ঢাকা: ষাটের দশকের অন্যতম কবি, প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সাংবাদিক সাযযাদ কাদির চলে গেছেন না ফেরার দেশে। রেখে গেছেন কিছু শব্দ, উচ্চারণ আর অনুভূতি-
এ শহর থেকে চলো সব দুঃখ নিয়ে যাই
এই ভাঙা অলি-গলি
উপচে পড়া নর্দমা-আবর্জনা
এই যানজট
বিদ্যুৎ বিভ্রাট
গ্যাস পানি সংকট
বাজারে পাজারে পাগলা ঘোড়া
ফাটকাবাজারে নিঃস্ব আত্মহন্তা
এতোসব দুখ নিয়ে, চলো, এখনই চলে যাই। (আমার ভুলবাসা)
হ্যাঁ, সব দুঃখ নিয়েই না ফেরার দেশে চলে গেলেন কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক সাযযাদ কাদির। বৃহস্পতিবার (৬ এপ্রিল) দুপুর ২টার দিকে রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করনে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০। তিনি স্ত্রী ও ৫ সন্তান রেখে গেছেন। বিকেল ৫টায় জাতীয় প্রেসক্লাবে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে তাঁকে টাঙ্গাইলে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
কবি সাযযাদ কাদিরের মৃত্যুতে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর গভীর শোক প্রকাশ করেছেন ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। শোক জানিয়েছেন জাতীয় কবিতার পরিষদের সভাপতি কবি মুহম্মদ সামাদ। তিনি বলেছেন, কবি সাজ্জাদ কাদির আমাদের দেশের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার মৃত্যু আমাদের জন্য বিশাল ক্ষতি।
জাতীয় প্রেসক্লাবের এই স্থায়ী সদস্যের মৃত্যুতে জাতীয় ক্লাব সভাপতি মুহম্মদ শফিকুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন এক শোকবার্তায় গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, তাঁর মৃত্যুতে জাতি একজন দেশবরেণ্য সাংবাদিক ও কবিকে হারালো। তাঁর শোকসন্তপ্ত স্বজনদের প্রতি তারা সমবেদনা জানান।
সাযযাদ কাদির ১৯৪৭ সালের ১৪ এপ্রিল টাঙ্গাইল জেলার মিরের বেতকা গ্রামে মাতুলালয়ের দেলদুয়ার জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬২ সালে বিন্দুবাসিনী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ১৯৬৯ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৭০ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৭৮ সালে ‘রেডিও বেইজিং’-এ যোগ দেন সাযযাদ কাদির। ১৯৮০ সালে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত দৈনিক সংবাদে কাজ করেন। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত কাজ করেন আগামী- তারকালোক ও দৈনিক দিনকালে।
১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটে (পিআইবি) যোগ দেন। সেখানে ছিলেন ২০০৪ সাল পর্যন্ত। এরপর তিনি দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় কাজ শুরু করেন, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পত্রিকাটির যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে কাজ করছিলেন।
পদক-পুরস্কার: তিনি এ বছর জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার পান। এছাড়া বাচসাস পুরস্কার (২০০২), এম নুরুল কাদের পুরস্কার (২০০৪), ময়মনসিংহ প্রেস ক্লাব পদক (২০০৬), ভাষাসৈনিক শামসুল হক পদক (২০০৮), কবি বিষ্ণু দে পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত (২০১০), শৈবভারতী পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত (২০১৩), টাঙ্গাইল সাহিত্য সংসদ পুরস্কারসহ বহুবিধ পুরস্কারে ভূষিত হন।
প্রকাশিত বই: কবিতা- যথেচ্ছ ধ্রুপদ; রৌদ্রে প্রতিধ্বনি; দূরতমার কাছে; দরজার কাছে নদী; আমার প্রিয়; এই যে আমি; জানে না কেউ; বিশ্ববিহীন বিজনে; মণিমালা সিরিজ; বৃষ্টিবিলীন; আমার ভুলবাসা।
গল্প: চন্দনে মৃগপদচিহ্ন; অপর বেলায়; রসরগড়; গল্প সংগ্রহ। উপন্যাস : অন্তর্জাল; খেই; অনেক বছর পরে; জলপাহাড় : চার চমৎকার; আঁচ।
প্রবন্ধ-গবেষণা: ভাষাতত্ত্ব পরিচয়; হারেমের কাহিনী: জীবন ও যৌনতা; রবীন্দ্রনাথ : মানুষটি; রবীন্দ্রনাথ : শান্তিনিকেতন; বাংলা আমার; সহচিন্তন; বিচলিত বিবেচনা; চুপ! গণতন্ত্র চলছে...; ম্যাঙ্গো পিপল উবাচ; সহস্রক; সাহিত্যে ও জীবনে রবীন্দ্র-নজরুল; শান্তিনিকেতন শ্রীনিকেতন বিশ্বভারতী; রাজরূপসী; পৃথিবীর প্রিয়প্রণয়ী; নারীঘটিত; বরণীয় স্মরণীয়; রমণীমন; জানা-অজানা বাংলা।
শিশুতোষ: তেপান্তর; মনপবন; রঙবাহার; বীরবল নামা; এফফেনতি; উপকথন; উপকথন আরও; উপকথন আবারও; উপকথন ফের; উপকথন তেপান্তর; ইউএফও : গ্রহান্তরের আগন্তুক; জমজমাট; জানা আছে জানা নেই; সাগরপার; তেনালি রামন (দিব্যপ্রকাশ); মহাবীর হারকিউলিস; সিংহজয়ী হারকিউলিস; হাইড্রা ও হারকিউলিস; সেরা বীরবল।
ভাষান্তর: লাভ স্টোরি (এরিক সিগাল); রসচৈনিক; বাংলার লোককথা; ফোক-টেলস্ অভ বেঙ্গল; ইলিয়াড (হোমার)।
স্মৃতিকথা: নানা রঙের দিন; উদ্যত সঙ্গীনের নিচে।
সম্পাদনা: শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা; এই সময়ের কবিতা; এই সময়ের কবিতা ২০১৪; এই সময়ের কবিতা ২০১৫; প্রেমপাঁচালি; ডা. লুৎফর রহমান রচনাবলি।
সাযযাদ কাদির শুধু কবিতাই নয়, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ-গবেষণা, শিশুতোষ, সম্পাদনা, সংকলন, অনুবাদসহ বিভিন্ন বিষয়ে ৬০টির বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন।
সোনালীনিউজ/এন