ঢাকা: স্তন ক্যান্সারে আক্রান্তের শুরুর দিকে অনেকে অবহেলা করার কারণে ক্যান্সারটি ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় চলে যায়। আবার রোগীদের মধ্যে অনেকে মারাত্মক হতাশায় ভোগেন। তারা ভয়ে থাকেন, হয়তো স্তন কেটে ফেলতে হবে। ঝুঁকি থাকে আবারো ক্যান্সার হওয়া। এজন্য তাদের সঠিক চিকিৎসার পাশাপাশি দরকার কাউন্সেলিং।
পরিবার থেকেও সহযোগীতা দরকার এসব রোগীদের জন্য। স্তন ক্যান্সারে আক্রান্তদের চিকিৎসা ও পরামর্শের নানা দিক নিয়ে ডক্টর টিভির সঙ্গে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জিক্যাল অনকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কৃষ্ণা রূপা মজুমদার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ডা. সানজিদা হোসেন পাপিয়া।ডা. কৃষ্ণা রূপা মজুমদার: ইংল্যান্ড, আমেরিকা, সিঙ্গাপুর, এমনকি ভারতসহ সারাবিশ্বেই এখন স্ক্রিনিং এর জায়গাটা অনেক বেশী শক্তিশালী হয়ে গেছে। এসব দেশে স্তনে চাকা না থাকা অবস্থাতেই স্তন ক্যান্সার ধরে ফেলছে। যেটা শুধু স্ক্রিনিং এর কারণে হচ্ছে। স্ক্রিনিং এর কতোগুলো বিশেষ নির্ণয় পদ্ধতি থাকে। যেমন, আল্ট্রাসনোগ্রাম, জিন টেস্ট ও মেমোগ্রাম করতে হবে ইত্যাদি। আমরা কিন্তু সেই জায়গাটাতে পিছিয়ে আছি। আমার মতে, এখানে সরকারের সুদৃষ্টি অবশ্যই কাম্য। কারণ এটা আসলে অনেক বিরাট আকারে চিন্তা করতে হবে। এটা কিন্তু একটা হাসপাতাল কেন্দ্রীক বা সংস্থা কেন্দ্রীক হলে হবে না। সরকারের সহযোগীতার মাধ্যমে করতে হবে। করোনা ভ্যাক্সিনেশন যেমন সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয়ভাবে হচ্ছে, স্ক্রিনিং বিষয়টাও তেমনি রাষ্ট্রীয়ভাবে করতে হবে। এর মাধ্যমে আমরা অনেক ভালো ভালো কাজে দক্ষতা দেখাতে পারবো। কারণ, তখন অনেক ছোট ছোট ইমপালপেবল লেশনগুলোও ধরা পড়বে। ক্যান্সারের শুরুতেই আমরা সেটা ধরতে পারবো। যতো তাড়াতাড়ি ধরা পড়বে, চিকিৎসাও ততো উন্নত হবে।
>>>স্তন ক্যান্সারের রোগীরা প্রথমেই ভয়টা পান হয়তো তার স্তন বা ব্রেস্ট কেটে ফেলতে হবে। এই ভয়টার কারণে চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে ক্যান্সারটাকে পুষতে থাকেন। এক সময় সেটা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চলে যায়। এক্ষেত্রে আপনার কি পরামর্শ?
ডা. কৃষ্ণা রূপা মজুমদারঃ আমাদের দেশে রোগীদের এই উদাসীনতাকে দূর করার বিষয়টা এখনো সমাধান করা যায়নি। আমাদের কাছে সব প্রযুক্তিই আছে, কিন্তু আমরা একটা জায়গায় গিয়ে রোগীকে সেই সহযোগীতা আর দিতে পারছি না। কারণ রোগীগুলো মারাত্মক অবস্থায় চলে যায়। যখন কেউ শুরুর দিকে আসেন, তখন তাকে নিয়ে সবগুলো চিকিৎসা পদ্ধতির কথাই চিন্তা করতে পারি। কিন্তু ভয়াবহতার পর্যায় পৌঁছালে অনকোপ্লাস্টি ব্রেস্ট সার্জারী করতে হয়। অনেকে মনে করেন, ক্যান্সার এবং প্লাস্টি মানে যেখান থেকে ক্যান্সারটাকে অপসারণ করা হলো সে জায়গাটা প্লাস্টি করে দেওয়া। মানে ক্যান্সার সার্জারীর পরেই জায়গাটাকে প্লাস্টি করে দেয়া। সেক্ষেত্রে দেখা যায়, কেউ হয়তো এডভান্স স্টেজে আছে, তার ক্যান্সারাস টিস্যুগুলোকে অপারেশন করি। অপারেশন চলাকালীন ফসিল সেকশন বায়োপসি একটা বিষয় থাকে, আমাদের হিস্টোপ্যাথলজিস্টের শরণাপণ্ন হতে হয়। সেটার রিপোর্টের মাধ্যমে এটা ধাপে ধাপে আমরা রেখে দিয়ে পিঠের পেছন থেকে ল্যাটিসিমাস ডর্সি মাসল নিয়ে ব্রেস্টটাকে আগের মতো করে দিতে পারি। কিন্তু পরবর্তী ধাপে রোগীকে অবশ্যই রেডিওথেরাপি নিতে হবে। তা না হলে আমাদের এক্সক্লুসিভ সার্জারীগুলো করতে পারছি না। এই জায়গাটায় আমরা অনেক বেশী পিছিয়ে আছি বা ম্যানেজ করতে পারছি না। রোগী পরবর্তীতে রেডিওথেরাপি বা কেমোথেরাপি না নিলে আমাদের এই এক্সক্লুসিভ সার্জারী করে লাভ নেই। কারণ, আগে আমাদের রোগীদের প্রাণ বাঁচাতে হবে। তারপরে তার নারীত্ব বা মাতৃত্ব রেখে দেওয়া যাবে।
>>>স্তন যদি কেটে ফেলতেই হয়, তাহলে পরবর্তীতে তার সমাধান কি?
ডা. কৃষ্ণা রূপা মজুমদার: স্তন ক্যান্সারের অনেকগুলো ধরণ আছে। দেখা যায়, কারো যদি লবুলার কারসিনোমা মাল্টিসেন্ট্রিক বা মাল্টিফোকাল জাতীয় কোনো ক্যান্সার থাকে, এই ক্যান্সারগুলো খুব ভয়ানক ক্যান্সার। সেক্ষেত্রে আমরা মাস্টেকটোমি করে দিলাম বা সমস্ত স্তনটা অপারেশন করলাম। তারপর কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি সে নিলো। নেওয়ার পরে ২ বছরের মধ্যেই সাধারণত ২য় বার ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যদি না হয় তাহলে ২ বছর পরে ব্রেস্ট রিকনস্ট্রাকশন করে দেওয়া যায়। সেটা পেট বা পিঠের থেকে মাংসপিন্ড নিয়ে করা যায়। অনেকের ক্ষেত্রে সেটা সিলিকন জেল দিয়েও রিকনস্ট্রাক্ট করা হয়ে থাকে। কিন্তু সেটা চিকিৎসা সম্পূর্ণ শেষ করার পরেই আমরা করে থাকি।
>>>কেমোথেরাপির কিছু পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া আছে। সেক্ষেত্রে রোগীদের প্রতি আপনাদের পরামর্শ কী?
ডা. কৃষ্ণা রূপা মজুমদার: অনেক রোগীই বলে থাকে, আমি প্রয়োজনে ক্যান্সারে মারা যাবো তবুও কেমোথেরাপি দিবো না। কেমোথেরাপির প্রতি এই আতঙ্ক বা ভয় রোগীদের মৃত্যু ঝুঁকি বাড়ায়। কেমোথেরাপির কিছু পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া যেগুলো আমরা অনেকেই জানি। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে চুল পড়ে যাওয়ার ব্যাপারটা। এক্ষেত্রে আমি জানিয়ে দিতে চাই, ব্রেস্ট ক্যান্সারের রোগীদের ক্ষেত্রে কেমোথেরাপি শেষ হয়ে যাওয়ার পরে অনেক সুন্দরভাবে নতুন করে চুল গজায়। আমার মনে হয়, তখন তাদেরকে আগের চেয়ে অনেক বেশী সুন্দর লাগে। কেমোথেরাপি শেষ করে রেডিওথেরাপি নিতে যাওয়ার মধ্যেই কিন্তু চুলটা গজিয়ে যায়। মানে কেমোথেরাপির যে অ্যাকশন সেটা কিন্তু ডোজ শেষ হওয়ার পরেই আস্তে আস্তে কমতে থাকে। তার মানে, আপনার চুল কিন্তু সারাজীবনের জন্যে পড়ে যাচ্ছে না। তাই এই ব্যাপারগুলো নিয়ে আপনারা কখনোই ভয় পাবেন না। পরিপূর্ণভাবে চিকিৎসা নিলে আপনিও পরিপূর্ণ সুস্থ হবেন। সুতরাং, রোগকে ভয় করুন, চিকিৎসাকে নয়।
>>>একবার স্তন ক্যান্সারের অপারেশনের পরে আবারো ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা কতোটুকু?
ডা. কৃষ্ণা রূপা মজুমদার: আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে রিকারেন্স রেটটা অনেক বেশী। কারণ, বেশিরভাগ রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যায়, একটু সচেতনরাই হয়তো কেমোথেরাপি নিলো। কিন্তু রেডিওথেরাপিটা আর নিতে পারছে না বা নিচ্ছে না। সেক্ষেত্রে আমাদের বাইরে থেকে এতো এক্সক্লুসিভ সার্জারী শিখে এসে কোনো কাজেই লাগছে না।
আমাদের দেশের নারীরা অপারেশনের পরে এই কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপির চিকিৎসাটা সম্পূর্ণ করতে পারছেন না। তাই আমরা এক্সক্লুসিভ সার্জারী না করে পুরো ব্রেস্টটাই কেটে ফেলি। কারণ, চিকিৎসাটা অর্ধেক থেকে গেলেও দেখা যায় সার্ভাইভাল রেটটা একটু বেড়ে যায়। আর যদি শুরুর দিকে আসে তাহলে ব্রেস্ট কনজারভেশন সার্জারী করা যায়। এমনকি, ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আসলেও সম্পূর্ণ চিকিৎসা নিলে এটা সম্ভব।
আমার কাছে এডভান্স স্টেজের একজন রোগী আসছে। সেই রোগীটাকে কেমোথেরাপি দিতে হবে। তার স্তনে হাইড্রোমার্গ জেল আমি ইনসার্ট করেছি। এখন সে কেমোথেরাপিতে আছে। সে ৭ সাইকেল নিয়েছে, আর মাত্র ১টা সাইকেল বাকি। তারমানে যখনই কেমোথেরাপি দিচ্ছে, টিউমারটা আস্তে আস্তে ছোট হয়ে যাচ্ছে। তারপর, আমি যে হাইড্রোমার্গ জেল ওখানে বসিয়ে দিয়েছি মার্কারের মতো, এটাকে এখন মেমোগ্রাফি করবো। এরপর মার্কারটার চারিদিকে যতোখানি টিস্যু সেটা বের করে নিয়ে আসবো। আমার এই রোগীর বয়স ৩৭ বছর এবং সে ২ বাচ্চার মা। এক্ষেত্রে সেই রোগীটার সচেতনতার জন্যে অত্যাধুনিক চিকিৎসার কথা চিন্তা করতে পারছি। তারমানে, এডভান্স স্টেজেও ব্রেস্ট রাখা সম্ভব যদি রোগীটা অনেক বেশী সচেতন হন। তবে কো-অপারেশনটাও অনেক বেশী জরুরি।
সূত্র: ডক্টর টিভি
সোনালীনিউজ/এন