লোকটা সম্পর্কে কিছুই জানে না। এরকম অবস্থায় বিবেকের টানে চলেও যেতে পারছি না। অপেক্ষা করতে লাগলাম। মিনিট কয়েক পরেই পুলিশ আসলো, হয়তো কেউ লাশ পড়ে থাকার খবর দিয়েছিলো কেউ।

পুলিশ এসেই কিছুক্ষণ পর বলতে লাগলো, তারা লাশ নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে রাখবে। এবং বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করবে। তখন আমি পুলিশের সাথে কথা বললাম। তাদেরকে বললাম, আগে খোঁজ খবর নেয়া দরকার লোকটা সম্পর্কে। তার আত্মীয় স্বজন থাকতে পারে। এমন সময় পাশ থেকে এক রিক্সাচালক ভাই বললেন, তিনি মৃত লোকটাকে চেনেন। দুই দিন আগেই তিনি কামার পাড়া ক্লাবের সামনে নামিয়ে দিয়ে এসেছিলেন।

এমন কথায় কিছুটা আশ্বস্ত হওয়া গেল। কামার পাড়া হয়তো লোকটার কোনো আত্মীয় স্বজন থেকে থাকতে পারে। কিন্তু এতো রাতে কিভাবে যাওয়া যায়। আমি দ্রুত মোবাইল ফোনে মৃত লোকটার ছবি তুললাম। দৌড়ে গিয়ে বাসা থেকে বাইকটা বের করলাম।

রিক্সাচালক ভাই আর আমার এক ছোট ভাইকে নিয়ে ছুটলাম কামার পাড়া ক্লাবের দিকে। তার আগে পুলিশ বললো, মৃত লোকটার আপনজন ছাড়া তারা লাশ হস্তান্তর করবে না।

এদিকে ত্রিশ মিনিটের মধ্যেই আমরা কামার পাড়া ক্লাবের সামনে পৌঁছে গেলাম। মৃতলোকটার আপনজন খুঁজতে।

বস্তি এলাকা। তারপরেও আমরা বস্তির লোকজনকে মৃত লোকটার ছবি দেখাতে শুরু করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কেউ চেনে কিনা! দেখলাম কেউ চেনে না। কিন্তু একজন বললো, সে মৃত লোকটাকে চেনে। বললো, এটা আমগোর রশিদ পাগলা।

এরকম আরো অনেককেই পাওয়া গেল, যারা রশিদ পাগলাকে এক নামে চেনে। তার সম্পর্কে বিভিন্ন ঘটনা বলতে লাগলো অনেকে। কিন্তু কেউ তার আপনজনদের ঠিকানা বলতে পারছে না। এমন বিপদর সময় একজনকে খুঁজে পাওয়া গেল যিনি রশিদ পাগলার আপনজনের ঠিকানা দিলেন। তবে এটা কামার পাড়া নয়। পাশের গ্রামে। তিনিই সেখানে আমাদের নিয়ে যেতে রাজি হলেন।

রাত তখন আড়াইটা। আমরা খুঁজছি রশিদ পাগলার আপনজনদের। যে গ্রামে গেলাম, সেখানে তখন সবাই ঘুমে। অনেক ডাকাডাকির পর বেয়াই বের হলেন। তাকে মোবাইল ফোনে ছবি দেখালাম। বললো, কি হইছে উনার? আমরা সব ঘটনা খুলে বললাম। উনি আমাদের সাথে আসতে রাজি হলেন।

কিন্তু বাধ সাধলো উনার স্ত্রী। উনাকে অনেক বলে কয়ে বোঝাতে হল। বললাম, উনি না গেলে লাশটা পুলিশ বেওয়ারিশ হিসাবে দাফন করবে। দয়া করে আসুন। বেয়াই বললো দাঁড়ান দেখি কারো নাম্বার পাই কিনা, তারপর পেল রশিদ পাগলার ভাইয়ের ছেলের নাম্বার। দিলাম কল। কম বয়সী ছেলে ফোন ধরলো। তাকে বললাম, আপনার চাচা মারা গেছে। আপনার বাবাকে ফোনটা দেন।

সে বললো, বাবাতো পুবাইল থাকে, আর আমি থাকি বেড়িবাদ। আমি বললাম আপনার বাবার নাম্বারটা দেয়া যাবে? ও আমাকে নাম্বার দিলে ফোন দিলাম ওর বাবাকে। ফোন দিয়ে বললাম আপনার ভাই রশিদ পাগলা মারা গেসে। আপনি দয়া করে আসেন, লাশটা নিয়ে যান খাল পাড় উত্তরা থেকে। উনি বললো এতো রাত্রে কীভাবে আসবে গাড়ি পাওয়া যাবে না! আমি বললাম ভাই না আসলে পুলিশ নিয়ে যাবে।

উনি বললো, ভাই আমি আসতেসি আমি ৫ থেকে ৬বার ফোন দিলাম। একটু পর পর জিজ্ঞেস করলাম কই আছেন, গাড়ি পাইসেন? তারপর উনি বললো ভাই, আপনি থাকেন। আমি আসতেসি।

এরপর আমি ও কামার পাড়া এলাকার ট্রাক সমিতির সভাপতি এবং ১০-১৫ জন ট্রাক ড্রাইভারকে নিয়ে আসলাম উত্তরায়। লাশের কাছে। এসে পুলিশকে বললাম, ভাই উনার পরিচিত লোকজনকে নিয়ে আসছি। লাশ হস্তান্তর করে দেন।

তখন পুলিশ বলে, তাদের দিয়ে হবে না। আমি বললাম আপনাররা বলছিলেন পরিচিত কাউকে আনলে লাশ দিয়ে দিবেন, আমি উনার বেয়াইকে আনলাম। কিন্তু পুলিশ নাছোরবান্দা। রক্তের সম্পর্ক ছাড়া লাশ দিবে না। মনটা খারাপ হয়ে গেলো।

তারপর আবার ভাতিজাকে ফোন দিলাম ও বললো আমি আসতে ৫ মিনিট সময় লাগবে। আমি পুলিশকে বললাম উনার ভাতিজাকে আনলে দিবেন? উনি বললো আসতে বলেন। তারপর ভাতিজা এসে লাশ দেখে প্যাচ করে ফেললো। সে লাশ দেখে বলে, এটা তার চাচা না। মহা মুশকিলে পড়লাম।

ভাতিজাকে তখন আমি বললাম, কত দিন চাচাকে দেখো নাই? ও বললো ১০-১৫ বছর! আবার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। পরে পুলিশকে বললাম, ও ভয়ে মনে হয় বলতেসে। তার বেয়াই বললো মৃত লোকটা তার চাচা!

পুলিশকে বললাম ভাই, এখন দিয়ে দেন লাশটা। ২জন তো পাইসেন। তখন পুলিশ বললো মৃত লোকটার ভাই আসুক। আমি বললাম ভাই আসবে কখন, আর লাশ দিবেন কখন! একটু আগে বল্লেন ভাতিজাকে আসতে বলেন। অকে আনলাম, আর এখন বলতেসেন ভাই আসুক? এটা কেমন কথা? তারপর ভাই আসলো রাত তখন ভোর। মানে ঘড়িতে তখন ৪:৩০। পুলিশকে আমি বললাম, এখন ভাই এসে গেছে, এখন কী করবেন বলেন? পুলিশ বলে, লাশের ছেলে বা বৌ লাগবে।

তখন আর মেজাজ ধরে রাখতে পারলাম না। আমি প্রচণ্ড রাগে বললাম, লাশ যদি ১ ঘন্টার মধ্যে না দেন তাইলে খবর আছে। আমি আমার যত পরিচিত সাংবাদিক আছে সবাইকে বলবো আসতে। তারপর নানান বাহানা শুরু হলো তাদের। পুলিশ বলে, স্যাররা এখন এতোরাতে ফোন ধরবে না।

সকাল না হলে লাশ দিবে না। আমি বললাম সরাসরি বললাম, আপ্নেরা কি টাকা পয়সা চান? চাইলে আমাকে বলেন লাশের অনেক টাকা পয়সা উঠসে, আপনাদের লাগলে বলেন আমি দিবো। কেউ কিছু বলবে না। তখন তারা বলে, না ভাই লাগবে না। তখন আমি বললাম তাইলে এত কাহিনী করতেছেন কেন?

পরে লাশ এর টাকাগুলা গুনতে বলাম এক হুজুরকে। উনি দুয়েকজন টাকাগুলো একসাথে করে বললো, ৬ হাজার ৩০০ টাকা হইসে। আমি বললাম রিক্সা চালক ভাইকে কিছু টাকা দেয়া দরকার। তখন সবাই বললো ভাই আপনি দেন আমি বললাম ভাই ১০০০ দিয়ে দেই সবাই বললো দেন ভাই। ওই রিক্সা চালক ভাইকে বললাম, ভাই আপনার জন্য লাশেরর পরিচত লোকজন পাইছি, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

এসবের পর পুলিশ এবার লাশ নিয়ে থানায় যেতে বললো। আমি বললাম চলেন, তারপর থানায় গিয়ে আবার সেই কাহিনী। সকালের আগে লাশ দেয়া যাবে না এসব। আমি বললাম সকাল হলে যত মিডিয়া আছে, সবাই আসবে। আমি ফোন করে আনাবো এসবের পর পুলিশ এবার লাশ নিয়ে থানায় যেতে বললো।
আমি বললাম চলেন, তারপর থানায় গিয়ে আবার সেই কাহিনী। সকালের আগে লাশ দেয়া যাবে না এসব। আমি বললাম সকাল হলে যত মিডিয়া আছে, সবাই আসবে। আমি ফোন করে আনাবো। তারপর আপনাদের খবর করে ছাড়বো। এমন ঝাড়িতে এবার কাজে দিলো।

আমাকে একজন বললো, ভাই আপনি মাথা গরম কইরেন না। আমি দেখতেসি। ব্যাস! ২০ মিনিট পরে ছেড়ে দিলো কাগজ পত্রে সই নিয়ে। মৃতলোকটার ভাই, বেয়াই, ভাতিজাসহ আত্মীয়রা লাশ নিয়ে রওয়ানা দিল রংপুরের উদ্দেশ্যে। আমি বাইকে করে উত্তরার বাসায় ফিরে এলাম।

পৃথিবীতে সুন্দর নেমে আসুক...

লেখাটি ইংরেজি দৈনিক ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার সাংবাদিক জাকি জামানের ফেসুবক থেকে নেয়া।


সোনালীনিউজ/ঢাকা/আকন

Wordbridge School
Link copied!