ঢাকা : দেশে ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধের ব্যাপকতা বেড়ে গেছে। উৎপাদন হচ্ছে ভেজাল ও নকল ওষুধও, যার ফলে ধীরে ধীরে অস্থির হয়ে উঠছে ওষুধ শিল্প ও চিকিৎসাব্যবস্থা। ভেজাল বা নকল ওষুধ সেবনের ফলে রোগীর স্বাস্থ্যঝুঁকি ও প্রাণহানির ঘটনাও ধীরে ধীরে বাড়ছে। এটি ওষুধ শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারে বিশাল অশনিসংকেত।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বর্তমানে প্রায় তিনশটি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে বছরে উৎপাদন হয় পঁচিশ হাজার ধরনের ওষুধ। এর মধ্যে মাত্র চার হাজার ওষুধ পরীক্ষা করে দেখার সামর্থ্য আছে সরকারের।
আর এর দুই থেকে তিন শতাংশ ওষুধ ভেজাল, নকল বা নিম্নমানের। বাকি একুশ হাজার ওষুধ কখনো পরীক্ষাই করা হয় না।
কিছু লাইসেন্সধারী ও লাইসেন্সবিহীন কোম্পানি অধিক মুনাফার জন্য ভেজাল ওষুধ তৈরি ও বাজারজাত করছে, যা মানুষের যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তের চেয়ে শারীরিকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
এসব ভেজাল ওষুধের বিষয়ে সাধারণ ক্রেতারা বলছেন, মানুষ আর কতভাবে প্রতারিত হবে। কোনটা ভেজাল আর কোনটা ভেজাল না সেটা আমরা কীভাবে বুঝব। এসব ভেজাল ওষুধ বন্ধ হবে কবে। রাজধানীর অলি গলিতে ও বড় বড় ওষুধ মার্কেটগুলোতে ভেজাল ও নকল ওষুধে সয়লাব। মানুষের রোগমুক্ত হয়ে বেঁচে থাকার অন্যতম অপরিহার্য উপাদান ওষুধ।
সুস্থ জীবনযাপন করতে ওষুধের ব্যবহার কোনো না কোনো সময় করতেই হয়। জীবন রক্ষায় সহায়ক হিসেবে কার্যকরী সেই ওষুধই এখন জীবন ধ্বংসের কারণ। এমনটি কারো কাম্য না হলেও কিছু নৈতিকতা বর্জিত ব্যবসায়ীরা মুনাফার লোভে উৎপাদন করছেন ভেজাল ও নকল ওষুধ। যা খেয়ে জীবন রক্ষা বা সুস্থ হওয়া তো দূরের কথা, উল্টো মানবদেহ চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এদিকে সম্প্রতি অসাধু একটি চক্র ধরার পর পুলিশ বলছে, একমি ল্যাবরেটরিজ, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, জেনিথ ফার্মাসিউটিক্যালসসহ বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডের ওষুধ নকল করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দিত তারা।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- তরিকুল ইসলাম, সৈয়দ আল মামুন, সাইদুল ইসলাম, মনোয়ার, আবদুল লতিফ, নাজমুল ঢালী ও সাগর আহমেদ মিলন। তাদের কাছ থেকে একমি কোম্পানির মোনাস-৭০০ বক্স, স্কয়ার কোম্পানির সেকলো-৫০ বক্স, জেনিথ কোম্পানির ন্যাপ্রোক্সেন প্লাস-৭৪৮ বক্সসহ বিভিন্ন কোম্পানির বিপুল পরিমাণ ভেজাল ওষুধ, ওষুধ তৈরির মেশিন, ডায়াস ও ওষুধের খালি বক্স উদ্ধার করা হয়।
এসব অপরাধের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবি পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, ডেমরা, কাজলা, আরামবাগ, লালবাগ ও মিটফোর্ড এলাকা থেকে কয়েকজন নকল ওষুধ প্রস্তুতকারকদের গ্রেপ্তার করা হয়। এই চক্রটি সারাদেশে নকল ওষুধ ছড়িয়ে দিয়েছে।
প্রত্যন্ত অঞ্চলকে টার্গেট করে বহুল বিক্রীত ওষুধগুলো নকল করে তারা বাজারজাত করছিল। আমরা আট প্রকার নকল ওষুধ উদ্ধার করেছি। যেসব ওষুধ সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়, সেগুলোই নকল করে বাজারজাত করছিল চক্রটি। আসল ওষুধের প্রকৃত দামের তুলনায় অনেক কমদামে নকল ওষুধগুলো বাজারে বিক্রি হচ্ছিল। এগুলো মাদকের থেকেও ভয়ংকর।
ভেজাল ও নকল ওষুধ সেবনের কারণে এক মাস ধরে অসুস্থ হয়ে ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন মুন্সিগঞ্জের স্বাধীন। স্বাধীন বলেন, একটি ভুল চিকিৎসা ও ওষুধের জন্য দিনের পর দিন আমাকে ভুগতে হচ্ছে।
মিরপুরের শাপলা ফার্মেসির সহকারী নজরুলের দেওয়া ওষুধ খেয়ে অসুস্থ হয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন রিকশাচালক আবুল মিয়া। এ সময় আবুল মিয়া অভিযোগ করে বলেন, আমাকে নজরুল কী ওষুধ দিল, সেটা খেয়ে আমার পেটে জ্বালা করে, ব্যথা করে, পরে আমি হাসপাতালে ১৫ দিন ধরে ভর্তি আছি। আর আমি কোনো দিন ডাক্তার না দেখিয়ে ওষুধ খাব না।
নিয়ম-কানুন মেনে স্বাভাবিক জীবনযাপন করেও মানুষ ভেজাল, মানহীন ওষুধের প্রভাবে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই। কেউ চরম কষ্টে জীবন পার করছেন, কেউবা অল্প বয়সেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছেন।
দেশে মোট ওষুধের চাহিদার ৯৭ শতাংশ অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকেই মেটানো হচ্ছে। বাকি ৩ শতাংশ ওষুধ আমদানি করতে হয়। বিশ্ববাজারে যখন বাংলাদেশের উৎপাদিত ওষুধের চাহিদা বেড়েই চলেছে ঠিক তখনই এর বিপরীত চিত্র দেশের বাজারে।
বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যান মতে, দেশীয় বাজারে ভেজাল ও নকল ওষুধের বার্ষিক বিক্রয় প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার উপরে। এই বিরাট অংকের ভেজাল ওষুধের বিক্রি থেকে সহজে অনুমান করা যায়, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের উৎপাদিত ওষুধের সুনাম থাকলেও দেশীয় বাজারে চলছে চরম অনিয়ম ও দুর্নীতি।
জাতীয় ভেজাল প্রতিরোধ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এসএম মোরশেদ বলেন, বাংলাদেশে ভেজাল ওষুধ নির্ধারণ করার মতো সরকারের পক্ষ থেকে যে জনবল রয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। একেবারেই অপ্রতুল। সেজন্য ভেজাল প্রতিরোধে গত দশ বছর ধরে আমরা কাজ করছি।
সংগঠনের পক্ষ থেকে ভেজাল খাদ্যসামগ্রী ও ওষুধ তৈরিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সচেতন করার জন্য জেলায় জেলায় প্রচারণা চালাচ্ছি। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে গিয়ে কথা বলছি। আসলে সব কিছুতেই তো ভেজাল। যে কোনো ওষুধ কোম্পানিতে গেলে দেখবেন যে, তারা যখন লাইসেন্সটা নেয়, তখন মানসম্মত ওষুধ উৎপাদন করেই লাইসেন্সটা নেয়।
কিন্তু লাইসেন্স পাওয়ার পর, তারা আর মানসম্মত ওষুধ তৈরির দিকে খেয়াল রাখে না। তখন নিম্নমানের কাঁচামাল দিয়ে ওষুধ উৎপাদন করে। ফলে এর ভুক্তভোগী হন সাধারণ মানুষ। অথচ সাধারণ জনগণ পয়সা দিয়েই এই ওষুধ কিনছেন। অথচ তাঁদের রোগ প্রতিরোধে তা কাজে আসছে না। তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজির চেয়ারম্যান অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, অনেক সময় ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধের ক্ষতিকর প্রভাব ধীরে বা দীর্ঘসময় পরে পড়লে ধরাও যায় না সেটি ভেজাল ওষুধের কারণে হয়েছে কি না।
ভেজাল বন্ধে সচেতন না হলে সাধারণ মানুষ হয়ত আবারো আমদানি করা ওষুধের ওপর নির্ভর করতে শুরু করবেন। ফলে শেষ পর্যন্ত ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন বন্ধের মূল দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, সক্ষমতা অনুযায়ী চাহিদার ৯৫ শতাংশ ওষুধের জোগান দিচ্ছে প্রস্তুতকারক দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো।
এ ছাড়া আমেরিকা, কানাডা, জাপানসহ বিশ্বের ১৫৬টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশের ওষুধ।
মানসম্পন্ন ওষুধ তৈরির জন্য আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসা কুড়ানোর পাশাপাশি ২০১৮ সালে মেডিসিন প্রডাক্ট অব দ্য ইয়ার পদকে ভূষিত হয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। তবে এত সক্ষমতা অর্জন সত্ত্বেও বাজারে কেন ছড়াচ্ছে নকল ওষুধ, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন খোদ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরও।
প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো সমন্বয় করে অভিযান চালাচ্ছে। অধিদপ্তরও নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। তবে জনবল ও লজিস্টিক সাপোর্ট কম থাকায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিয়মিত নজরদারি ও অভিযান চালানো সম্ভব হচ্ছে না।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, কয়েক বছর আগে রাজধানীর মিটফোর্ড এলাকায় নকল ওষুধ তৈরির কারখানার সন্ধান মেলে। পরে প্রতিষ্ঠিত ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের অভিযোগের ভিত্তিতে এসব কারখানায় একাধিকবার অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানের পর ভেজাল ওষুধ তৈরির কার্যক্রম কিছুটা কমলেও নিয়মিত নজরদারি না থাকায় ফের তা শুরু হয়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, ভেজাল ওষুধ ও নিম্নমানের ওষুধ কারবারি চক্রের প্রধান টার্গেট ঢাকা। এসব ওষুধ খেয়ে অনেক মানুষ অসুস্থ হচ্ছেন।
রাজধানীর মিটফোর্ড ও এর আশপাশের এলাকায় এ চক্রের সদস্যরা কারখানা গড়ে তোলে। পরবর্তীকালে চাহিদা বাড়তে থাকায় কুমিল্লা ও বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় গড়ে ওঠে কারখানা। এসব কারখানার তৈরি নকল ওষুধ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে। যার কারণে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, আমরা নকল ওষুধ প্রতিরোধের জন্য আপাতত দোকানদারকে ইনভয়েসের মাধ্যমে ওষুধ ক্রয়ের জন্য বলেছি। সেই সঙ্গে বলা হয়েছে চিকিৎসকের অনুমতি ছাড়া কাউকে ওষুধ দেওয়া যাবে না।
তিনি বলেন, কোম্পানির অনুমোদিত প্রতিনিধির কাছ থেকেই ওষুধ নিতে হবে। এর বাইরে নকল ও ভেজাল ওষুধ ঠেকানো সম্ভব না। স্যাম্পল ওষুধ কোনো দোকানদার বিক্রি করতে পারবে না। এটা আইনগত নিষিদ্ধ। এটা করা হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, ড্রাগস আইনে নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদনকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান আছে ১০ বছর। তবে জরিমানার অঙ্ক নির্দিষ্ট না থাকলেও তা অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন হয় না। বিশেষ ক্ষমতা আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে।
কিন্তু মামলা হওয়ার পর তদন্তের ক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ফেলে নকল ওষুধ উৎপাদনকারীরা। তাদের টাকার অভাব নেই। নকল ওষুধে পুরোটাই লাভ।
নকল ওষুধ চেনার উপায় : ওষুধ বিক্রতারা জানান, ভেজাল ওষুধ তো সাধারণ মানুষ বোঝে না। যারা ভেজাল ওষুধ তৈরি করে তারা অনেক ক্ষেত্রে হুবহু নকল করতে পারে না। তাই ওষুধের প্যাকেটের গায়ে যে সিল থাকে সেটি ভালো করে দেখুন কোথাও কোনো গলদ আছে কি না।
লেবেল একই আছে কি না। আগে যদি আপনি একই ওষুধ কিনে থাকেন তাহলে পরের বার কেনার সময় আগের প্যাকেটের সঙ্গে প্যাকেজিং, অক্ষরের ফন্ট, বানান, রং এগুলো মিলিয়ে দেখতে হবে। ওষুধ সেবনের আগে খেয়াল করুন ওষুধের রং, আকার, গঠন ঠিক আছে কি না। ওষুধের কোথাও কোনো ভাঙা অংশ আছে কি না। গুঁড়া ওষুধের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত পরিমাণে দেওয়া আছে কি না। এসব ভালো করে দেখুন। ওষুধ যদি ক্রিস্টালের মতো হয় তাহলে যথেষ্ট শক্ত কিংবা অতিরিক্ত নরম কি না দেখুন।
আমরা বলতে পারি কিন্তু যারা ওষুধ সেবন করবেন তাদের বেশি করে খেয়াল রাখতে হবে আমরা সঠিক ওষুধ কিনছি কি না। সাধারণ মানুষকে ঠকাচ্ছে এসব ভেজাল ও নকল ওষুধ কোম্পানিরা।
সোনালীনিউজ/এমটিআই