ঢাকা: ফেনী কলেজ ছাত্র সংসদের (১৯৬৭-৬৮) ভিপি, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন নেতা সৈয়দ মাওলানা ওয়াজ উদ্দিনকে হত্যায় জামায়াতের নতুন আমির মকবুল আহমাদের জড়িত থাকার প্রামাণ্য দলিল পাওয়া গেছে। ১৯৭১ সালের ১০ আগস্ট ছাত্রনেতা ওয়াজ উদ্দিনকে হত্যার জন্য তৎকালীন চট্টগ্রাম রেডিওতে কর্মরত ফজলুল হক নামে এক ব্যক্তির কাছে দলীয় প্যাডে ইংরেজিতে হাতের লেখা একটি চিঠি পাঠান মকবুল। এই চিঠি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ওয়াজ উদ্দিন হত্যার দালিলিক প্রমাণ হিসাবে এখনো রয়ে গেছে।
এরই মধ্যে ফেনীতে একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে মকবুল আহমাদের সরাসরি জড়িত থাকার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত শাখার কাছে জমা দিয়েছেন ভুক্তভোগী শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য, মুক্তিযোদ্ধা ও প্রতক্ষ্যদর্শীরা।
অভিযোগ রয়েছে, একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জামায়াতে ইসলামীর ফেনী মহকুমা শাখার তৎকালীন আমির ও শান্তি কমিটির অন্যতম নেতা মকবুল আহমাদ মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার প্রধান পরিকল্পনাকারী ছিলেন। একাত্তরের ১০ আগস্ট তার স্বাক্ষরিত চিঠিতে দেখা যায়, মকবুল উল্লেখ করেছেন, তাদের কাছে খবর রয়েছে ফেনী তাকিয়া বাড়ির মাওলানা ওয়াজ উদ্দিন ওই সপ্তাহেই চট্টগ্রাম গিয়েছেন। চিঠি লেখার আগের সপ্তাহে ওয়াজ উদ্দিন ভারত থেকে দেশে ফেরেন বলে উল্লেখ করেন মকবুল। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ‘তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেন চিঠিতে।
একই চিঠিতে ওয়াজ উদ্দিনকে ‘চীনপন্থি মেনন গ্রুপের নেতা’ ও ‘চট্টগ্রাম সেক্টরের মুক্তি বাহিনীর প্রধান সহকারী’ উল্লেখ করে তার সন্ধান করতে ফজলুল হককে অনুরোধ করেন। তিনি এ বিষয়ে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের স্পেশাল ক্যাডেট শাহ জালাল ও নশেরের সহযোগিতায় যথার্থ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ফেনী শহর কমান্ডার হানিফ ও উপদেষ্টা মাওলানা মোস্তফাকে ওই রাতে চট্টগ্রামে পাঠানোর কথাও চিঠিতে উল্লেখ করেন।
চিঠিতে মকবুল লেখেন, ‘ওয়াজ উদ্দিনকে হত্যার ঘটনা ঘটাতে ইলিয়াছ, খালেক, জালালসহ তিনি (মকবুল) অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। এ ব্যাপারে ‘পূর্বতন চুক্তি অনুসারে অনুগ্রহপূর্বক সাহায্য করতে’ ফজলুলকে অনুরোধ করেন মকবুল।
সূত্র জানায়, মকবুলের সেই চিঠি অনুযায়ীই ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা ওয়াজ উদ্দিনকে হাত ও চোখ বেঁধে একাত্তরের ১৭ আগস্ট চট্টগ্রামে রিয়াজ উদ্দিন বাজার এলাকা থেকে জিপে (ক ২৪৬৭) করে রাজাকারেরা তুলে নিয়ে যায়। সেই থেকে মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা ওয়াজ উদ্দিনের কোনো খোঁজ পাননি তার স্বজনেরা। এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানায় একটি অভিযোগ দায়ের হয়। কিন্তু এই অভিযোগ স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ওয়াজ উদ্দিনের রাজনৈতিক সহকর্মী অ্যাডভোকেট গিয়াস উদ্দিন এসব তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, ‘স্বাধীনতার পর জামায়াত নেতা মকবুল ও তার ভাই খবির রাজাকারসহ বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর দোসররা গা ঢাকা দেয়। ’৭৫-এর আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মকবুলদের অর্থ ও ক্ষমতার দাপট বেড়ে যায়। পরবর্তীকালে ১৯৯১ সালে ফেনী-২ আসনের সংসদ নির্বাচনে মকবুল আহমাদ জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে মাঠে নামেন। ওই সময় স্বাধীনতার পক্ষের গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তি মকবুলের যুদ্ধকালীন বিতর্কিত ভূমিকা জনসমক্ষে তুলে ধরেন। মাওলানা ওয়াজ উদ্দিনকে হত্যায় মকবুলের জড়িত থাকার বিষয় আরো স্পষ্টভাবে সামনে আসে। একই সময় আলোচিত এই চিঠিটি ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। নতুন প্রজন্ম মকবুলের অতীতের কলঙ্কিত অধ্যায় জানতে পারে। ফলে এই নির্বাচনে বিএনপির দুর্বল প্রার্থী দিয়ে মকবুলকে জিতিয়ে আনার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হতে হয়।
অ্যাডভোকেট গিয়াস উদ্দিন আরো বলেন, ১৯৯৩ সালে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনে মকবুলেরও বিচার দাবি করে। কিন্তু এরপর দীর্ঘ সময় এই আন্দোলন না থাকায় নতুন প্রজন্ম মকবুলের যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়ে সোচ্চার হয়নি।
জেলা ন্যাপের সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার সাধন সরকার মাওলানা ওয়াজ উদ্দিনের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক দক্ষতার কথা উল্লেখ করে বলেন, ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুখান এবং ’৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামে মাওলানা ওয়াজ উদ্দিন ছিলেন একজন সক্রিয় নেতা। তাকে হত্যার মাধ্যমে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আলবদর ও ফেনীর ঘাতক মকবুল আহমাদ দেশকে মেধাবী নেতাশূন্য করার চেষ্টা করেন। ফেনীর মুক্তিকামী মানুষকে ওই হত্যাযজ্ঞের নেতা মকবুলের বিচার দ্রুত করার চেষ্টায় নামতে হবে।
এদিকে জামায়াতের আমির মকবুল আহমাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে গত ২৩ অক্টোবর ফেনীর দাগনভূঞার খুশিপুর গ্রামের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আহছান উল্যাহের স্ত্রী ছালেহা বেগম লিখিত অভিযোগ দেন। তিনি তার স্বামীকে অপহরণ, খুন ও লাশ গুম করার অভিযোগ এনে মকবুলের দ্রুত বিচার দাবি করেন।
এছাড়া ৮ নভেম্বর আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের সহকারী পরিচালক নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে তদন্ত দল মানবতাবিরোধী হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল দাগনভূঁঞা উপজেলার জয়লস্কর ইউপির লালপুর গ্রামে গেলে সেখানকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজন জানান, তাদের ওপর ১৯৭১ সালের ১১ জুন হামলার মূলহোতা ছিলেন মকবুল আহমাদ। লালপুর গ্রামে চন্দ্রনাথ পালের বাড়িতে ১০ হিন্দুসহ ১১ জনকে হত্যা, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, বাড়ির ৬৫ পরিবারের নারী, শিশু ও পুরুষদের ওপর নির্যাতনের নির্মম বর্ণনা দেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
মকবুল আহমাদের মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার প্রমাণ রয়েছে বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক হান্নান খান। তিনি বলেন, ‘মকবুলের বিরুদ্ধে তদন্তের অগ্রগতি হয়েছে। তবে তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। মকবুল যে রাজাকার ছিলেন সে বিষয়টি তথ্য-উপাত্তে স্পষ্ট। তার বিরুদ্ধে মামলা হবে কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।’
প্রসঙ্গত, মকবুল আহমাদের গ্রামের বাড়ি ফেনী জেলার দাগনভূঁঞা উপজেলার পূর্বচন্দ্রপূর ইউনিয়নের ওমরাবাদে। জামায়াতের নতুন আমির হিসেবে তার নাম ঘোষণা করা হলে ফেনীর মুক্তিযোদ্ধা সংসদসহ ক্ষতিগ্রস্ত শহীদ পরিবার ও স্বাধীনতার পক্ষের গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল নেতারা তার বিচারের দাবিতে সোচ্চার হন।
সোনালীনিউজ/এমএন