ঢাকা : ১৯৭৯ সালে প্রণয়নের পর সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা সংশোধন করা হয়েছে একাধিকবার। এর পরও অনেক কথা পরিস্কারভাবে বলা হয়নি। কিছু কথা এমনভাবে বলা হয়েছে, যার ব্যাখ্যা প্রয়োজন। জনপ্রতিনিধি ও নাগরিকদের সঙ্গে সরকারি কর্মচারীদের আচরণ কেমন হবে- এ বিষয়ে বিধিমালায় সুস্পষ্ট কোনো কথা নেই। রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া সংক্রান্ত বিষয়ে বলা হলেও সরকারি চাকরিজীবীদের সংগঠন বিষয়ে কোনো বিধান নেই। তথ্য গোপন করে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন অনেকে। অনেকে শেয়ার ব্যবসা করছেন। আচরণবিধি অস্পষ্ট থাকায় তাদের পরিবারের সদস্যরা সম্পদের হিসাব দিচ্ছেন না। রাজনৈতিক বক্তব্যও দিচ্ছেন সরকারি চাকরিজীবীরা; বেসরকারি চাকরিজীবী ও নাগরিকদের সঙ্গে সংগঠন গড়ে তুলছেন।
সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯ প্রণীত হয়েছিল ৪২ বছর আগে। এর পর ২০০২ ও ১১ সালে দুই দফায় তা সংশোধন করা হয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনাগুলো সংশোধন করা হয়নি। তাই ২০১৪ সালে ফের সংশোধন কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু দীর্ঘ সাত বছরেও তা শেষ করতে পারেনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ আচরণ বিধিমালা সংশোধন বিষয়ে কর্মশালা আয়োজনে গত ২৭ অক্টোবর তারিখ নির্ধারণ করা হলেও তা স্থগিত করা হয়। এই আচরণ বিধিমালায় মোট ৩৪টি নির্দেশনা আছে।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মকাণ্ড যেন জবাবদিহিতার আওতায় থাকে, এ জন্য আচরণ বিধিমালা আরও স্পষ্ট করা হচ্ছে। অনেক নির্দেশনায় পরিবর্তন আসছে। প্রয়োজন অনুযায়ী সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা যুগোপযোগী করে আগামী এক মাসের মধ্যে চূড়ান্ত করা হবে।
বহুল প্রচলিত 'সরকারি কর্মচারী আইন' বইয়ের লেখক ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. ফিরোজ মিয়া বলেন, সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা একাধিকবার সংশোধন করার পরও প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো সংশোধন করা সম্ভব হয়নি। এ জন্য সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে নির্দেশনা আসতে হবে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নির্দেশনা না দিলে ব্যবসা-বাণিজ্য, সম্পদের হিসাব ও রাজনৈতিক বিষয়গুলো স্পষ্ট করা সম্ভব হবে না। এসব বিষয় সংশোধন হলে বড় বড় অনেক কর্মকর্তার স্বার্থের ক্ষতি হবে।
তিনি বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের সুযোগ-সুবিধা এখন অনেক বেশি। তাই তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে অনুমতি দেওয়া উচিত নয়। সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি তাদের সংগঠনগুলোকেও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখা জরুরি। সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে প্রজাতন্ত্রের
কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আলাপচারিতা, আচরণ এবং মনোভাব নিয়ে অনেকে সমালোচনা করছেন। কিছু কর্মকর্তা যথেষ্ট মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে থেকেও এমনভাবে কথা বলছেন ও আচরণ করছেন, তাতে জনগণ দলীয় রাজনীতি এবং প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পেতে হিমশিম খাচ্ছে। জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে তাদের মতানৈক্য হচ্ছে। এতে অনেক উন্নয়ন কাজে দেখা দিয়েছে ধীরগতি। রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া সংক্রান্ত বিষয়ে বলা হলেও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠন বিষয়ে কোনো বিধান নেই। ফলে তারা বিভিন্ন সংগঠনের নামে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। সংগঠনের ব্যানারে আয়োজিত বিভিন্ন সভায় রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন।
পদোন্নতির পর কর্মকর্তাদের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে, নিজের যোগ্যতায় নয়, রাজনৈতিক কারণে তারা পদোন্নতি পেয়েছেন। আচরণবিধির অস্পষ্টতায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ব্যাপক হারে ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে অধস্তন কর্মকর্তারা ব্যবসা শুরু করছেন। পরে তথ্য গোপন করে তারা উভয়েই ব্যবসায় জড়াচ্ছেন। অনেকে সরকারের অনুমোদন ছাড়াই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন। এ বিষয়টি সামনে আসে গত বছর দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের সময়। এর পর এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগে চিঠি দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
এদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে অফিস আদেশ জারির প্রায় পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও সম্পদের হিসাব দেননি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাবও গোপন করছেন তারা। প্রকৌশলী-কৃষিবিদ-চিকিৎসক (প্রকৃচি) সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মিলে সংগঠন গড়ে তুলেছেন। সরকারি সেবা নিতে গিয়ে কিংবা বিভিন্ন কারণে দায়িত্বে থাকা কোনো কোনো সরকারি কর্মকর্তার আচরণ কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ নতুন নয়। সাম্প্রতিক সময়ে এ রকম বেশ কয়েকটি ঘটনা নিয়ে ব্যাপক আলোচনাও দেখা যায়। গত মে মাসে নারায়ণগঞ্জে সরকারি হটলাইন ৩৩৩-এ কল করে ত্রাণ চাওয়ার পরে জরিমানার মুখে পড়েছিলেন এক সাহায্যপ্রার্থী। বগুড়ায় উপজেলা পরিষদের ফুলগাছ খেয়ে ফেলায় ছাগল মালিককে জরিমানার ঘটনাটিও বেশ আলোচিত। কিন্তু নাগরিকদের সঙ্গে এমন আচরণ বিষয়ে আচরণবিধিতে স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা না থাকায় সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সংশোধন হচ্ছে আচরণবিধি : তবে আচরণ বিধিমালায় কয়েকটি বিষয়ে খুব ভালোভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন- উপঢৌকন গ্রহণ করতে হলে সরকারের পূর্বানুমতি লাগবে। বর্তমানে কোনো অনুষ্ঠানে সরকারের অনুমোদন ছাড়া ২৫ হাজার টাকা মূল্যের উপহার গ্রহণের রীতি প্রচলিত। এ অর্থমূল্যের পরিমাণ বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হচ্ছে। বিদেশি প্রতিষ্ঠান বা বিদেশি সরকারের কোনো কর্মকর্তার কাছ থেকে ৫ হাজারের পরিবর্তে ৪০ হাজার টাকার মূল্যের উপহার গ্রহণ করা যাবে। স্থাবর সম্পত্তির অধিকারী অথবা ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িত কোনো ব্যক্তির কাছে দুই লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি মূল্যের কোনো স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি ক্রয়, বিক্রয় বা অন্য কোনো উপায়ে হস্তান্তরের ক্ষেত্রে সংশ্নিষ্ট কর্মচারী প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বিভাগীয় প্রধান বা সরকারের সচিবকে অবগত করবেন বলে বিধিতে বলা ছিল। এর পরিমাণ এখন ৫ লাখ টাকা বা তার বেশি হলে বিভাগীয় প্রধান বা সরকারের সচিবকে জানাতে হবে।
সরকারি চাকরিজীবীদের পাঁচ বছর পরপর ডিসেম্বরে বাধ্যতামূলক সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিধান রয়েছে। সম্পত্তির হ্রাস-বৃদ্ধির হিসাব বিবরণী যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারের কাছে দাখিল করতে হবে। সংশোধিত খসড়ায় সম্পদের হ্রাস-বৃদ্ধি যাচাই-বাছাই করার বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া কেউ ভুল তথ্য দিলে আইনগত ব্যবস্থা ও বিভাগীয় মামলা করা যাবে। তহবিল সংগ্রহের ফেমিন কোড ও ফেমিন ম্যানুয়াল বাদ দেওয়া হচ্ছে। এমন বিধান রেখেই ফের আসছে সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা-১৯৭৯ এর সংশোধনী। এরই মধ্যে আচরণ বিধিমালা সংশোধনীর খসড়া তৈরি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। শিগগির এটি আরও যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে চূড়ান্ত করে প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিধি অনুবিভাগ) আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, কর্মচারী আচরণবিধিমালা আরও কঠোর ও স্পষ্ট করতে চায় সরকার, যাতে প্রত্যেকের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়। এ জন্য আচরণবিধি সংশোধনের কাজ চলছে। চলতি মাসে এ বিষয়ে একটি কর্মশালার আয়োজন করা হবে।
তথ্য প্রকাশে আসছে কঠোরতা : বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী সরকারি কর্মকর্তারা বিভাগীয় প্রধানের অনুমতি ছাড়া বেতার কিংবা টেলিভিশন অথবা কোনো সংবাদপত্র বা সাময়িকীতে নিজ নামে অথবা বেনামে বা অন্যের নামে কোনো নিবন্ধন বা পত্র লিখতে পারেন না। খসড়া আচরণবিধিতে অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের কথাও বলা হয়েছে। করোনাকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে কঠোরতা আরোপ করে পৃথক প্রজ্ঞাপনও জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এসব বিষয় এবার আচরণবিধিতে যুক্ত করা হচ্ছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছাড়া অন্যদের গণমাধ্যমে তথ্য প্রকাশে বা কথা না বলতে করোনাকালে জনপ্রশাসন থেকে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগে চিঠিও দেওয়া হয়।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, সরকারি কর্মচারীদের জনবান্ধব করতে রাজনৈতিক ব্যবস্থারও দায় রয়েছে। আমরা একটা মন্দ প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এখানে ডেমোক্রেসি যদি ফাংশনাল হয়, তাহলে কিন্তু জনপ্রশাসনও অধিকতর জনমুখী হতে বাধ্য। পাশাপাশি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও ভাবতে হবে, তারা শুধু জনগণের সেবা দেওয়ার জন্যই দায়বদ্ধ। সূত্র : সমকাল।
সোনালীনিউজ/এমএএইচ