• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ০৯ মে, ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

থেকেই যাচ্ছে সিটিং বাস!


বিশেষ প্রতিনিধি এপ্রিল ২০, ২০১৭, ০৮:২৪ পিএম
থেকেই যাচ্ছে সিটিং বাস!

ফাইল ফটো

ঢাকা: বাস মালিক-শ্রমিকদের কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানতে হলো সরকারকে। বন্ধ করতে পারল না মোটরযান আইন অনুযায়ী, অবৈধ সিটিং সার্ভিস। রাজধানীতে টানা চারদিন সীমাহীন দুর্ভোগের পর বৃহস্পতিবার (২০ এপ্রিল) থেকে আবার সড়কে নামছে সিটিং বাস। যাত্রীদের জিম্মি করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের সেই নৈরাজ্যেই ফিরে আসছেন বাস মালিকরা।

যদিও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বলেছে, আগামী ৫ মে পর্যন্ত নগরীর বিভিন্ন সড়কে যথারীতি সিটিং বাস চলবে। এরপর জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে সিটিং বাস থাকা-না থাকার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের মতে, এর মাধ্যমে সিটিং বাস বৈধতা পেতে যাচ্ছে।

বিআরটিএ কার্যালয়ে পরিবহন মালিক ও বিআরটিএসহ সংশ্লিষ্টদের বৈঠকে আপাতত ৫ মে পর্যন্ত আগের মতোই ঢাকা শহর ও এর আশপাশে সিটিং বাস চলার সিদ্ধান্ত হয়। বিআরটিএর এমন সিদ্ধান্তকে ‘সরকারের ব্যর্থতা’ বলে মনে করছেন নগর পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সরকারের এমন সিদ্ধান্ত গণপরিবহনের ভাড়া ডাকাতি অব্যাহত রাখার প্রচেষ্টা।

বিআরটিএ চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, রাজধানীতে সিটিং সার্ভিস চলবে। গত কয়েক দিনে গণপরিবহনে নারী-শিশুর দুর্ভোগের কথা বিবেচনায় নিয়ে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে সিদ্ধান্তটি আপাতত আগামী ১৫ দিনের জন্য।

তিনি বলেন, যারা অভিযানের কারণে বাস নামাননি, তাদের তালিকা করা হয়েছে। আরো কাজ চলছে। প্রথমে কারণ দর্শাতে হবে, তারপর শাস্তি দেয়া হবে। বিআরটিএর চেয়ারম্যান বলেন, সিটিং সার্ভিস বন্ধের সিদ্ধান্ত ১৫ দিনের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। এর মধ্যে অংশীজনদের নিয়ে বৈঠক করা হবে।

সিটিং বাস চালু রাখার বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোজাম্মেল হক চৌধুরী বিবৃতিতে বলেছেন, অবৈধ সিটিং সার্ভিস বন্ধ-চালুর খেলায় সরকারের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে গণপরিবহনে ভাড়া ডাকাতি অব্যাহত রাখার ষড়যন্ত্র চলছে। সিটিং সার্ভিসে যাত্রী ভোগান্তি অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ে নৈরাজ্য বন্ধের মতো জনবান্ধব সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যাত্রী সাধারণের মতামত না নেওয়ায় এসব সিদ্ধান্তে মালিকরা লাভবান হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।

তিনি দাবি করেন, মালিকরা অবৈধ সিটিং সার্ভিস বন্ধের কথা বলে মূলত সিটিং সার্ভিসকে বৈধ করে নেয়ার পথ তৈরি করল। জনগণকে জিম্মি করে কৌশলে আরেক দফা ভাড়া বাড়ানোর ফাঁদে ফেলল সবাইকে। এটি রীতিমতো প্রতারণা ও মোটরযান আইনবিরোধী।

অবশ্য তড়িঘড়ি করে সিটিং সার্ভিস বন্ধের সিদ্ধান্তকে প্রথম থেকেই অপরিকল্পিত বলে মত দিয়েছেন দেশের নগর পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সরকার কোনো প্রকার বাস্তব প্রেক্ষাপট বিবেচনা না করেই তড়িঘড়ি এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নেমেছিল। এর জন্য পৃথক কোনো কাঠামো তৈরি করেনি।

যাত্রীদের দুর্ভোগ লাঘবে অতিরিক্ত যানবাহনের ব্যবস্থাও রাখেনি। এমনকি দীর্ঘ নজরদারির জন্য যে টেকসই ব্যবস্থা দরকার, তারও কোনো উদ্যোগ তারা নিতে পারেনি। এ ছাড়া বাস-মালিকদের কাছে সরকার অনেকটা অসহায়। পরিবহন খাতে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিলেও বাস্তবায়নে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে বলে মনে পরিবহন বিশেষজ্ঞরা।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. মোয়াজ্জেম হোসেন সিটিং সার্ভিস বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্তকে ‘ইদুর বেড়াল’ খেলা বলে মত দিয়েছেন।

তিনি বলেন, দেশের পরিবহন খাতে প্ল্যানিং থেকে পরিচালনা- সবক্ষেত্রে অনিয়ম। সেখানে সিটিং সার্ভিস বন্ধের উদ্যোগ কতটা কার্যকর হবে- তা নিয়ে প্রথম থেকে সংশয় দেখা দিয়েছিল। তা ছাড়া হঠাৎ করেই এমন সিদ্ধান্ত কতটুকু যুক্তিযুক্ত, সে নিয়েও প্রশ্ন ছিল। সিটিং সার্ভিস বন্ধের যে সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছিল, সেটি অপরিকল্পিত, বৈজ্ঞানিক ছিল না। এমনটা হবে আমরা আগেই সংশয় জানিয়েছিলাম। বাস মালিক ও শ্রমিক নেতারা সরকারকে ফাঁদে ফেলেছিল। তারা জনগণকে জিম্মি করে সিটিং বাসকে বৈধ করে নিল। এমনকি এমনও হতে পারে যে এখন থেকে সাধারণ যাত্রীদের সিটিং সার্ভিসের জন্য আগের চেয়ে বেশি ভাড়া গুনতে হতে পারে।

তবে একই বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউটের অপর নগর পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, সিটিং বাস বন্ধের উদ্যোগটা ভালো ছিল, তবে তারা বাস্তাবায়ন করতে পারেনি। এর কারণ সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। যেকোনো কাজ ধীরস্থিরভাবে করতে হয়। তড়িঘড়ি করে করলে সফলতা আসে না।

এর জন্য প্ল্যানিং দরকার। মূল সমস্যা কি, সিটিং সার্ভিস বন্ধ করতে গেলে কি ধরনের সমস্যা তৈরি হতে পারে এবং সে সমস্যার সমাধানে কি ধরনের বিকল্প ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সেসব সিটিং সার্ভিস বন্ধের আগেই নেয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেই ধরনের উদ্যোগ সরকার নেয়নি। ফলে এই কয়েকদিন সাধারণ মানুষ দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। ঠিকই সিটিং বাস আবার চালু হয়েছে।

নগরীতে ২০০৪ সালে সিটি বাস সার্ভিসের মাধ্যমে সিটিং প্রথা শুরু হয়। শুরুতে ভালো সার্ভিস দিয়ে এ প্রথা শুরু হলেও ধীরে ধীরে নৈরাজ্যে রূপ নেয়। গুটি কয়েক বাস কোম্পানি সিটিং প্রথা চালু করে। পরে বাড়তি আয়ের লোভে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে রাজধানীর অনেক বাস সিটিং সার্ভিস বনে যায়।

ফলে বাসে উঠলেই ভাড়া গুনতে হতো শেষ স্টপেজ পর্যন্ত। আর গাড়িতে উঠলে নামলে দিতে হতো ১০ থেকে ২৫ টাকা। এ ছাড়া সিটিং সার্ভিসের নিজের মতো করে তৈরি করা স্টপেজ পার হলে দিতে হতো দিগুণ ভাড়া। এতে রীতিমতো জিম্মি হয়ে পড়ে রাজধানীবাসী। যা বিআরটিএ নীতিমালায় নেই। এমনকি রুট পারমিটেও নেই সিটিং বা গেটলক। তবে এ থেকে শুরুতে পিছিয়ে ছিল না সরকারি প্রতিষ্ঠান বিআরটিসিও। পরে বিষয়টি নিয়ে সংবাদ হলে সিটিং প্রথাকে অবৈধ ঘোষণা করে বিআরটিএ। কিন্তু সিটিং বন্ধ হলেও বাড়তি টাকা নেওয়া বন্ধ হয়নি।

সোনালীনিউজ/ঢাকা/জেডআরসি/এমএইচএম

Wordbridge School
Link copied!