• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১৬ মে, ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

কালোটাকার প্রকৃত হিসাব নেই  


নিজস্ব প্রতিবেদক  জুলাই ১, ২০২১, ০৭:১২ পিএম
কালোটাকার প্রকৃত হিসাব নেই  

ঢাকা : ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ না দেওয়া হলেও অর্থবিলে ওই সুযোগ রেখে পাস করা হয়েছে। প্রকৃত ব্যবসায়ীরা এর বিরোধিতা করলেও দেশের অর্থনীতিতে প্রচুর পরিমাণে কালোটাকা সাদা হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। কিন্তু কী পরিমাণ কালো বা অপ্রদর্শিত অর্থ বাংলাদেশের মানুষের হাতে রয়েছে, তার কোনো প্রকৃত হিসাব নেই। 

এনবিআরের এক হিসাব বলছে, স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে জরিমানা দিয়ে বৈধ করা মোট টাকার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা। আর গত এক বছরেই সব মিলিয়ে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবির করা ‘অদৃশ্য অর্থনীতি’ শীর্ষক এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, জিডিপির ১০ থেকে ৩৮ শতাংশের মধ্যে কালোটাকা ওঠানামা করে।

অবশ্য সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে (সুইস ব্যাংক) বাংলাদেশিদের টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৬ কোটি ২৯ লাখ ফ্র্যাংক। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৫ হাজার ২৯১ কোটি টাকা (প্রতি সুইস ফ্র্যাংক ৯৪ টাকা হিসাবে), যদিও বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে কাউকে সেখানে টাকা নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি।

অর্থনীতিবিদরা বলেন, সুইস ব্যাংকের এই টাকার সবই অপ্রদর্শিত বা কালোটাকা। এর অধিকাংশই বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে সেখানে গেছে। কালোটাকা সাদা করা নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনার পরও নগদ টাকা, শেয়ারবাজার, জমি-ফ্ল্যাটে কালো টাকার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে নতুন অর্থবছরের বাজেটে। অর্থাৎ ঢালাওভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখা হয়েছে। তবে গত অর্থবছরের মতো ১০ শতাংশ হারে কর দিয়ে নয়, এবার কালোটাকা সাদা করতে হলে ২৫ শতাংশ কর এবং ওই করের ওপর ৫ শতাংশ জরিমানা দিতে হবে।

নগদ টাকা, ব্যাংকে রাখা টাকা, সঞ্চয়পত্র কিনেও টাকা সাদা করা যাবে। একইভাবে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে চাইলে একই হারে কর ও জরিমানা দিয়ে কালোটাকা সাদা করা যাবে। জমি ও ফ্ল্যাট কিনে এলাকা ও আয়তনভেদে নির্ধারিত কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করা যাবে। আজ ১ জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত এ সুযোগ পাওয়া যাবে। এ ছাড়া ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা দিয়ে নতুন শিল্পকারখানা করা যাবে। অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে ১০ শতাংশ কর দিয়ে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কালো টাকা সাদা করার বিদ্যমান সুযোগটিও অব্যাহত আছে। কালোটাকা সাদা করলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ছাড়া অন্য কোনো সংস্থাও প্রশ্ন করবে না।

গত মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে ২০২১ সালের অর্থবিল পাসের সময় কিছু ধারা সংশোধন করে পাস করা হয়েছে। সেখানে নগদ টাকা, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংকে রাখা টাকার পাশাপাশি শেয়ারবাজার, ফ্ল্যাট-জমিতে বিনিয়োগ করে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ কর ও জরিমানা দিয়ে আরো এক বছরের জন্য বাড়ানো হয়েছে। এ জন্য অর্থবিলের মাধ্যমে আয়কর অধ্যাদেশে একাধিক ধারা সংযুক্ত করা হয়েছে।

এনবিআরের তথ্যমতে, গত এক বছর ধরে নগদ টাকা সাদা করায় বেশি আগ্রহ ছিল করদাতাদের। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে সব মিলিয়ে ১০ হাজার ৩৪ জন করদাতা কালোটাকা সাদা করেছেন। সব মিলিয়ে গত এক বছরে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে। গত জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত মাত্র ৩৪১ জন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ নিয়েছেন।

এদিকে কালো টাকার প্রকৃত পরিমাণ জানা না গেলেও গবেষক ও অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাতের গবেষণামূলক ‘বড়পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র’ নামের গ্রন্থে বলা হয়েছে, দেশের ৪৭ বছরের ইতিহাসে কালোটাকার অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ৮৮ লাখ ৬১ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা। মোটা অঙ্কের এই অর্থ একই সময়ের জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) ৩৩ দশমিক ৩ শতাংশ। আবুল বারকাতের মতে, ‘সবচেয়ে বেশি কালোটাকা সৃষ্টি হয়েছে আয়কর, মুনাফার ওপর কর এবং মূলধন কর ফাঁকির মাধ্যমে।

কালোটাকা সৃষ্টির উৎস উল্লেখ করে ওই বইয়ে বলা হয়েছে, সবচেয়ে বেশি হয়েছে আয়কর, মুনাফার ওপর কর এবং মূলধন কর ফাঁকি থেকে। মোট কালোটাকার মধ্যে এই তিন খাত থেকে ৩৫ দশমিক ৯ শতাংশ এসেছে। এরপর মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট ফাঁকি থেকে কালোটাকা হয়েছে ১৩ দশমিক ১ শতাংশ। সরকারি ও বেসরকারি কর্মকাণ্ড পরিচালনায় ঘুষ থেকে কালোটাকা হয়েছে ১২ শতাংশ। এভাবে চোরাচালান থেকে এসেছে ১০ দশমিক ৯ শতাংশ, সম্পূরক শুল্ক ফাঁকি থেকে এসেছে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ, অন্যান্য অবৈধ খাত থেকে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং আমদানি শুল্ক ফাঁকির মাধ্যমে এসেছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ কালোটাকা।

ড. আবুল বারকাত বলেন, ‘কালোটাকা সৃষ্টির উৎসগুলো বন্ধ করা উচিত।’ কালোটাকা সাদা করার সুযোগ না দিয়ে কালোটাকা উদ্ধার করে ঘাটতি বাজেট পূরণ করা সম্ভব বলেও জানান তিনি।

‘বড়পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র’ বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর কালোটাকার পরিমাণ বেড়েছে। এই বইতে দেখানো হয়েছে-১৯৭২-৭৩ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত ৪৭ বছরে কালোটাকা হয়েছে ৮৮ লাখ ৬১ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে কালোটাকা হয়েছে ১৮ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। ১৯৭৩-৭৪ এই অঙ্ক বেড়ে দাঁড়ায় ২৬ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা। এভাবে প্রতি বছরই কালোটাকার পরিমাণ বেড়েছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!