ঢাকা : সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বেশি সম্পদশালী ৬ ধরনের করদাতাদের আয়কর রিটার্নে সম্পদের বিবরণী জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অবৈধ সম্পদ অর্জন ঠেকানো, অর্থ পাচার ও দুর্নীতি প্রতিরোধ করাই এর উদ্দেশ্যে। তবে এ ধরনের নীতি দুর্নীতি প্রতিরোধে পুরোপুরি কার্যকর নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। করদাতার সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের সম্পদ বিবরণী যাচাই করার পরামর্শও দেন তাঁরা।
সম্প্রতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের আয়কর পরিপত্র প্রকাশ করেছে এনবিআর। নির্দেশনায় বলা, ৬ ধরনের করদাতাকে আয়কর রিটার্নের আইটি ১০বি (২০০৩) ফরমের মাধ্যমে পরিসম্পদ, দায় ও ব্যয় বিবরণীর তথ্য দিতে হবে।
এ তালিকায় রয়েছেন—সরকারি চাকরিজীবী; ৫০ লাখ টাকার বেশি সম্পদ থাকা ব্যক্তি; সিটি এলাকায় বাড়ি-ফ্ল্যাট আছে, এমন ব্যক্তি; গাড়ির মালিক; বিদেশে সম্পদ আছে, এমন ব্যক্তি এবং যাঁরা কোনো কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার পরিচালক।
এ বিষয়ে এনবিআরের আয়কর বিভাগের এক কর্মকর্তা সোনালী নিউজকে বলেন, সম্পদের বিবরণীর মাধ্যমে একজন ব্যক্তির আগে কী পরিমাণ সম্পদ ছিল, এখন কত হয়েছে, সেটা জানা যাবে। দুর্নীতির মাধ্যমে বা অবৈধ উৎস থেকে সম্পদ অর্জনের বিষয়টিও অনুসন্ধান করা যাবে। ফলে করফাঁকি, দুর্নীতি ইত্যাদি কমানো সম্ভব হবে।
এনবিআর বলছে, সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রায়ই অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ওঠে। এ জন্য এনবিআর গণখাতের কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী বাধ্যতামূলক করেছে।
করদাতার যদি ৫০ লাখ টাকার বেশি সম্পদ অর্থাৎ বাড়ি, প্লট, অ্যাপার্টমেন্টসহ বিভিন্ন ধরনের স্থাবর সম্পদ থাকে, তাহলে সম্পদ বিবরণী জমা দিতে হবে। তবে সম্পদের মূল্য যখন তিনি যে দামে কিনেছেন বা যখন মালিক হয়েছেন, তখন বাজারদর যত ছিল, তা হিসাব করতে হবে।
কারও হয়তো ৫০ লাখ টাকার সম্পদ নেই। কিন্তু ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন সিটি করপোরেশন এলাকায় যদি বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট থাকে, তাহলে সম্পদের বিবরণী জমা দিতে হবে। এখানে সিটি এলাকায় বাড়ি–গাড়ি থাকলে ধনী লোক হিসেবেই ধরা হয়।
একজন করদাতার একটি গাড়ি আছে। কিন্তু তাঁর সব মিলিয়ে ৫০ লাখ টাকার সম্পদ নেই। তবু তাঁকে সম্পদের যাবতীয় তথ্য দিয়ে তা রিটার্নে জানাতে হবে।
কোনো করদাতার যদি দেশের বাইরে ন্যূনতম কোনো সম্পদ থাকে, তাহলেও বাংলাদেশের রিটার্ন জমার সময় সম্পদের বিবরণী দিতে হবে। কারণ, দেশের বাইরের সম্পদের খবর জানতে চায় এনবিআর। দেশে ৫০ লাখ টাকার সম্পদ না থাকলেও ওই করদাতার সম্পদের বিবরণী জমার বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয়েছে।
কেউ যদি কোনো কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার পরিচালক হন, তাহলে বছর শেষে রিটার্ন জমার সময় সম্পদের বিবরণী দিতেই হবে। সম্পদের পরিমাণ ৫০ লাখ টাকা পেরিয়ে না গেলেও বিবরণীর ফরম করে যাবতীয় তথ্য দিতে হবে।
আয়কর রিটার্নের সম্পদ বিবরণীতে যেসব তথ্য দিতে হবে, সেগুলো হলো—বাংলাদেশে অবস্থিত সম্পদের মধ্যে ব্যবসার সম্পদ, দায় ও মূলধন, শেয়ার ও অংশীদারি বিনিয়োগ, অ–কৃষি ও কৃষি জমি–ঘর, ব্যাংক আমানত, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার–বন্ড, ঋণ প্রদান, প্রভিডেন্ট ফান্ড, মোটরযান, অলংকার, আসবাব ও অন্য সম্পদসহ নগদ অর্থ। এ ছাড়া বিদেশে অবস্থিত সম্পদ থাকলেও তা জানাতে হবে। টাকার অঙ্কে সব সম্পদের যোগফল দিয়ে মোট সম্পদ লিখে করদাতার নাম, স্বাক্ষর, তারিখসহ ঘোষণা দিতে হয়।
তবে এর সমালোচনা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। সরকারের সাবেক আমলা ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া বলেন, সম্পদ বিবরণী বাধ্যতামূলক করা দুর্নীতি দমনের সবচেয়ে বড় উপায়। তবে বাংলাদেশের আইনকানুন দুর্নীতি সহায়ক। দুর্নীতিবাজ নিজের নামে সম্পদ করবে না। পরিবারের সদস্যদের সম্পদ বিবরণী বাধ্যতামূলক না করলে সুযোগ নেবেই। তাহলে এই আদেশ করেন কী করে?
তিনি আরও বলেন, আগে পরিবারের সদস্যদের হিসাব চান। যদি সম্পদ বিবরণী সঠিক মতো নেওয়া ও যাচাই করা হয় এবং সম্পদ লুকানোর জন্য বড় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়, তাহলে সরকারি কমর্কচারীদের দুর্নীতি ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাবে। ৩০ শতাংশের মতো ছোট দুর্নীতি থাকতে পারে, বড় দুর্নীতি থাকবে না। আমলাদের সহযোগিতা ছাড়া নীতিনির্ধারকেরা দুর্নীতি করতে পারে না। শাস্তি হলে আমলারা ভয়ে থাকবে, দুর্নীতি করতে চাইবে না, তাঁদের সহযোগিতা ছাড়া রাজনীতিবিদেরাও দুর্নীতি করতে পারবে না।
এএইচ/পিএস
আপনার মতামত লিখুন :