• ঢাকা
  • বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

‘বিশ্ব ভালোবাসায়’ আড়াল পড়েছে জয়নাল-দীপালিরা!


জুবায়ের রহমান চৌধুরী ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০১৭, ০৭:১৪ পিএম
‘বিশ্ব ভালোবাসায়’ আড়াল পড়েছে জয়নাল-দীপালিরা!

‘ভালোবাসতে বিশেষ দিনক্ষণ লাগে না। ভালোবাসা সার্বজনীন। এর উষ্ণ আবেশ কখন যে তোমায় পরশ বুলাবে, তা বলা মুশকিল। ভালোবাসা, শুধুই ভালবাসা।’ যদ্দুর মনে পড়ে, ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখের দু’একদিন আগে এমনই একটি অভিব্যক্তি জানিয়েছিলেন আমার কবি বন্ধু শরৎ মহানন্দ।

তবে গত দু’বছর আগে ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’ হিসেবে বিশেষ মর্যাদা কিংবা গুরুত্ব থাকলেও এখন তা নেই। এর অবশ্য একটি যৌক্তিক কারণ রয়েছে। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেই। সেজন্য বিভিন্ন লোকের কাছে লেখা চাই।

স্বভাবতই ওই মাসে ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’ থাকায় এ বিষয়ে একটি লেখা চাই জহুর ভাইয়ের কাছে। এলাকার বড় ভাই জহুরুল হক জহুর এক সময় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। তিনিই প্রথম সেদিন আমায় জানালেন, তথাকথিত ভালোবাসা দিবসের আড়ালে ঢাকা পড়েছে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের এক মর্মন্তুদ ইতিহাস।

ফিরে দেখা: ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। প্রতিদিনের মতো সে দিনটি বিশেষ কোন দিন ছিল না। তবে সেই বছরটি, শুরু থেকেই ছিল উত্তাল। জনবিরোধী ‘মজিদ খান শিক্ষানীতি’ বাতিল দাবির কারণে। ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান ও স্বাধীনতা যুদ্ধের মতোই এখানেও অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন সাধারণ ছাত্রসমাজ।

১৪ ফেব্রুয়ারি গণবিরোধী শিক্ষানীতি প্রত্যাহার, ছাত্রবন্দিদের মুক্তি ও দমননীতি বন্ধ এবং গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে ঢাকায় ছাত্র জমায়েত, সচিবালয় অভিমুখে বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান ধর্মঘটের ডাক দেয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। সকাল থেকেই ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে সচিবালয় ও তার আশপাশ।

গণতন্ত্রকামীদের আন্দোলনে স্বৈরাচারী শাসক লেলিয়ে দেয় পুলিশ। তাদের গুলিতে তখন শহীদ হন জাফর, শিশু পথচারী দীপালি সাহা, জয়নালসহ ১০ তাজা প্রাণ। নব্বইয়ের দশকের স্বৈরাচার বিরোধী গণঅভ্যুত্থানের উন্মেষ ঘটেছিল সেদিনই। কিন্তু ভেবে দেখুন এমনই এক ইতিহাস আমরা ভুলতে বসেছি। ন্যায্য অধিকার আদায়ে ১০ তাজা প্রাণের আবদানের দিনটিকে আমরা এভাবে ভুলে গেলাম। ধিক, ধিক নিজেকেই ধিক।

সারা বছর আমাদের হৃদয়ে ভালোবাসা থাকুক না থাকুক, বছরের এই একটি দিনে (১৪ ফেব্রুয়ারি) আমরা যেন ভালোবাসার পসরা সাজিয়ে বসি! ইদানিং কর্পোরেট আগ্রাসনে তা আরো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

তাই বলা যায়, কর্পোরেট ভালোবাসায় ভুলে গেছি জয়নাল, জাফর-দীপালিদের। আমরা তাদের মনে রাখি না। মনে রাখার চেষ্টাও করি না। রাখবো কি করে, আমরা আত্মত্যাগের এ ইতিহাস পাঠই করিনি। সতের ক্লাস পাস করেছি, কোন বইয়ের সিলেবাসেও তো এ বিষয়ে কোন নিবন্ধ পাইনি। এর দায় কার?

স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের আরেক শহীদ নূর হোসেনের আত্মত্যাগের দিনটি নীরবে আসে, নীরবে যায়। সংবাদমাধ্যমে কেবল ‘আজ নূর হোসেন দিবস’ টাইপের একটা যৎসামান্য প্রতিবেদন। সঙ্গে সেই ট্রেডমার্ক ছবি, বুকে-পিঠে লেখা ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’।

পর দিনের পত্রিকা খুলে নূর হোসেন দিবস পালনের বেশি খবর দেখা যায় না। অথচ এই নূর হোসেনদের রক্তের বিনিময়ে আজ গণতান্ত্রিক হাওয়া-বাতাস খেয়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল সরকার চালান অথবা বিরোধী দলে থাকেন, তারাও সাংগঠনিকভাবে এ নিয়ে খুব একটা মাতেন না। বোধ করি এর চেষ্টাও করেন না।

নামস্বর্বস্ব কিছু সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন এ দিনে আলোচনা সভার আয়োজন করেন। এটা দায়মুক্তির চেষ্টা। তারপরও বলব, শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে সংবাদমাধ্যমের যে তোড়জোড় দেখা যায়, জয়নাল-দীপালিদের আত্মত্যাগের দিনটি যেন তার চেয়ে বেশি উপেক্ষিত।

পাশ্চাত্যের ভ্যালেন্টাইনস দিবসকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ভালোবাসা দিবসে পরিণত করে তা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টায় সফল হয়েছে একটি মহল। আমরা এখন সেই দিবসে বুঁদ হয়ে থাকি। আর আমাদের কর্পোরেটগুলো সেটিকে অতিমাত্রায় ব্যবসায়িক মুনাফায় রূপান্তর করেছেন। কারণ তারা জেনে গেছেন, বাঙালি ইতিহাস খোঁজার চেষ্টা করেন না, তারা আনন্দকে মধুময় করতে ব্যস্ত থাকেন সবসময়। কিন্তু নিজের ইতিহাসের দিনটিকে বেমালুম ভুলে যান!

‘ছাত্র রাজনীতি তার গৌরবময় অতীত ভুলে বিপথে চলছে’ এ জাতীয় মন্তব্যে মুখরিত রাখার চেষ্টা করে আমাদেরই তথাকথিত ‘সুশীল সমাজ’। কিন্তু ১৪ ফেব্রুয়ারির মতো ছাত্র রাজনীতির গৌরবময় দিনগুলো যাতে আমরা ভুলে না যাই, সেই চেতনাকে জাগাতে চেষ্টা করছি ক’জন? আমরা কেন এই ইতিহাসগুলোকে তুলে এনে নিজেদের আত্মপরিচয়ের সন্ধানে উদ্বুদ্ধ করছি না?

জয়নাল, জাফর-দীপালিরা দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবেসে, মুক্তবুদ্ধির চর্চার দুয়ার খুলে দিতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। আমরা তাদের শ্রদ্ধা জানাই, তাদের আত্মদানকে ভালোবাসি। আমাদের এ নিখাদ ভালোবাসায় কোনো কর্পোরেট ধান্ধা নেই। আসুন আমরা প্রতিজ্ঞা করি, আজকের পরে আর কোনদিন আমরা ভালোবাসা দিবসে বুঁদ হবো না।

এ দিনটিতে আমরা ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালন করবো। তবে গত পনের বছর ধরে সারা বিশ্বের নির্যাতিত নারীদের জন্য মার্কিন নারী আন্দোলন নেত্রী ইভের উদ্যোগে ‘ওয়ান বিলিয়ন রাইজিং’ কর্মসূচি পালন করছে। চলতি বছর আমাদের দেশেও তা পালিত হবে। এর প্রতি আমাদের আকুণ্ঠ সমর্থন রয়েছে। তবে ভুলে গেলে চলবে না আমাদের চেতনা জাগানিয়া বাঙালির সুদীর্ঘ সংগ্রামী ইতিহাস।

১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৩, আজ থেকে এই দিনটিতে জাফর-দীপালিসহ সেইসব বীর সন্তানদের স্মরণ করি সভা-সেমিনার কিংবা স্লোগানে স্লোগানে রাজপথ কাঁপিয়ে। আমাদের ভালবাসা বিলিয়ে দেই তাদের, যারা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে আমাদের গণতন্ত্রের পথকে মসৃণ করে গেছেন। আজকের তরুণ মেধাবীরা জেগে না উঠলে তা কখনও সম্ভব হবে না।

যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি নিশ্চিত করতে শাহবাগে জেগে ওঠা তরুণদের গণজাগরণ আমাদের আরো শক্তিশালী করেছে। জয় বাংলা। জয় তরুণ প্রজন্ম। জয়তু প্রজন্ম চত্বর, শাহবাগ।

লেখক : সাংবাদিক-চিন্তক।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমএইচএম

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। সোনালীনিউজ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য সোনালীনিউজ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।

Wordbridge School
Link copied!