১০ বছর ধরে দড়িতে বাঁধা বাবা-মা হারা সাদিক

  • গাইবান্ধা প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২০, ১০:২৫ পিএম

গাইবান্ধা: গাইবান্ধার ফুলছড়িতে ১০ বছর ধরে দড়ি অথবা মোটা কাপড় দিয়ে এক পা বেঁধে রাখা হয়েছে বাবা-মা হারা মানসিক প্রতিবন্ধী সাদিক হোসেনকে। অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছে না তার দাদি। অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা এড়াতে বাধ্য হয়ে দীর্ঘদিন বেঁধে রাখা হয়েছে তাকে। এ অবস্থায় সরকারের কাছে ছেলেটির চিকিৎসার জন্য সহায়তা চেয়েছে হতদরিদ্র পরিবার ও এলাকাবাসী।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির উঠানে একটি বাঁশের সঙ্গে কাপড় দিয়ে এক পা বেঁধে রাখা হয়েছে সাদিক হোসেন নামের ১১ বছর বয়সী এক কিশোরকে। মানসিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় তাকে এভাবে বেঁধে রাখা হয়েছে বলে জানায় পরিবার। অবলা চোখে তাকিয়ে থাকা, চিপসের প্যাকেট হাত দিয়ে নাড়াচড়া করা, কখনও বা নিজের হাঁটুতে কামড় দেওয়া, আবার কখনও চিত হয়ে শুয়ে থাকাসহ নানাভাবে দিন কাটে কিশোর সাদিকের।

জানা গেছে, উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের পূর্ব কাতলামারী গ্রামের আইয়ুব হোসেন ও ছকিনা বেগম দম্পত্তির ঘরে ২য় সন্তান হিসেবে জন্ম হয় সাদিকের। 

দাদি রহিমার ভাষ্যমতে, জন্মের পর ১ বছর পর্যন্ত ভালো ছিল সাদিক। টিটিনাসের ইনজেকশন দেওয়ার পর হঠাৎ করে খিঁচুনি উঠে এ রকম পরিস্থিতির শিকার হয়ে যায় সে। সুযোগ পেলে বাড়ি থেকে দৌড়ে চলে যায় অনেক দূরে। অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেতে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে পায়ে দড়ি অথবা মোটা কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখা হয়একটি কুঁড়েঘরে কখনও বা বাড়ির উঠানে। এ অবস্থায় মানবেতর জীবন পার করছে বাবা-মা হারা প্রতিবন্ধী ছেলেটি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাদিকের বাবা আইয়ুব হোসেন কাজ করতেন একটি এনজিওতে। ছেলের চিকিৎসা করাতে গিয়ে সহায়-সম্বল শেষ করে সর্বশান্ত হয়ে যান। পরে গত ৭ বছর আগে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান তিনি। আইয়ুব হোসেন মারা যাওয়ার বছরখানিক পর তার স্ত্রী ছকিনা বেগম এক মেয়ে মিষ্টি বেগম ও ছেলে সাদিককে ফেলে রেখে অন্যত্র বিয়ে করেছেন। তার পর থেকে দাদি রহিমা বেওয়ার কাছে আশ্রয় হয় সাদিকের। আর মেয়েটির বিয়ে দেওয়া হয়।

প্রতিবেশী রুহুল আমীন ও নাজনীন আক্তার বলেন, তারা অনেক গরিব। অনেক কষ্টে আছে। সরকার যদি তাদের একটু সহায়তা করতো অনেক ভালো লাগতো। তার বাবা মারা গেছে। মা অন্যকে বিয়ে করে সংসার বেঁধেছে। সাদিককে নিয়ে অনেক কষ্ট করছে তার দাদি। দঁড়ি দিয়ে বেঁধে রাখেন। অর্থের অভাবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের চিকিৎসা নিতে পারছে না তারা।

সাহিদ নামে এক কিশোর বলে, আমরা গ্রামের ছেলেরা ক্রিকেট, ফুটবল খেলি। কিন্ত সাদিক খেলতে পারে না, আমাদের খুব খারাপ লাগে। ও যদি ভালো থাকতো আমাদের সঙ্গে খেলাধুলা করতে পারতো। সাদিককে বেঁধে রাখায় আমাদের খারাপ লাগে। ওর চিকিৎসার কেউ যদি দায়িত্ব নিতো, তাহলে হয়তো সাদিক ভালো হয়ে আমাদের সঙ্গে খেলতে পারতো।

রহিমা বেওয়া বলেন, ‘নাতিকে বেঁধে রাখতে আমারও কী কম কষ্ট হয়! কিন্তু উপায় কী, বলুন! পাগলামি করে, হাত দিয়ে খেতে পারে না, কথা বলতে পারে না ফির ঘুম পার না। বাবা মারা যাবার পর থেকেই দঁড়ি দিয়ে তাকে বেঁধে রাখা হয়।’

স্থানীয় বাসিন্দা ও ইউপি সদস্য আব্দুর সবুর সরকার বলেন, ছেড়ে দিলে মানুষের ক্ষতি করে। ময়লা আর্বজনা খায়, তাই ভয়ে ওকে ছেড়ে দেয় না। কখন কার ক্ষতি করে বসে। টাকার অভাবে সাদিকের চিকিৎসা করাতে পারচ্ছে না ওর দাদি। দেশের বিত্তশালী ব্যক্তিরা সাদিকের চিকিৎসার জন্য যদি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতো, তাহলে হয়তো সে ভালো হয়ে যেতো।

উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান সামছুল আলম সরকার বলেন, ছেলের চিকিৎসার জন্য জমি-জমা সব বিক্রি করে সর্বশান্ত হয়ে যায় বাবা। পরে দুশ্চিন্তায় সাদিকের বাবা মারা যায়। তারপর আর কোন চিকিৎসা হয়নি। ওর দাদি লালন-পালন করছে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে রহিমা বেওয়াকে বয়স্ক ভাতার কার্ড ও সাদিককে প্রতিবন্ধী ভাতার একটি কার্ড করে দেওয়া হয়েছে। সরকারি সহযোগিতার পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানরা এ পরিবারের সেবায় এগিয়ে আসলে বদলে যাবে তাদের জীবন।

এ ব্যাপারে জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. এমদাদুল হক প্রামনিক বলেন, সাদিকের বিষয়ে আমরা অবগত আছি। সাদিককে আমরা প্রতিবন্ধী ভাতা দিয়েছি, তার দাদিকেও বয়স্কভাতা দিয়েছি। এছাড়া সাদিকের চিকিৎসার বিষয়ে আমরা সহযোগিতা করতে পারবো। এ ব্যাপারে তারা যদি আমাদের কাছে সহযোগিতা চায় আমরা করবো। এছাড়া চট্রগ্রামে আমাদের মানসিক প্রতিবন্দী শিশু কেন্দ্র আছে, আমরা সেখানেও তার পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করতে পারবো।

সোনালীনিউজ/এইচএন