• ঢাকা
  • রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপিতে জোরালো হচ্ছে ঐক্যফ্রন্ট বিরোধী আওয়াজ


বিশেষ প্রতিনিধি মার্চ ৩০, ২০১৯, ০১:০৮ পিএম
বিএনপিতে জোরালো হচ্ছে ঐক্যফ্রন্ট বিরোধী আওয়াজ

ঢাকা : তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের ভাষায় বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট তেল-পানির মিশ্রণ হলেও বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে জিইয়ে রাখতে চায় বলে জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

কিন্তু দিন যত গড়াচ্ছে বিএনপিতে ঐক্যফ্রন্ট বিরোধী আওয়াজ যেন ততোই জোরালো হয়ে উঠছে। ধীরে ধীরে দলটির সিনিয়র নেতারা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বিশেষ করে ফ্রন্টের প্রধান নেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। প্রশ্ন তুলছেন পরীক্ষিত বন্ধু পুরনো শরিক বিশদলীয় জোট রেখে সম্পূর্ণ বিপরীত আদর্শের নেতাদের সমন্বয়ে গড়ে উঠা নতুন জোটের কার্যকারিতা নিয়েও।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে নতুন জোট করে বিএনপি। দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত মোর্চা বিশদলীয় জোটকে গুরুত্ব না দিয়ে ঐক্যফ্রন্টের দিকে ঝুঁকে পড়ে দলটি। নতুন জোটের প্রতি বিএনপির এই ঝুঁকে পড়াকে একেবারেই ভাল চোখে দেখেননি বিশদলীয় জোট নেতারা। তারা বিএনপির নতুন শরিকের বিপক্ষে কোনো বক্তব্য না দিলেও ঐক্যফ্রন্টের দিকে বিএনপির হঠাৎ ঝুঁকে পড়াকে ভালভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। ইশারা-ইঙ্গিতে, আলাপ-আলোচনায় তা তারা বুঝিয়েও দিয়েছেন। কিন্তু বিগত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ভ‚মিধস পরাজয়ের পর খোদ দলের ভেতর থেকেই ঐক্যফ্রন্টের প্রতি বিএনপির এই ‘প্রেম’ নিয়ে প্রশ্ন উঠে।

সর্বপ্রথম গত ২৩ জানুয়ারি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে নতুন জোট নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

এরপর ধীরে ধীরে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে বিএনপির নেতাদের মধ্যে অনৈক্যর সুর জোরালো হতে থাকে। বিএনপির বিভিন্ন ঘরোয়া রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নেতারা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রয়োজনীয়তা ও সম্পূর্ণ বিপরীত আদর্শের ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্ব নিয়েও প্রশ্ন তুলতে থাকেন। সর্বশেষ গতকাল সোমবার বিকালে নতুন জোট ঐক্যফ্রন্ট ও ফ্রন্টের মূল নেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বের বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেন বিএনপির অন্যতম ভাইস চেয়ারম্যান প্রবীণ নেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন।

মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে রমনা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে গত সোমবার বিকালে বিএনপি আয়োজিত আলোচনা সভায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বের কড়া সমালোচনা করেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। ড. কামালের নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, যিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এক কোটি ভোটের ব্যবধানে হেরেছিলেন আমরা তাকে নেতা মানলাম। কেন, মির্জা ফখরুল কী দোষ করেছিল?

নাম উল্লেখ না করে শাহ মোয়াজ্জেম বলেন, আমি স্বাধীনতার ইতিহাস জানি। সেই সময়ে ভারতে আমরা সব চলে গেলাম। এনটায়ার কেবিনেট চলে গেল। গভর্নর হাউসে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে কথা বলার সময়ে যে ব্যক্তি ছিল সর্বক্ষণ, সে গেল না।

এসময় একাদশ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন সিনিয়র এই নেতা। শাহ মোয়াজ্জেম বলেন, কেন এই নির্বাচনে আমরা গেলাম। কথা হলো নির্দলীয় সরকার ছাড়া নির্বাচন হবে না, কিন্তু তা তো হলো না। দলীয় সরকারের অধীনেই হলো। কথা হলো খালেদা জিয়া ছাড়া নির্বাচন হবে না, কিন্তু খালেদা জিয়া ছাড়া আমরা নির্বাচনে গেলাম। কেন এ অবস্থা হলো? কেন আজও খালেদা জিয়া জেলে?  কেন একটা দাবিও সরকার মানল না?

এর আগে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের কারচুপি ও ভোট ডাকাতির অভিযোগ তুলে সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশন মিলনায়তনে গণশুনানির আয়োজন করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। সেই শুনানিতে ড. কামাল হোসেনের উপস্থিতিতেও তার নেতৃত্ব ও ফ্রন্টের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বিএনপি মনোনীত ধানের শীষের বিভিন্ন প্রার্থীরা।  তারা নির্বাচনকে ঘিরে ফ্রন্টে সঠিক দিক-নির্দেশনা বিশেষ করে শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনের ‘নিরীহ ভ‚মিকা’ নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

এরপর গত ২০ ফেব্রুয়ারি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে একুশে ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় কর্মীদের তোপের মুখে পড়েন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ।
ওইদিন আলোচনা সভায় মওদুদ আহমদের বক্তব্যের প্রায় ৩ মিনিট অতিবাহিত হলে দর্শকসারি থেকে নেতাকর্মীরা স্লোগান ধরেন ‘মুক্তি চাই’, ‘খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই’, ‘জেলের তালা ভাঙতে হবে খালেদা জিয়াকে আনতে হবে’ ইত্যাদি।  এ সময় মওদুদ আহমদ নিরব দর্শকের ভ‚মিকায় কর্মীদের স্লোগান শোনেন।  

ব্যারিস্টার মওদুদকে উদ্দেশ্য করে কর্মীরা বলেন, ‘হল খালি কেন? ঐক্যফ্রন্ট থেকে বের হয়ে আসুন।  মুক্তি মুক্তি মুক্তি চাই, খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই।  খালেদা জিয়ার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই।’

পরে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সভাপতির বক্তব্য দেয়ার সময় নেতাকর্মীরা বলেন, কর্মসূচি দেন। ঐক্যফ্রন্ট ছাড়েন।’ এসময় আবারও সেøাগান দেয়া হয়।

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘দাঁড়ান। দাঁড়ান। চাইলেই কর্মসূচি দেয়া যায় না। কর্মসূচি পালন করতে হবে। কথা শোনেন।’  কর্মীরা তখন বলেন, ‘হয় কর্মসূচি দেন, না হয় বিএনপি ভেঙে দেন, ঐক্যফ্রন্ট ভেঙ্গে দেন।’

এসময় নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বন্ধুগণ, আপনাদের যে ক্ষোভ ও ব্যথা, এটা আমরা বুঝি। কিন্তু আপনাদের বুঝতে হবে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যখন গণতান্ত্রিক শক্তি লড়াই করে তখন অতি সহজে সফলতা অর্জন করা যায় না। কেন বলছেন আপনারা ব্যর্থ হয়েছেন। আপনারা ব্যর্থ হন নাই। আজকে আপনারা বিজয়ী হয়েছেন। দেশ ও বিশ্বের কাছে প্রকাশ হয়েছে, এটা ফ্যাসিবাদী শক্তি।’

এদিকে, পরীক্ষিত মিত্রদের অবহেলা করে বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে বেশি মেতে উঠেছে বলে মনে করেন ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর নেতারা। নতুন জোটের প্রতি বেশি মাত্রায় মনোযোগের কারণে সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি এখন পর্যন্ত এ জোটের কোনো বৈঠকও ডাকছে না বলে ক্ষোভ তাদের।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিশ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম জোটের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ২০ দলীয় জোটের কোনো বৈঠক নেই। আমাদের প্রধান শরিক বিএনপি কখন বৈঠক ডাকবে আমরা সেই অপেক্ষায় আছি। মিটিং ডাকলে আমরা সেখানে আলোচনা করব। এর বেশি কোনো তথ্য আমাদের কাছে নাই।’

তিনি আরও বলেন, আমরা জোটে আছি। বিএনপি আমাদের প্রধান শরিক। আমরা জোটের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। ওনারা আমাদের সঙ্গে নিয়ে কীভাবে অগ্রসর হবেন-সেই নির্দেশনার অপেক্ষায় আছি। আমাদের মধ্যে প্রধান সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হচ্ছে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ড. কামাল হোসেন। এখানে এ তফাৎটা আছে। আমরা ২০ দলীয় জোটে চাইলেই কোনো কিছু করতে পারব না। ঐক্যফ্রন্ট তাদের প্রোগ্রাম নিয়ে আগাতেই পারে।’

২০ দলীয় জোট শরিক এলডিপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদৎ হোসেন সেলিম এ বিষয়ে বলেন, বিএনপি এখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে ব্যস্ত। তাদের কাছে ২০ দলীয় জোট এখন অবহেলিত। সবার সঙ্গে আলোচনা করে আমরা শিগগিরই ২০ দলের সভা ডাকব।’

বিএনপির অন্যতম ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, আমরা সবসময় একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চাই। এ চাওয়া আমাদের অরণ্যে রোদন বলেই আমার বিশ্বাস। কারণ সরকারের কোনো কৌশলই আমরা ধরতে ব্যর্থ হয়েছি। তারা আগেই বুঝে গিয়েছিল বিএনপিকে কোনো কিছু না দিলেও তারা নির্বাচনে আসবে।

মেজর হাফিজ বলেন, ড. কামাল একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি। তিনি দেশের প্রথম সংবিধান রচনায় খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার কোনো সংযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। বিএনপির মত বড় দল যে তাদের দ্বারস্থ হয়েছে এটাকে আমি সঠিক হয়েছে বলে মনে করি না। আদর্শগত বিভেদ তো আছেই। সুতরাং আদর্শের ঐক্য না থাকলে তাদের সঙ্গে জোট করে কোনো সুবিধা হয় না।

বিএনপির এই ভাইস চেয়ারম্যান আরও বলেন, আমরা শুধু শুধু অন্যকে নেতা বানিয়ে দিয়েছি। আমাদের বিএনপি দলে অনেক সিনিয়র, যোগ্য ও ক্যাপেবল নেতা আছেন। তাদেরকে নিয়েই আমরা এগিয়ে যেতে পারতাম। ভোট কারচুপি যা হয়েছে সেটাই ফলাফল। সুতরাং অন্যদেরকে আমরা মিছেমিছি নেতা বানিয়ে দিয়েছি।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!