ঢাকা: খুব বিখ্যাত কেউ ছিলেন না। তবুও বাংলা ভাষাভাষি মানুষের খুব কাছের, হৃদয়ের গান গাইতেন বলেই হয়তো সবার প্রিয় মুখ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছিলেন কলকাতার জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘দোহার’-এর মুখ্য শিল্পী কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য। বাংলা লোকগান গাওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশেও ছিলেন সমান জনপ্রিয়। পশ্চিম বাংলায় তিনি জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন করিম ও হাছনের গান। ভিন্ন ঢঙের গায়কীর জন্য বাঙালির হৃদয়ে ঠাঁই করে নেয়া এই সংগীতশিল্পী হঠাৎ চলে গেলেন জীবনের ওপাড়ে। তার অকাল প্রয়াণে বাঙালির চোখ আজ ছল ছল...!
অথচ গেল সপ্তাহে ফাখরুল আরেফিনের ‘ভুবন মাঝি’ দেখতে অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঢাকায় এসেছিলেন কালিকাপ্রসাদ। কলকাতায় ফিরে গিয়েছিলেন ৩মার্চ। অথচ তার চারদিনও পেরোলো না, তার আগেই মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো এই সংগীতশিল্পীর। তার মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ দুই বাংলার সংগীতপ্রেমী মানুষ। প্রতিভাবান এই লোকসংগীতশিল্পীর অকাল প্রয়াণে শোক জানাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ। স্মৃতিচারণা করছেন দুই বাংলার অনেক তারকারা...
কালিকাপ্রসাদের মৃত্যুতে স্তব্ধ কলকাতার জনপ্রিয় অভিনেতা পরমব্রত। কারণ তার সঙ্গেই গত ১মার্চ কলকাতা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। ‘ভুবন মাঝি’র প্রিমিয়ারে অংশ নিয়েছিলেন। তাই কালিকার মৃত্যুতে রীতিমত বাকরুদ্ধ পরম লেখেন, আমার ভাষা নেই, শিকড় নেই, কথা নেই, নিশ্বাস নেই, গান নেই, গানের শুরু নেই, বন্ধু নেই, দাদা নেই, কালিকা দা নেই...।
কালিকার মৃত্যুতে তার ও তার পরিবারের প্রতি শোক জানিয়ে ফেসবুকে লিখেন টলিউডের অন্যতম সেরা অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। কালিকার অসময়ে চলে যাওয়া বাংলা লোক গানের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি দাবি করে তিনি বলেন, ‘শকড্’। বাংলার লোকশিল্পী কালিকাপ্রসাদের হঠাৎ চলে যাওয়াকে বর্ণনা করতে এটি খুবই ছোট শব্দ। এই কঠিণ সময়ে তার পরিবারের প্রতি আমার সহমর্মিতা। কালিকার অনুপস্থিতি অনুভব করবে সংগীত প্রেমী মানুষ ও গোটা টলিউড ইন্ডাস্ট্রি। শান্তিতে থাকুন তিনি।
কালিকার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়েছেন কলকাতার জনপ্রিয় ব্যান্ড দল ‘ফসিলস’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও ভোকাল রূপম ইসলাম। কালিকার মৃত্যুশোকে তিনি বলেন, ‘গভীর শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করছি।’ এবং একইসঙ্গে টিভিতে যেভাবে দুর্ঘটনায় নিহত কালিকার লাশ দেখানো হচ্ছে তার প্রতিবাদ করেন তিনি। টিভিওয়ালাদের প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে রূপম লেখেন, টিভি ক্যামেরাগুলিকে প্রশ্ন: আপনারা যেটা করছেন সেটা কি শোভন? এই বিষয়ে আপনাদের কোনও বোধই কি অবশিষ্ট নেই?
‘আয়নাবাজি’ নির্মাতা অমিতাভ রেজাও ‘দোহার’ ব্যান্ডের একটি গান শেয়ার করে ফেসবুকে লেখেন, আপনার অসামান্য গায়কীতে শেষ শুনেছি ভুবল মাঝি সিনেমায় "-আমি তোমারই তোমারই নাম গাই..।
কালিকাপ্রসাদের মৃত্যুতে লাজবন্তি রায় নামের কলকাতার আরেক সংগীতশিল্পী বলেন, দোহারের কালিকাপ্রসাদ দা দুর্ঘটনায় চলে গেলেন, ভাবতেই পারছি না..বাংলা লোকসংগীত এর মারাত্মক ক্ষতি হল। ভালো থেকো, শান্তিতে থেকো কালিকা দা, তোমার গান আমাদের কন্ঠে থাকবে।
সদ্য মুক্তি পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধনির্ভর সিনেমা ‘ভুবন মাঝি’। এই সিনেমায় গান গেয়েছিলেন কলকাতার কালিকাপ্রসাদ। তাই তার সঙ্গে ভালো স্মৃতি আছে ছবির নির্মাতা ফাখরুল আরেফিনের। কালিকাপ্রসাদের মৃত্যুর পর নির্মাতা ফাখরুল আরেফিন বলেন, যার সুর আছে মৃত্যু তার পায়ের কাছে ভিক্ষা মাগে।
অন্যদিকে ‘জালালের গল্প’ নির্মাতা আবু শাহেদ ইমনও শোক প্রকাশ করেন কালিকাপ্রসাদের জন্য। তার উদ্দেশে ইমন বলেন, কালিকাপ্রসাদ দাদা, আপনার দোহারের গান শুনে শুনে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন কেটেছে! এই কাঁটা তারের সীমানা পেরিয়েও আপনার সুর আমাদেরকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে সব সময়।আপনাদের দলের আয়োজনে আমাদের গান ‘বন্ধু তোর লাইগারে আমার তনু জরজর’-এর সুরে সুরে নিজের জীবনের প্রেম বুঝেছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি সব সময়ই আপনাদের গানের বিশাল বড় ভক্ত। আরেফিন ভাইয়ের ভুবন মাঝিতে আপনার ‘আমি তোমারি তোমারি গান গাই’ আমাদের লক্ষ-কোটি শ্রোতাকে বিমুগ্ধ করেছে। আপনি ছাড়া দোহারকে ভাবা আমাদের জন্য এক মর্মান্তিক সত্যকে মেনে নেয়া। আপনার মৃত্যুতে আমি ব্যক্তিগত ভাবে একজন স্বজন হারানোর বেদনা অনুভব করছি। আপনার সাথে আমার সামনা-সামনি কখনো দেখা হয় নাই। কিন্তু আপনি থাকবেন গানের মাঝে। আমি আপনার গান গাইব… যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন দাদা।
‘ভুবন মাঝি’ সিনেমা করতে গিয়ে কালিকাপ্রসাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল দেশের ছোট পর্দার জনপ্রিয়অভিনেতা মাজনুন মিজানের। কালিকাপ্রসাদের মৃত্যু তাই ছুঁয়ে গেছে তাকেও। টাটকা স্মৃতির প্রতি কথা মনে রেখে এই সংগীতশিল্পীল সঙ্গে দুটো স্থিরচিত্র দেন মিজান। এবং বলেন, ‘দাদা, এটা কি হলো? কিভাবে হলো? এটা কি হবার কথা ছিলো? যেখানেই থেকো ভালো থেকো...।
সোনালীনিউজ/ঢাকা/এমটিএল