ঢাকা : রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে পুলিশের কিছু সদস্য। নারী কেলেঙ্কারি, অনিয়ম, ঘুষ, দুর্নীতি ও দায়িত্বে অবহেলা ছাড়াও মাদক ব্যবসাসহ নানা ফৌজদারি অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন পুলিশ সদস্যরা। ডিআইজি মিজানকাণ্ডে এখনো কোনো আইনগত ব্যবস্থা না নেওয়ায় পুলিশের অপরাধ নিয়ে শঙ্কিত অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।
অনেকেই বলছেন, একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়ার পর ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় পুলিশ বাহিনীতে ঘাপটি মেরে থাকা অপরাধীরা আরো উৎসাহ পাবে। এতে জনমনে পুলিশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হবে। যদিও গুরুতর অভিযোগে ২০১৮ সালে
মোট ৩২ জনকে চাকরিচ্যুত ও বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় শাশুড়িকে ছুরিকাঘাতে হত্যার দায়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কনস্টেবল অসীম ভট্টাচার্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের পাঁচ দিন পর গতকাল বুধবার বিকেলে চুয়াডাঙ্গা-আলমডাঙ্গা সড়কের ছাগলফার্ম এলাকা থেকে অসীমকে গ্রেপ্তার করা হয়।
অপরদিকে ১৪ জুন ১০ হাজার পিস ইয়াবাসহ সিদ্দিকুর রহমান নামে এক কনস্টেবলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। তাকে পাঁচ দিনের পুলিশ রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। এর আগে ময়মনসিংহ শহরের নওমহল সারদা ঘোষ রোড এলাকা থেকে পুলিশের এক কনস্টেবলসহ তিনজনকে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত ১৪ জুন রাতে ২নং পুলিশ ফাঁড়ির একটি দল সারদা ঘোষ রোড এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে।
পুলিশ জানায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ২নং পুলিশ ফাঁড়ির একটি দল নওমহল এলাকায় অভিযান চালিয়ে ময়মনসিংহ পুলিশ লাইন্সে কর্মরত কনস্টেবল মোখছেদুল ইসলাম, তার সহযোগী কলেজ রোড এলাকার সৌরভ ও সুনামগঞ্জের দেবাশীষকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৮০০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। গত ১৫ জুন বগুড়ায় এক যুবককে থানায় আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগে তিন পুলিশ সদস্যকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।
তারা হচ্ছেন-বগুড়া সদর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আবদুল জব্বার, সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) এরশাদ আলী ও কনস্টেবল মুন্সী এনামুল হক। পুলিশের নির্যাতনের শিকার সোহান বাবু আদর (৩২) বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সার্জারি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
তিনি শহরের সুলতানগঞ্জ পাড়ার সাইদুর রহমানের ছেলে। আদর ও তার বড় বোন সম্পা বলেন, গত বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে থানার কনস্টেবল মুন্সী এনামুল হক মোবাইলে ফোন করে আদরকে থানায় ডেকে নিয়ে আটকে রেখে নির্যাতন করে।
এ ব্যাপারে অতিরিক্ত আইজিপি মইনুর রহমান বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তার বিরুদ্ধে তদন্তসাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তিনি আরো বলেন, প্রতি মাসে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, পুলিশ সদস্য হলে কী হবে, আইন তার জন্যও সমান। কেউ অপরাধ করলে তাকে শাস্তি পেতেই হবে-কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, পুলিশের মধ্যে যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে, তা খোদ পুলিশ বিভাগের তৈরি পরিসংখ্যানেই পাওয়া যায়। পুলিশের দেওয়া পরিসংখ্যানে দেখা যায়, নানা ধরনের ছোট-বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ায় প্রতি মাসে প্রায় এক হাজার পুলিশ সদস্য ও কর্মকর্তার কম-বেশি সাজা হচ্ছে। প্রতি বছর গড়ে সাত থেকে আট হাজার পুলিশের সাজা হচ্ছে। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে দুই হাজার পুলিশের সাজা হয়েছে।
এর মধ্যে কনস্টেবল থেকে সাব-ইন্সপেক্টর পর্যন্ত সাজা হয়েছে এক হাজার ৯০০’-এর বেশি। ইন্সপেক্টর, এএসপি ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদমর্যাদার ২৮ জনের বেশি সাজা পেয়েছেন। পুলিশের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার পর শুধু যে বিভাগীয় মামলায়ই সাজা হচ্ছে তা-ই নয়, কঠোর অপরাধের বিচারের জন্য পুলিশ বিভাগ থেকেই অনেক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাও হচ্ছে। প্রতিদিনই পুলিশ সদর দপ্তরে পুলিশের বিভিন্ন অপরাধের কারণে অভিযোগ জমা পড়ে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত পাঁচ বছরে পুলিশের বিরুদ্ধে ৫২০টি ফৌজদারি মামলা দায়ের হয়েছে। এই মামলাগুলোতে ৬৯০ জন পুলিশ সদস্য অভিযুক্ত।
২০১৮ সালে পুলিশের বিরুদ্ধে ১২৮টি মামলা দায়ের হয়েছে। চলতি বছরে নির্যাতন করা, অপহরণ, যৌন হয়রানি, হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে পুলিশের বিরুদ্ধে বেশ কিছু মামলা হয়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা-১৯৮৫ অনুযায়ী অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
এ ছাড়া সদর দপ্তরে পুলিশের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ, সন্ত্রাসীদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগসূত্র রয়েছে এমন অভিযোগে প্রায় হাজারেরও বেশি সদস্যের বিরুদ্ধে বর্তমানে তদন্ত চলছে। ২০১৮ সালের পুলিশ সদর দপ্তরের সিকিউরিটি সেলে পাঁচ হাজার ৯১৫ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ জমা রয়েছে। যার মধ্যে গুরুতর অভিযোগ এসেছে দুই হাজার ১৭ জনের বিরুদ্ধে। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এক হাজার ৩৪ জনের বিরুদ্ধে। গুরুতর অভিযোগে ২০১৮ সালে মোট ৩২ জনকে চাকরিচ্যুত ও বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে কনস্টেবল ও এএসআই পর্যায়ের সদস্য বেশি।
পুলিশের সাবেক আইজি একেএম শহীদুল হক বলেন, পুলিশের ব্যক্তিগত অপরাধ কমিয়ে আনতে সবচেয়ে বেশি জরুরি বাহিনীকে রক্ষণাবেক্ষণ নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা। এসব তদারকি কর্মকর্তা তথা পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তারা করে থাকেন। আবার পুলিশ সুপার ও সমমর্যাদার কর্মকর্তাদের কর্মকাণ্ড তদারকি করেন তদূর্ধ্ব কর্মকর্তারা। পুলিশ একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী। এখানে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। ঢিলেঢালা হলে ঘাপটি মেরে থাকা অসাধু সদস্যরা সুযোগ নেয়-তারা ব্যক্তিস্বার্থে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। পুলিশের নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়নে মেধাবীদের মূল্যায়ন করতে হবে। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিজ নিজ ইউনিটের প্রতি দায়িত্বশীল ও নজরদারি থাকতে হবে।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি ফেনীর সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম এবং ডিআইজি মিজানের নারী ও ঘুষ কেলেঙ্কারির বিষয়টি টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়। দুটি ঘটনাই পুলিশের ভাবমূতির্তে আঘাত হানে। ইতিমধ্যে মোয়াজ্জেমকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হলেও ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
সোনালীনিউজ/এমটিআই