ঢাকা : দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত কাউকে জাতীয় সংসদের আসন্ন উপ নির্বাচনে মনোনয়ন দেবে না আওয়ামী লীগ। প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষেত্রে অন্যসব বিষয়ের সঙ্গে এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবে ক্ষমতাসীন এ দলটি। কিছু জনপ্রতিনিধি ও নেতাকর্মীর দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততায় বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টির ফলে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকারি দল।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র দলের এ অবস্থানের কথা জানিয়েছে। এদিকে শূন্য হওয়া আসনগুলোর নির্বাচনে আওয়ামী মনোনীত প্রার্থীরা জয়ী হবে বলেও প্রত্যাশা দলটির।
আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্যের মৃত্যুর কারণে বর্তমানে দেশের পাঁচটি সংসদীয় আসন শূন্য রয়েছে। এদের মধ্যে পাবনা-৪ আসনের তফসিল রবিবার (২৩ আগস্ট) ঘোষণা করা হয়েছে। আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর এ আসনের উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। শূন্য হওয়া ঢাকা-৫ এবং নওগাঁর-৬ আসনে নির্বাচন হবে ১৭ অক্টোবর। তবে ঢাকা- ১৮ এবং সিরাজগঞ্জ-১ আসনের নির্বাচনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কোনও সিদ্ধান্ত এখনও নেয়নি।
এদিকে সবগুলো আসনের ভোটের সিদ্ধান্ত না হলেও আওয়ামী লীগ তাদের প্রার্থিতা চূড়ান্ত করে রাখছে। দলীয় মনোনয়নের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে আগ্রহীদের কাছ থেকে দলীয় মনোনয়ন গ্রহণ করেছে তারা। প্রার্থিতা চূড়ান্ত করতে শিগগিরই দলের সংসদীয় বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হবে।
আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, বরাবর প্রার্থিতা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে দলের পক্ষ থেকে যেসব ক্রাইটেরিয়া বিবেচনা করা হয়, এবার সেগুলোর পাশাপাশি দুর্বৃত্তায়ন-সন্ত্রাসের সঙ্গে সম্পৃক্ততা আছে কিনা তা বিবেচনা করা হবে। কোনও ধরনের সন্ত্রাস-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কাউকে মনোনয়ন দেওয়ার জন্য বিবেচনা করা হবে না।
দলের নেতারা প্রত্যাশা করেন, সবগুলো আসনের উপনির্বাচনে তাদের প্রার্থীরা বিজয়ী হবে। তাদের যুক্তি, যেসব আসনের সংসদ সদস্যরা মারা গেছেন তারা সবাই আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য ছিলেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই উপনির্বাচনে তাদের মনোনীত প্রার্থীরা জিতবেন। বিজয় নিশ্চিত করতে তারা যোগ্য ও জনপ্রিয়দের মনোনয়ন দেবেন বলেও জানান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, ‘আমরা প্রার্থিতা মনোনয়ন ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেই। তা হলো-দলের সঙ্গে প্রার্থীর সম্পর্ক, নির্বাচনি এলাকায় তার অবস্থান বা জনপ্রিয়তা এবং সক্ষমতা। তবে এর বাইরেও এবার আমরা আরেকটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেবো। সেটি হলো আগ্রহী ব্যক্তি কোনও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত কিনা বা তার কোনও বদনাম আছে কিনা।’
দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের বর্তমান অবস্থানের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘কিছু নেতাকর্মী ও জনপ্রতিনিধিদের দুবৃত্তায়নের কারণে সরকার ও দলকে বিব্রত হতে হচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতি ভবিষ্যতে হোক সেটা আমরা চাই না। এজন্য দলের অবস্থান হলো দুর্বৃত্তায়নে সম্পৃক্তদের মনোনয়ন দেওয়া হবে না।
সংসদ সদস্যদের মৃত্যুর কারণে যে পাঁচটি সংসদীয় আসন শূন্য হয়েছে তার সবগুলোতেই চলতি মেয়াদসহ টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন। অবশ্য তার আগে নওগাঁ-৬ আসনটি আগের টানা তিন মেয়াদে (১৯৯১-২০০১) বিএনপির এমপি ছিলেন। এছাড়া পাবনা-৪ আসনটি ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী বিজয়ী হলেও এরপর থেকে টানা আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে আসছে।
ঢাকা- ৫ (পূর্বের -৪) আসনটি ১৯৯১ সালে বিএনপি, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ আবার ২০০১ সালে বিএনপি প্রার্থী জয়ী হন। এই আসনটির মতো ঢাকা-১৮ (পূর্বের-৫) আসনটিও ১৯৯১ সালে বিএনপি, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ আবার ২০০১ সালে বিএনপি প্রার্থী জয়ী হন। অপরদিকে সিরাজগঞ্জ-১ আসনে আগাগোড়াই আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিজয়ী হয়ে আসছেন।
মনোনয়ন সংগ্রহের ছড়াছড়ি : শূন্য হওয়া পাঁচটি আসনে উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন ১৪১ জন। গড়ে আসন প্রতি ২৮ জন মনোনয়ন চেয়েছেন। যা ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তুলনায় দ্বিগুণ।
ওই সময় দেশের ৩০০ আসনে চার হাজার ২৩ জন মনোনয়ন সংগ্রহ করেন। আসন প্রতি সংখ্যা দাড়িয়েছিল ১৪ জনের কম। সংসদ নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী সবচেয়ে বেশি ছিল বরগুনা-১ আসনে। এ আসনের মনোনয়ন চেয়েছিলেন ৫২ জন। এবারের উপনির্বাচনে ওই রেকর্ড ভেঙে গেছে। পাঁচটি আসনের মধ্যে ঢাকা-১৮ আসনের মনোনয়ন চেয়েছেন আওয়ামী লীগের ৫৬জন।
এছাড়া নওগাঁ-৬ আসনে ৩৪, পাবনা-৪ আসনে ২৮, ঢাকা-৫ আসনে ২০ এবং তিন জন সিরাজগঞ্জ-১ আসনে তাদের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন।
আ.লীগের টিকিট পেতে ১২ বছরের আমলনামা : জাতীয় সংসদের শূন্য হওয়া পাঁচটি আসনের (সিরাজগঞ্জ-১, পাবনা-৪, ঢাকা-৫, ঢাকা-১৮ ও নওগাঁ-৬) উপনির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ভিড় বেড়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে। প্রয়াত সংসদ সদস্যদের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে এমনকি আত্মীয়স্বজনও দলীয় মনোনয়ন কিনেছেন। কিন্তু আসনগুলোতে দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ে এবার খতিয়ে দেখা হচ্ছে মনোনয়ন সংগ্রহকারীর ১২ বছরের আমলনামা। যারা দলের দুর্দিনে ছিলেন, সাংগঠনিকভাবে অভিজ্ঞ, নিবেদিত ও সৎ রাজনীতিক—কেবল তারাই এবার বিবেচিত হবেন। এ বিষয়ে দলের সভাপতির অবস্থান কঠোর। ফলে অর্থের বিনিময়ে দলে অনুপ্রবেশকারী বিএনপি নেতা, রাজাকারের সন্তান, মাদক কারবারি ও হত্যা মামলার আসামিদের অবস্থা নড়বড়ে হচ্ছে দলে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, শূন্য হওয়া পাঁচটি আসনে আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভা আজ হওয়ার কথা থাকলেও অনিবার্য কারণবশত তা পিছিয়ে গেছে। বোর্ডে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। সূত্রে জানা গেছে, দলের সভাপতি যাকেই মনোনয়ন দেবেন, তার পক্ষে অন্যরা কাজ করবেন। মনোনয়ন না পেয়ে দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করলে, তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণাও দেবেন দলীয়প্রধান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সভায় দলের হাইকমান্ড প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়ায় উড়ে এসে জুড়ে বসাদের এবার কোনোভাবেই মনোনয়ন দেবে না। যারা দীর্ঘদিন ধরে (২০০৮ এর আগে) আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত কেবল তারাই বিবেচিত হবেন। এ বিষয়ে দলের সভাপতির অবস্থান কঠোর। এছাড়াও নির্বাচিত এলাকা সম্পর্কে তার জ্ঞান পর্যালোচনা করবেন। এলাকার ভোটার এবং এলাকার সমস্যা ও সম্ভাবনা ইত্যাদি সম্পর্কে প্রার্থী কতটা জানেন। নির্বাচনে জয়ী হলে এলাকা নিয়ে তার কর্মপরিকল্পনা কি। এরপর যদি এমপি হয়ে থাকেন, তাহলে বিগত দিনে তার উল্লেখযোগ্য কর্মকান্ড কি, আর যদি এমপি না হন তাহলে এলাকার জন্য তার বিশেষ অবদান কি আছে তাও খতিয়ে দেখা হবে।
এছাড়া নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগে প্রার্থীর অবস্থান, অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িত কিনা বা দলের জন্য তার অবদান; বিশেষ করে করোনা বা বন্যায় এবং দলের সংকটকালে (যেমন-১/১১ বা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, ২০১৪-১৫ সালে আগুন সন্ত্রাস) রুখতে প্রার্থীর ভূমিকা কি—এই সময়গুলোতে যাদের অবদান বেশি তারা মনোনয়নের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন।
আরো দেখা হবে, ২০০৮ সাল থেকে দল টানা ক্ষমতায় রয়েছে অর্থাৎ সাড়ে ১১ বছরের বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় রয়েছে। এ সময়ের মধ্যে দলের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন দুর্নীতি এবং অপকর্মের কারণে মনোনয়ন সংক্রান্ত সংসদীয় বোর্ড এ ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থান নেবে। অর্থ্যাৎ প্রার্থীর আর্থিক সক্ষমতা; নির্বাচনের অর্থ কোথা থেকে পাবেন; আয়ের উৎস কি, বিগত ১০ বছরে তিনি কী ধরনের কাজ করেছেন—এসব বিষয় বিবেচনা করা হবে।
এবার যে বিষয়টি মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে দেখা হবে মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রার্থীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, নিয়োগ, বদলি বাণিজ্য, চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে কিনা। ওই মনোনয়নপ্রত্যাশীর বিরুদ্ধে মাদক এবং সন্ত্রাসের কোনো অভিযোগ রয়েছে কিনা। মনোনয়নপ্রত্যাশীর বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা আছে কিনা। মামলা থাকলে কোন আমলে হয়েছে, কখন ও কী ধরনের অভিযোগ রয়েছে—তার সঠিক ব্যাখ্যা দিতে হবে।
এছাড়াও সম্প্রতি দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের কতিপয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে ত্রাণের অর্থ আত্মসাৎ, টেন্ডারে অনিয়ম, নিয়োগ বাণিজ্যের মতো অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে উঠেছে তারা মনোনয়ন দৌড়ে পিছিয়ে পড়বেন। দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে এই ধরনের ব্যক্তিকেও এবার মনোনয়ন দেওয়া হবে না বলে দলের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।
দলের উপদফতর সম্পাদক সায়েম খানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, উপনির্বাচনকে সামনে রেখে ওই পাঁচটি আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে ১৪১টি। পাবনা-৪ আসনে ২৯ জন, ঢাকা-৫ আসনে ২১ জন, ঢাকা-১৮ আসনে ৫৫ জন, নওগাঁ-৬ আসনে ৩৩ জন, সিরাজগঞ্জ-১ আসনে তিনজন মনোনয়ন কিনেছেন।
সোনালীনিউজ/এমটিআই