• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৭ মে, ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
আজ পহেলা বৈশাখ

নতুন স্বপ্ন, প্রত্যাশা আর সম্ভাবনা নিয়ে এলো ১৪৩১


নিজস্ব প্রতিবেদক এপ্রিল ১৪, ২০২৪, ১১:২৪ এএম
নতুন স্বপ্ন, প্রত্যাশা আর সম্ভাবনা নিয়ে এলো ১৪৩১

ঢাকা : চৈত্রের আলো নিভে ভোরের নতুন সূর্যের অপেক্ষায় কোটি বাঙালির প্রাণ; ১৪৩১ বঙ্গাব্দের প্রথম প্রভাতে জীর্ন-মলিন অতীত আর কূপমণ্ডুকতা ঝেরে ফেলে মানবের জয়গানে বাজবে বর্ষবরণের সুর।

অতীতের সকল ব্যর্থতা, গ্লানি মুছে ফেলার প্রত্যয়ে সমবেত কণ্ঠে ধ্বনিত হবে- ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো...’।

বিশ্বব্যাপী মূল্যবোধের ক্ষয় আর মানুষে মানুষে দূরত্ব ঘুচিয়ে সম্প্রীতির সাধনায় বাঙালি মনুষ্যত্বের জয়গান হবে নতুন বছরের প্রথম সকালে। নতুন দিনের প্রত্যয় আর অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখার বলিষ্ঠ উচ্চারণে ১৪৩১ বঙ্গাব্দকে বরণ করে নিতে প্রস্তুত বাংলাদেশ।

রোববার (১৪ এপ্রিল) সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ মেতে উঠবে উৎসবে; রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণের আয়োজন দেবে আপনা মাঝে ‘আলো জ্বালবার’ মন্ত্র; আর চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রায় বাজবে ‘তিমির হননের গান‘। 

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীকে নতুন বঙ্গাব্দের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। দুজনের শুভেচ্ছা বাণীতেই প্রত্যাশা আনন্দময় সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে এগোনোর।  

পঞ্জিকার পাতা উল্টে ১৪৩০ থেকে ১৪৩১ সাল আসা সাধারণ ঘটনা হলেও বাঙালির জীবনে এই সাধারণ ঘটনার শুরুই হয় ভিন্ন মাত্রা নিয়ে।

কৃষি উৎসব বা রাজস্ব আদায়ের উপলক্ষ হিসেবে বৈশাখকে সামনে এনে বাংলা সাল প্রবর্তনের পর বাঙলার অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে তার প্রভাব ছিল ব্যাপক। বৈশাখের সেই উদযাপন রাজনৈতিক হয়ে ওঠে পাকিস্তান শাসনামলে।

পাকিস্তানের সেনাশাসক আইয়ুব খানের সময় যখন বাঙালির বাঙালিয়ানা নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করা হল, তখন এই বর্ষবরণ উৎসব হয়ে উঠেছিল বাঙালির আত্মপরিচয় টিকিয়ে রাখার রাজনৈতিক হাতিয়ার। সেই চেতনাই পরে বাংলাদেশকে জাতিরাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীনতার বন্দরে পৌঁছে দেয়।

অসাম্প্রদায়িক চেতনায় গড়ে ওঠা বাংলাদেশকে পরেও নানা সংকটে দিশা দেখিয়েছে পহেলা বৈশাখের উৎসব; সে কারণেই এ দেশকে উল্টো পথে নেওয়ার চেষ্টায় বার বার আঘাত এসেছে এ উৎসবে।

ফলে গত কয়েক বছরের মত এবারো বর্ষবরণের আয়োজন ঘেরা থাকবে নিরাপত্তার চাদরে। সেজন্য ডিএমপি ও র‌্যাবের কনট্রোল রুম বসানো হয়েছে। রমনা বটমূলের আয়োজনে আলাদা প্রবেশ ও নির্গমন পথ করা হয়েছে। সিসিটিভি ক্যামেরার পাশাপাশি নজর রাখছে গোয়েন্দা বাহিনী।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে বর্ষবরণের আয়োজন বিকাল ৫টার মধ্যে শেষ করতে বললেও এবার তা মানতে নারাজ সাংস্কৃতিক কর্মীরা। সময়ের ঘেরাটোপ না মেনে সন্ধ্যার পরও তারা অনুষ্ঠান চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন।

রমনার বটমূলে বর্ষবরণের সব প্রস্তুতি সেরেছে ছায়ানট। মঙ্গল কামনায় পথ রাঙাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রা। এর বাইরে গোটা দেশেই ছোট-বড় আয়োজনে রয়েছে বর্ষবরণের।

জাকজমকপূর্ণ আয়োজনে পহেলা বৈশাখ যেন ‘একদিনের বাঙালির’ সাজার রেওয়াজ না হয়, সে কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছেন ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি সারওয়ার আলী।

নববর্ষ উদযাপনকে সর্বজনের ভ্রাতৃত্ববোধের মিলনমেলায় পরিণত করার প্রত্যয়ে তিনি বলছেন, সমাজের মধ্যেই একটা অবক্ষয় তৈরি হয়েছে। সমাজের রুচির পরিবর্তন হয়েছে। সমাজের এই ক্ষতটা নিরাময় করতে সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটাতে হবে।

চৈত্রের শেষ দিনে হালখাতা করে ব্যবসার হিসাব চুকানো বাংলার পুরনো রেওয়াজ। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের বাণীতে কণ্ঠ মিলিয়ে বৈশাখের প্রথম দিন বাঙালির প্রত্যাশা থাকে- বৈশাখের রুদ্র ঝড় পুরনো বছরের আবর্জনা উড়িয়ে নেবে; গ্রীষ্মের অগ্নিস্নানে শুচি হবে বিশ্ব ধরা।

বর্ষবরণের আগে শনিবার চৈত্র সংক্রান্তির নানা আয়োজনে বিদায় ঘটেছে ১৪৩০ বঙ্গাব্দের। শেষ দিনে হালখাতার হিসাব চুকানোর পুরনো রেওয়াজেও থাকে উৎসবের আমেজ।

এবার বর্ষবরণের ছুটি যোগ হয়েছে ঈদের ছুটির সঙ্গে। তাতে যে বাড়তি আনন্দ যোগ হয়েছে, সে কথাই বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেনভ

তিনি বলেন, ঈদের পর পর বর্ষবরণ হওয়ার কারণে ঢাকায় লোক হয়ত কম থাকবে, তবে সারা দেশেই বর্ষবরণের আনন্দ দ্বিগুণ মাত্রা পাবে। ঘরে ঘরেই নানা আয়োজনে বর্ষবরণ হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কবি সুফিয়া কামালের ভাষায় দেশবাসীকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছেন, পুরাতন গত হোক/ যবনিকা করি উন্মোচন/ তুমি এসো হে নবীন/হে বৈশাখ/নববর্ষ/এসো হে নতুন।

‘আপনি জ্বালো এই তো আলো’

পহেলা বৈশাখের ভোরে আহীর ভৈরব রাগে বাঁশির সুরে নতুন বছর বন্দনার উৎসব শুরু করবে ছায়ানট।

সাংস্কৃতিক সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা বলেন, নববর্ষের প্রথম প্রভাতে আমরা মানুষের জয়গান করব, ভোগবাদ নয়, স্বার্থপরতা নয় মনুষ্যত্বকে পাওয়ার অভিলাষে ছায়ানটের আহ্বান, স্বাভাবিকতার সাধনা এবং সম্প্রীতির ধ্যান ‘দূর করো আত্মকেন্দ্রিকতা, আপনি জ্বালো এই তো আলো’।

পুরো অনুষ্ঠান সাজানো হয়েছে নতুন স্নিগ্ধ আলোয় স্নাত প্রকৃতির গান, মানবপ্রেম, দেশপ্রেম আর আত্মবোধ জাগরণের সুরবাণী দিয়ে। যোগ হয়েছে জাতীয় কবির কালজয়ী সৃষ্টির বিজাতীয় অবমাননার প্রতিবাদ এবং লেখনীর দুর্দম শক্তিতে বাঙালির গণজাগরণে স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে চলা আবু বকর সিদ্দিককে স্মরণ।

১৯৮৮ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি আবুবকর সিদ্দিক গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর খুলনার সিটি হাসপাতালে প্রয়াত হন। ঔপন্যাসিক, লেখক এবং ছোট গল্পকার হিসেবেও সাহিত্য অঙ্গনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এই অধ্যাপকের বিচরণ। বর্ষবরণের আয়োজনে তাকে স্মরণ করছে ছায়ানট।

বর্ষবরণের আয়োজন ঘিরে আড়াই মাস আগে থেকেই ছায়ানটের শতাধিক শিল্পী গান তোলা আর গলা মেলানোর কাজে নামেন।

সংগঠনটির যুগ্ম সম্পাদক জয়ন্ত রায় বলেন, এবার আয়োজনে সম্মেলক গান থাকবে ১১টি, একক গান ১৫টি এবং পাঠ ও আবৃত্তি থাকবে।

শুরুতেই থাকবে রাগসংগীত। একক গান শোনাবেন শাহীন সামাদ, খাইরুল আনাম শাকিল, চন্দনা মজুমদার, লাইসা আহমেদ লিসাসহ অনেকে। পাঠ ও আবৃত্তিতে অংশ নেবেন রামেন্দু মজুমদার ও জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়।

ঢাকার রমনা উদ্যানে দুই ঘণ্টাব্যাপী ছায়ানটের আয়োজন সরাসরি সম্প্রচার করবে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার। ছায়ানটের ইউটিউব চ্যানেলেও অনুষ্ঠান দেখা যাবে।

নববর্ষ উদযাপন ঘিরে ছায়ানটের পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী বস্তুর প্রতি মানুষের আকর্ষণ যেভাবে বেড়েছে সেভাবে কমেছে মানুষের প্রতি মমত্ববোধ। ফলে ক্ষয়ে চলেছে মানবতা, ক্রমান্বয় অবক্ষয় ঘটছে মূল্যবোধের। মানুষের সঙ্গে মানুষের দূরত্বের ক্রমবৃদ্ধিতে, অন্য মানুষের প্রতি আচরণের অস্বাভাবিকতায় আজ আমরা মুখোমুখি নতুন সংকটের।

তবে এই সংকটে আমরা আশাহত হই না, দিশা হারাই না, বিশ্বাস করি মানুষের কাছে গিয়ে, মানুষের হাতে হাত রেখে সকলের সাথে মিলবার, চলবার, গাইবার সাধনাই মানুষকে আবার ফিরিয়ে আনবে মানুষের কাছে। স্বাভাবিকতা ও পরস্পরের প্রতি সম্প্রীতির সাধনায় আমাদের যুক্ত হতে হবে।

মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসার শক্তিতে বাঙালি মনুষ্যত্বের জয়গান করার প্রত্যয় জানিয়ে বলা হয়, কত শতাব্দী করেছি মা পাপ মানুষেরে করি ঘৃণা, জানি মা মুক্তি পাব না তাহার প্রায়শ্চিত্ত বিনা, পরম প্রত্যয়ে বলবে হিংসা আর নিন্দা ছাড়ো মনটা করো পরিষ্কার।

মানুষকে ভালবেসে নিজেকে সার্থক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। আঁধার রজনী শেষে নবীন আলোয় নবীন আশায় নবীন জীবন লাভ করে সুদিনের পথে চলব আমরা, বাঙালিকে বলব, নাই নাই ভয় হবে হবে জয়।

ছায়ানট সাধারণ সম্পাদক লিসা বলেন, সকলকে নিয়ে শুভ কর্মপথে চলবার, কণ্ঠে নির্ভয় গান তুলে নেবার ছায়ানটের এই আয়োজন সার্থক হবে সর্বজনের সমর্থন, অংশগ্রহণ এবং উপলব্ধিতে।

মঙ্গল শোভাযাত্রা : নববর্ষ উদযাপনের আয়োজনে রোববার সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেবে বের হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা।

আমরা তো তিমিরবিনাশী’ প্রতিপাদ্যে এই শোভাযাত্রা শাহবাগ মোড় হয়ে শিশুপার্কের সামনে দিয়ে ঘুরে ফের শাহবাগ হয়ে টিএসসিতে গিয়ে শেষ হবে।

নববর্ষ উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ বলেন, অন্ধকারের বিরুদ্ধে আমরা আলোর দিশারী। অন্ধকার ভেদ করে আমরা সমাজে আলো ছড়াতে চাই। এজন্যই আমরা এবার প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছি- ‘আমরা তো তিমিরবিনাশী’। কবি জীবনানন্দ দাশের ‘তিমির হননের গান’ কবিতার পঙতি থেকে এই প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

এবারের আয়োজনে চারটি বড় মোটিভ বা শিল্পকর্ম তৈরি করার কথা জানিয়েছেন চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন।

চারটি মোটিফের মধ্যে রয়েছে পাখি, হাতি, ভোঁদর এবং চাকার মধ্যে চোখ নিয়ে ভিন্ন রকম একটি শিল্পকর্ম।

নিসার হোসেন জানান, প্রতি বছরই আমরা আমাদের লোকজ মাটির পুতুল থেকে এসব মোটিফ (শিল্পকর্ম) তৈরি করি। বড় মোটিফের পাশাপাশি অনেকগুলো ছোট ছোট শিল্পকর্মও থাকবে।

আশির দশকে সামরিক শাসনের অর্গল ভাঙার আহ্বানে পহেলা বৈশাখে চারুকলা থেকে যে শোভাযাত্রা বের হয়েছিল সেটিই পরে মঙ্গল শোভাযাত্রায় রূপ নেয়। ২০১৬ সালে ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতিও পায় এ কর্মসূচি।

সাধারণত চারুকলা অনুষদের শেষবর্ষের শিক্ষার্থীরা মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের প্রস্তুতির দায়িত্ব পালন করে থাকেন। সে অনুযায়ী এবার অনুষদের ২৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা প্রস্তুতির মূল দায়িত্বে রয়েছেন। তারা শোভাযাত্রার বিভিন্ন মোটিফ ও শিল্পকর্ম তৈরি করেছেন। এবারো শিল্পকর্ম বিক্রি থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়েই মঙ্গল শোভাযাত্রার ব্যয় নির্বাহের কথা জানিয়েছেন তারা।

আরো যা আয়োজন : বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে প্রতিবছর বৈশাখী মেলা হলেও এবার তা শুরু হবে দেরিতে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) ও বাংলা একাডেমি এ মেলার আয়োজন করে থাকে।

বিসিকের জনসংযোগ কর্মকর্তা পারুল আক্তার কেয়া বলেন, ঈদের পর পর (পহেলা বৈশাখ) হওয়ায় দর্শক সমাগম হবে কিনা- সেই শঙ্কা থেকে পহেলা বৈশাখে মেলা হচ্ছে না। তবে এক সপ্তাহ বা ১০ দিন পর থেকে হবে। তারিখ চূড়ান্ত হলে সবাইকে জানানো হবে।

বাংলা একাডেমির উপপরিচালক সাইমন জাকারিয়া বলেন, “বার বাংলা একাডেমি আয়োজন করবে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সকাল ৮টায় থাকবে বর্ষবরণ বক্তৃতা, গান ও অন্যান্য আয়োজন।

ঢাকার উত্তরায় দিয়াবাড়ি আমতলায় (মেট্রোরেল গোলচত্বর) বর্ষবরণের অনুষ্ঠান আয়োজন করবে উত্তরা বর্ষবরণ উদযাপন পর্ষদ। সকাল ৭টায় শুরু হবে তাদের অনুষ্ঠান।

বেলা ১১টায় বর্ষবরণের আয়োজন রয়েছে শিল্পকলা একাডেমির। জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে হবে এ অনুষ্ঠান।

বন্দরনগরী চট্টগ্রামে মূলত দুইটি স্থানে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের বড় অনুষ্ঠান হয়। এর একটি ডিসি হিলে এবং অপর দুইটির একটি সিআরবি শিরীষ তলায়। এছাড়া জেলা শিল্পকলা একাডেমিতেও পহেলা বৈশাখের আয়োজন রয়েছে। 

নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা : বর্ষবরণের আয়োজন ঘিরে পুরো রমনা পার্ক এলাকা নিরাপত্তা চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। ডিএমপি, র‌্যাবের কন্ট্রোল রুম বসানো হয়েছে। আলাদা প্রবেশ ও নির্গমন পথ করা হয়েছে।

বর্ষবরণের মূল আনুষ্ঠানিকতা ঘিরে ঢাকা মহানগর পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যালোনা করেছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় ডিএমপি কমিশনার মো. হাবিবুর রহমান এবং দুপুর ১২টায় র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ানের মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম রমনার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঘুরে দেখেন।

এ সময় পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, নববর্ষের এই অনুষ্ঠান বাঙালি জাতিসত্তার অসাম্প্রদায়িক চেতনার একটি মূর্ত প্রকাশ। সেজন্য এটির ওপর বার বার আঘাত এসেছে, সহিংস হামলা হয়েছে, জঙ্গি হামলা হয়েছে। সেজন্য সবকিছু মাথায় রেখেই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ নিরাপত্তা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। যদিও কোনো হামলার শঙ্কা নেই। আমরা সকলের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি, সাংবাদিকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।

বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিষয় তুলে ধরে তিনি বলেন, রমনা বটমূল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শহীদ মিনার, রবীন্দ্র সরণী, আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র, হাতিরঝিলসহ সারা ঢাকায় বিভিন্ন সংগঠন অনুষ্ঠান করবে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ এসব অনুষ্ঠানে নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। যেসকল জায়গায় অনুষ্ঠান হবে প্রত্যেকটি জায়গায় সিসিটিভি ক্যামেরা দ্বারা নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হবে। ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। ড্রোন ভিউ দ্বারা নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হবে।

এছাড়া ভিডিও ক্যামেরা থাকবে। অনুষ্ঠানস্থলের আশপাশের এলাকায় অনুষ্ঠান শুরুর আগে সুইপ করা হবে এসবির ইকুইপমেন্ট এবং ডিএমপির ডগ স্কোয়াড দ্বারা। ইতিমধ্যে এই কাজগুলো শুরু হয়ে গেছে। বম ডিসপোজাল ইউনিট স্ট্যান্ডবাই থাকবে, তারা ইতোমধ্যে মহড়া করেছে।

নববর্ষ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রমনা পার্ক এলাকায় যানবাহন চলাচল শনিবার সন্ধ্যা থেকেই নিয়ন্ত্রণের কথা জানান ডিএমপি কমিশনার। নববর্ষের দিনে নিরাপত্তার স্বার্থে কিছু কিছু জায়গায় যানবাহন ডাইভারশন করা হবে।

রমনা এলাকায় ডিএমপি, র‌্যাব ছাড়াও সোয়াত, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাও নিয়োজিত রয়েছে। 

মুখ ঢাকা যাবে না মুখোশে : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বর্ষবরণের সব আয়োজন বিকাল ৫টার মধ্যে শেষ করাসহ ভুভুজেলা বাজানো ও বিক্রি করা থেকে বিরত থাকতে সবার প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

বর্ষবরণের আয়োজনে মুখোশ নিষিদ্ধ কিনা– এমন প্রশ্নে অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেছিলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রায় আমরা যে মুখোশ তৈরি করি সেগুলো হাতে রাখতে হয়, এ ধরনের মুখোশ ব্যবহার করা যাবে। তবে নিরাপত্তার কারণে মুখ ঢেকে কোনো মুখোশ ব্যবহার করা যাবে না।

কারণ অনেকে মুখোশে মুখ ঢেকে নানা রকম অপরাধ মনোবৃত্তি নিয়ে আসে। এজন্য মুখোশ ব্যবহার করা যাবে, তবে মুখোশে মুখ ঢাকা যাবে না।

'সময়ের ঘেরাটোপ’ চান না সংস্কৃতিকর্মীরা : রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, হাতিরঝিল ও রবীন্দ্র সরোবরসহ দেশে খোলা জায়গায় বর্ষবরণের আয়োজন এবার সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে শেষ করার নির্দেশনা দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অপরদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসে বর্ষবরণের সব আয়োজন বিকাল ৫টার মধ্যে শেষ করার অনুরোধ জানিয়েছে।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ ও সাধারণ সম্পাদক আহকামউল্লাহ গত ২৯ মার্চ এক বিবৃতিতে সময়ের এই বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের দাবি জানান।

কিন্তু কর্তৃপক্ষ সেই দাবি না মানায় এবার নিষেধাজ্ঞা ভেঙে অনুষ্ঠান করার ঘোষণা দিয়েছে সংগঠনটি। পহেলা বৈশাখের বিকাল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে হবে জোটের সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

সময়ের বিধিনিষেধ মানতে চায় না বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীও। বর্ষবরণের দিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করবে এ সংগঠন।

গত ৭ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনে সাংস্কৃতিক সংগঠক রামেন্দু মজুমদার বলেন, এই মঙ্গল শোভাযাত্রায় মানুষ যেন নির্ভয়ে আসতে পারে তার ব্যবস্থা যেমন করতে হবে। আবার নিরাপত্তার নামে যেন এটাকে দেখতে প্যারেডের মত মনে না হয়। সেটিও ভাবতে হবে।

রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা : বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে এক বাণীতে জাতিকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।

তিনি বলেন, বৈশাখ শুধু উৎসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের আত্মবিকাশ ও বেড়ে ওঠার প্রেরণা। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও মুক্তিসাধনায় পহেলা বৈশাখ এক অবিনাশী শক্তি। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও গণতান্ত্রিক বিকাশে সংস্কৃতির এই শক্তি রাজনৈতিকতন্ত্রের চেতনাকে দৃঢ় ও বেগবান করে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাষ্ট্রদর্শন ও আদর্শের অন্যতম ভিত্তি ছিল দেশীয় সংস্কৃতির বিকাশ ও জাতীয় চেতনার উন্মেষ, সে কথা মনে নববর্ষের বাণীতে মনে করিয়ে দিয়েছেন রাষ্ট্রপ্রধান।

তিনি বলেন, সেই চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বঙ্গবন্ধু কারারুদ্ধ জীবনে সহবন্দিদের নিয়ে নববর্ষ উদযাপন করেছিলেন। পহেলা বৈশাখ আমাদেরকে উদার হতে শিক্ষা দেয় এবং জাতীয়তাবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে বিশ্বমানবের সঙ্গে মিশে যাওয়ার শক্তি জোগায়।

এই উদারনৈতিক চেতনাকে ধারণ করে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদর্শন, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আদর্শ এবং রাষ্ট্রভাষা চেতনার বহ্নিশিখা অন্তরে ধারণ করে ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত, সুখী-সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ হোক আজকের দিনে সকলের অঙ্গীকার।

রাষ্ট্রপতি বলেন, সকল অশুভ ও অসুন্দরের ওপর সত্য ও সুন্দরের জয় হোক। ফেলে আসা বছরের সব শোক-দুঃখ-জরা দূর হোক, নতুন বছর জাতীয় ও ব্যক্তিজীবনে নিয়ে আসুক অনাবিল সুখ ও সমৃদ্ধি – এ প্রত্যাশা করি।

দেশবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেন, আবহমান কাল ধরে নববর্ষের এই উৎসবে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র জাতি জেগে ওঠে নবপ্রাণ স্পন্দনে, নব-অঙ্গীকারে। সারা বছরের দুঃখ-জরা, মলিনতা ও ব্যর্থতাকে ভুলে বাঙালি রচনা করে সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, আনন্দ ও ভালোবাসার মেলবন্ধন।

পহেলা বৈশাখকে ‘বাঙালিয়ানার প্রতিচ্ছবি’ হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, এই উদযাপন আমাদের শেকড়ের সন্ধান দেয়, এর মধ্য দিয়ে খুঁজে পাওয়া যায় জাতিসত্তার পরিচয়।

শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসাম্প্রদায়িক, উদারনৈতিক, জাতীয়তাবাদী ও গণতন্ত্রের ভাবাদর্শে আজীবন যে সংগ্রাম করে গেছেন তার মূলমন্ত্র জাতিগত ঐতিহ্য ও অহংকার। একারণেই  বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন এবং দেশ পুনর্গঠনে কাজ করেছে তার অভিন্ন চেতনা।

আমরা বীরের জাতি, এ জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। কাল থেকে কালান্তরের পথ পরিক্রমায় বাঙালির অর্জন ও অগ্রগতি চির ভাস্বর হয়ে থাকবে, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!