• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কেমন ছিল উমর (রা.)-এর শাসনকাল


মো. আরাফাত রহমান আগস্ট ৪, ২০২১, ০২:২৪ পিএম
কেমন ছিল উমর (রা.)-এর শাসনকাল

ঢাকা : হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা এবং হজরত  মোহাম্মদ (সা.)-এর প্রধান সাহাবিদের অন্যতম। আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর মৃত্যুর পর তিনি দ্বিতীয় খলিফা হিসেবে দায়িত্ব নেন। উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ইসলামী আইনের একজন অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ ছিলেন। ন্যায়ের পক্ষাবলম্বন করার কারণে তাকে আল-ফারুক বা সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী উপাধি দেওয়া হয়। আমিরুল মুমিনীন উপাধিটি সর্বপ্রথম তার ক্ষেত্রে ব্যবহূত হয়েছে। ইতিহাসে তাকে প্রথম উমর হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। সাহাবিদের মর্যাদার ক্ষেত্রে আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর পর উমরের অবস্থান। এছাড়াও তিনি ছিলেন  মোহাম্মদ (সা.) এর শ্বশুর অর্থাৎ ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর মেয়ে হাফসা ছিলেন আখেরি নবী ও রাসুল হজরত  মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রী।

উমর মক্কার কুরাইশ বংশের বনু আদি গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম খাত্তাব ইবনে নুফায়েল এবং মায়ের নাম হানতামা বিনতে হিশাম। তার মা বনু মাখজুম গোত্রের সদস্য ছিলেন। যৌবনে তিনি মক্কার নিকটে তার বাবার উট চরাতেন। তরুণ বয়সে উমর লিখতে ও পড়তে শেখেন। নিজে কবি না হলেও কাব্য ও সাহিত্যের প্রতি তার আগ্রহ ছিল। কুরাইশ ঐতিহ্য অনুযায়ী তিনি তার কৈশোরে সমরবিদ্যা, অশ্বারোহণ ও কুস্তি শেখেন। তিনি দীর্ঘদেহী ও শারীরিকভাবে শক্তিশালী ছিলেন। কুস্তিগির হিসেবে তার খ্যাতি ছিল। এছাড়াও তিনি একজন সুবক্তা ছিলেন। তার বাবার পরে তিনি তার গোত্রের একজন বিরোধ মীমাংসাকারী হন।

৬১০ সালে আল্লাহর রাসুল মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলাম প্রচার শুরু করেন। অন্যান্য মক্কাবাসীর মতো উমর প্রথম পর্যায়ে ইসলামের বিরোধিতা করেছিলেন। উমর ৬১৬ সালে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর উমর মুসলিমদের সবচেয়ে কঠোর প্রতিপক্ষ আবু জেহেলকে তা জানান। উমরের ইসলাম গ্রহণের পর প্রকাশ্যে কাবার সামনে নামাজ আদায় করতে মুসলিমরা বাধার সম্মুখীন হয়নি। ইসলাম গ্রহণের পর গোপনীয়তা পরিহার করে প্রকাশ্যে তিনি মুসলিমদের নিয়ে বাইরে আসেন এবং কাবা প্রাঙ্গণে উপস্থিত হন। তিনি ছাড়াও হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন। সেদিন নবী  মোহাম্মদ তাকে ‘ফারুক’ উপাধি দেন।

মক্কায় নির্যাতনের কারণে এবং মদিনা থেকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা আসায় মুসলিমরা মদিনায় হিজরত করতে থাকে। অধিকাংশ ব্যক্তিই ধরা পড়ার ভয়ে রাতে হিজরত করতেন। কিন্তু উমর দিনের বেলায় বিশজন সাহাবিসহ প্রকাশ্যে হিজরত করেন। ৬২৪ সালে উমর বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ৬২৫ সালে তিনি উহুদের যুদ্ধেও অংশ নেন। পরবর্তীতে তিনি বনু নাযির গোত্রের বিরুদ্ধে অভিযানেও অংশ নিয়েছেন। ৬২৫ সালে  মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে উমরের মেয়ে হাফসা বিনতে উমরের বিয়ে হয়। ৬২৭ সালে তিনি খন্দকের যুদ্ধ এবং তার পরবর্তী বনু কুরায়জা গোত্রের বিরুদ্ধে অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন।

৬২৮ সালে তিনি হুদায়বিয়ার সন্ধিতে অংশ নেন এবং সাক্ষ্য হিসেবে এতে স্বাক্ষর করেন। ৬২৮ সালে উমর খায়বারের যুদ্ধে অংশ নেন। ৬৩০ সালে মক্কা বিজয়ের সময় উমর এতে অংশ নেন। পরে হুনায়নের যুদ্ধ এবং তাইফ অবরোধে তিনি অংশ নিয়েছেন। তাবুকের যুদ্ধে সাহায্য হিসেবে তিনি তার সম্পদের অর্ধেক দান করে দিয়েছিলেন। বিদায় হজেও তিনি অংশ নিয়েছেন।

মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর পর খিলাফতের প্রতিষ্ঠায় উমর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। হজরত আবু বকরকে খলিফা হিসেবে অধিক যোগ্য বলে দাবি করে তার প্রতি উমর আনুগত্য প্রকাশ করেন। এই সিদ্ধান্তই সবাই মেনে নেয়। ইসলামী খিলাফতের প্রতিষ্ঠায় উমরের সবচেয়ে অবদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর ইতিহাসেও এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

আবু বকরের শাসনামলে উমর তার একজন প্রধান সচিব ও উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ইয়ামামার যুদ্ধে অনেক হাফিজ শহিদ হলে উমর কোরআন গ্রন্থাকারে সংকলনের জন্য আবু বকরের কাছে আবেদন জানান। এর ফলে কোরআন গ্রন্থাকারে সংকলিত হয়। আবু বকর মৃত্যুর পূর্বে উমরকে তার উত্তরসূরী নিয়োগ দিয়ে যান। উমর তার ইচ্ছাশক্তি, বুদ্ধিমত্তা, রাজনৈতিক সচেতনতা, নিরপেক্ষতা, ন্যায়বিচার এবং দরিদ্র ও অসহায়দের প্রতি সদয় আচরণের জন্য পরিচিত ছিলেন। উত্তরসূরী হিসেবে উমরের ক্ষমতা ও সক্ষমতা সম্পর্কে আবু বকর অবগত ছিলেন। মৃত্যুর পূর্বে আবু বকর উমরকে ডেকে তার অসিয়ত লিখতে বলেন যাতে তিনি উমরকে নিজের উত্তরসূরী ঘোষণা করে যান। অসিয়তনামায় উমরকে ইরাক ও সিরিয়া জয়ের অভিযান চালু রাখার নির্দেশনাও দেওয়া হয়।

ক্ষমতাপ্রাপ্তি পর সকল মুসলিম তাকে বায়াত প্রদান করেন। শাসক হিসেবে উমর দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের কল্যাণের জন্য কাজ করেছেন। রিদ্দার যুদ্ধে কয়েক হাজার বিদ্রোহী ও ধর্মত্যাগীকে দাস হিসেবে বন্দি করা হয়েছিল। উমর এসকল বন্দিদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন এবং তাদের মুক্তির নির্দেশ দেন। এই ঘোষণা বেদুইন গোত্রগুলোর কাছে উমরের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করেছিল। উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সময় উনার সরকার এককেন্দ্রিক ব্যবস্থায় পরিচালিত হয়। এতে খলিফা ছিলেন সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ।

পুরো সাম্রাজ্যকে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করা হয়। পাশাপাশি আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া এসব অঞ্চলের কিছু স্বায়ত্তশাসিত এলাকা খিলাফতের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেয়। প্রদেশগুলো প্রাদেশিক গভর্নর বা ওয়ালি কর্তৃক শাসিত হতো। উমর ব্যক্তিগতভাবে ওয়ালিদের নিযুক্ত করতেন। প্রদেশগুলোকে বিভিন্ন জেলায় বিভক্ত করা হতো। পুরো সাম্রাজ্যে প্রায় ১০০ এর মতো জেলা ছিল। প্রতিটি জেলা বা প্রধান শহর একজন অধঃস্তন গভর্নর বা আমিলের দায়িত্বে থাকত। আমিলরা সাধারণত উমর কর্তৃক নিযোগপ্রাপ্ত হতেন তবে প্রাদেশিক গভর্নররাও তাদের নিয়োগ দিতে পারতেন।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওয়ালিগণ প্রদেশের সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে কর্মরত থাকলেও কিছু প্রদেশে পৃথক সামরিক অফিসার থাকত। প্রতিটি নিয়োগ লিখিত আকারে দেওয়া হতো। নিয়োগের সময় গভর্নরদের জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হতো। দায়িত্বগ্রহণের পর গভর্নররা জনতাকে প্রধান মসজিদে জড়ো করে তাদের সামনে নির্দেশনা পড়ে শোনাতেন। এছাড়াও আরো কিছু বিধিনিষেধ গভর্নর ও রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের ওপর জারি করা হয়। প্রধান কর্মকর্তাদেরকে হজের সময় মক্কায় আসতে হতো এবং এসময় জনগণ তাদের বিরুদ্ধে যে কোনো অভিযোগ তুলতে পারত।

রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের জন্য উমর সর্বপ্রথম বিশেষ বিভাগ গঠন করেন। এই বিভাগ প্রশাসনিক আদালত হিসেবে কাজ করত এবং এর আইনি কর্মকাণ্ড উমর ব্যক্তিগতভাবে তদারক করতেন। এই বিভাগ  মোহাম্মদ ইবনে মাসলামার দায়িত্বে দেওয়া হয়। গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগগুলোর ক্ষেত্রে তিনি ঘটনাস্থল, অভিযোগ তদন্ত ও পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে উমরকে সহায়তা করতেন। কিছু ক্ষেত্রে অনুসন্ধান কমিটির সাথে তদন্তের বিষয়ে আলোচনা করা হতো। ক্ষেত্রবিশেষে অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে মদিনায় তলব করে আদালতের সম্মুখীন করা হতো। উমর তার গোয়েন্দা বিভাগের সহায়তায় কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনেন।

উমর সর্বপ্রথম পাবলিক মিনিস্ট্রি প্রথা চালু করেন যেখানে সরকারি কর্মকর্তা ও সৈনিকদের রেকর্ড লিপিবদ্ধ করা থাকত। গভর্নর ও রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে পাঠানো চিঠির অনুলিপিও রেকর্ড হিসেবে রক্ষিত থাকত। আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তিনি প্রথম পুলিশ বাহিনী নিয়োগ দেন। জনতা বিশৃংখল পরিস্থিতির সৃষ্টি করলে তিনি প্রথম তাদের শৃঙ্খলায় আনেন। উমরের শাসনামলে বসরা শহর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পানীয়জল ও সেচের জন্য তিনি খাল খননের ব্যবস্থা করেন। উমর পতিত জমির চাষাবাদের জন্য নীতি গ্রহণ করেন। যারা এসকল জমি আবাদ করত তাদেরকে এসব জমি প্রদান করা হয়। এই নীতি উমাইয়া আমলেও চালু ছিল। ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে খাল খননের ফলে ব্যাপক অঞ্চলজুড়ে কৃষিক্ষেত গড়ে ওঠে।

উমরের শাসনামলে খিলাফতের সীমানা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। তাই বিশাল সাম্রাজ্যকে ধরে রাখার জন্য তিনি রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলতে শুরু করেন। তিনি বেশকিছু প্রশাসনিক সংস্কার সাধন করেন। নতুন বিজিত অঞ্চলে তিনি প্রশাসন গঠন করেন যাতে কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও আমলাতন্ত্র ছিল। তার শাসনামলে বসরা ও কুফা শহরদ্বয় নির্মিত ও সমপ্রসারিত হয়। ৬৩৮ সালে তিনি মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববী বর্ধিত ও সংস্কার করেন। ৬৪১ সালে তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগার হিসেবে বায়তুল মাল গঠন করেন। মুসলিমদেরকে বার্ষিক ভিত্তিতে ভাতা প্রদান করা হতো। তার শাসনামলে হিজরি বর্ষপঞ্জি প্রণীত হয়।

৬৩৮ সালে আরবে খরার ফলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। মদিনায় সঞ্চিত খাদ্য শেষ হয়ে যাওয়ার পর উমর সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও ইরাকের প্রাদেশিক গভর্নরদেরকে সাহায্যের জন্য চিঠি লেখেন। গভর্নরদের সময়মতো পাঠানো সাহায্য হাজার হাজার মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিল। দরিদ্রদের কাছাকাছি থাকার জন্য উমর নিজে সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তার বাড়িটি ছিল মাটির তৈরি এবং তিনি প্রতি সন্ধ্যায় জনগণের অবস্থা পরিদর্শনের জন্য রাস্তায় বের হতেন। বায়তুল মাল থেকে মুসলিম ও অমুসলিম দরিদ্র, অসহায়, বৃদ্ধ, এতিম, বিধবা ও অক্ষমদেরকে সহায়তা প্রদান করা হতো। বায়তুল মাল পরবর্তী উমাইয়া ও আব্বাসীয় খিলাফতের সময়েও প্রচলিত ছিল। এছাড়াও উমর শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করেন। উমর একজন রাজনৈতিক কৃতী ব্যক্তিত্ব হিসেবে গণ্য হন। ইসলামী সাম্রাজ্যের স্থপতি হিসেবে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য।

লেখক : কলামিস্ট
সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার এন্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়          

Wordbridge School
Link copied!