ঢাকা : জন্মসূত্রে আমার বেড়ে ওঠা ঐতিহ্যবাহী চিলমারী বন্দরে। সেই শৈশবেই দেখেছি চিলমারী বন্দরের কর্মব্যস্ততা। প্রমত্ত নদ ব্রহ্মপুত্রের তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা বন্দরটি পাট বেচা-কেনা, পাট প্রসেসিং, দেশি-বিদেশি পণ্যবাহী জাহাজের আসা-যাওয়া, দেশের নানা অঞ্চল থেকে আসা ব্যবসায়ী ও পাইকারদের আনাগোনায় মুখরিত ছিল দিন-রাত। ছিল মাড়োয়ারি নামে খ্যাত হিন্দু ব্যবসায়ী ও স্থানীয় পাট ব্যবসায়ীদের পাট প্রসেসিং ও বেল তৈরির মেশিন। সে এক অভূতপূর্ব কর্মচঞ্চলতা। যদিও সে-সময় ব্রহ্মপুত্র নদের অবস্থান চিলমারী বন্দর থেকে পূর্বদিকে বেশ দূরেই ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, খরস্রোতা ব্রহ্মপুত্রের করাল গ্রাসে ভাঙতে ভাঙতে বিস্তীর্ণ এলাকা বিলীন হয়ে ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধকালে চিলমারী বন্দরটির পুরোটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। একদিকে স্বাধীনতাযুদ্ধে মানুষের দুর্গতি, দুরবস্থা; অন্যদিকে চিরচেনা চিলমারী বন্দরের জায়গা-জমি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হারিয়ে চিলমারীর মানুষ গভীর সংকটের মুখে পড়ে যায়। ফলে চিলমারী পড়ে যায় দুর্গতি, অভাব, অনটন, দরিদ্রতার কবলে। দারিদ্র্যের কি বীভৎসতা— সর্বত্রই খাবারের হাহাকার, ব্রহ্মপুত্রের গর্ভে বসতবাড়ি জমিজমা হারিয়ে পথহারা অসহায় মানুষগুলো আশ্রয় নেয় উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায়। ফলে চিলমারী নদী ভাঙনের শিকার মানুষগুলো কুড়িগ্রাম তো বটেই, এমনকি দিনাজপুর, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট জেলার বিভিন্ন স্থানে ঠাঁই গেড়ে জীবন-জীবিকা শুরু করে। আর যারা এলাকাতেই থেকে যান তাদের দুর্দশার যেন শেষ ছিল না! স্বাধীনতা-উত্তর ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে চিলমারীর পুষ্টিহীন শিশুদের বাঁচাতে থানাহাট নামক স্থানে স্থাপিত হয় বিদেশি এক এনজিও ‘টেরেডেস হোমস’। যা ‘ছিন্ন মুকুল’ নামেই পরিচিত। খাবারের অভাবে হাড্ডিসার শিশুদের বাঁচাতে ‘ছিন্ন মুকুল’-এর সে দিনের অবদান ছিল অনস্বীকার্য।
করালগ্রাসী ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনের মুখে ঐতিহ্যবাহী সেই চিলমারী বন্দরটি তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে তিন স্থানে গড়ে ওঠে। দেখতে দেখতে সেই হারিয়ে যাওয়া পাটের সুবিশাল গুদামগুলো সংকুচিত হয়ে পুনরায় রমনা নামক স্থানে স্থাপিত হয়। সে সময়ও পাট ব্যবসার ক্ষয়িষ্ণুটুকুও অবশেষ বিদ্যমান ছিল। চোখের সামনেই পাট ব্যবসায়ীদের ব্যবসা-বাণিজ্য একে একে বন্ধ হতে থাকে। ক্ষমতাসীনদের অবহেলা, উদাসীনতা আর ভ্রান্তনীতির কারণে পাট হয়ে যায় কৃষকের গলার ফাঁস। চিরচেনা সেই পাট ব্যবসা খ্যাত চিলমারী বন্দরটিতে পাটের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। বেকার হয়ে যায় এ খাতের সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার ছোট-বড় পাট ব্যবসায়ী। যে কারণে চিলমারী বন্দরে কর্মহীন অভাবী মানুষের স্রোত বাড়তে থাকে। একমাত্র ব্রহ্মপুত্র নদীকে ঘিরে নৌকায় যাত্রী পরিবহন, পণ্য পরিবহন হয়ে দাঁড়ায় নদীপাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকার একমাত্র অবলম্বন। সেখানেও বিপর্যয় ব্রহ্মপুত্রের মতো খরস্রোতা ভয়াল নদীর নাব্য সংকটের কারণে। ফলে নৌযান চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। অথচ চিলমারী বন্দরের জোড়গাছ হাট ছিল এই অঞ্চলের মানুষের জন্য আশীর্বাদ। যেখানে কৃষকের উৎপাদিত নানা ফসল কেনা-বেচা হতো। রৌমারী, রাজীবপুর তৎকালীন থানার মানুষের রুটি-রুজির অবলম্বন ছিল জোড়গাছ হাট। ব্রহ্মপুত্রের বুকে সেই বন্দরটিও বিলীন হয়ে যায়। ফলে চিলমারীর মানুষের দুর্দশার যেন শেষ ছিল না।
এসব দুর্দশা দেখতে দেখতে যেমন বেড়ে উঠেছি, তেমনি সবসময় ভেবেছি সর্বনাশা ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন থেকে কীভাবে চিলমারীবাসীকে বাঁচানো যায়। তখন আমি চিলমারীর গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ও আগ্রহী যুবসম্প্রদায়কে সংগঠিত করে ‘চিলমারী বন্দর নদী ভাঙন প্রতিরোধে কমিটি’ গঠন করে দাবি-দাওয়া তুলে ধরি। নদী ভাঙন প্রতিরোধের সে দাবিকে অনেকেই অবহেলার চোখে দেখলেও আমরা সফলতা অর্জন করি। সে-সময়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া চিলমারী সফরে এসে এক জনসভায় ঘোষণা করেন, চিলমারীকে ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন থেকে রক্ষা করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত প্রকল্প অগ্রাধিকার পেলেও নানামুখী প্রশাসনিক প্রতিকূলতা আমাদেরকে মোকাবিলা করতে হয়েছে। আমি সে-সময় উদ্যোগী ও সৎ হিসেবে পরিচিত থানাহাট গার্লস হাইস্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক নুরে ইসলাম বাদশাসহ নিরন্তর চেষ্টা করেছি এই প্রকল্প বাস্তবায়নে। সেখানে চিলমারীর গণ্যমান্য ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, চিলমারীর বাইরে থাকা ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদের ও বিদেশে কর্মরত অনেকের সহযোগিতায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাই। শেষ পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের প্রচেষ্টায় প্রকল্পটি একনেক সভায় পাস হয়। যার সুফল আমরা পেতে শুরু করি। রক্ষা হয় চিলমারী বন্দরের সর্বশেষ অবস্থানটুকু। জোড়গাছ বাজার থেকে রানীগঞ্জ ইউনিয়নের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত নদী ভাঙন রোধে তীর সংরক্ষণের কাজ ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরই এই প্রকল্পে প্রয়োজনীয় অর্থছাড় পেতে থাকে। ফলে আজ চিলমারীবাসী ব্রহ্মপুত্রের ভাঙন থেকে অনেকটাই নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করছে।
তবে চিলমারীর মানুষের অভিশাপ ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী চিলমারী বন্দরটি ছিল চরম অবহেলায়। যদিও ব্রিটিশ আমল থেকে বিদেশি জাহাজ আসা-যাওয়ায় এখানে কাস্টমস অফিস পর্যন্ত ছিল। জাহাজ চলাচল বন্ধ হওয়ায় সেটাও অকার্যকর হয়ে যায়। চিলমারী বন্দরকে আগের চেয়েও ভালো অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে ৭ সেপ্টেম্বর চিলমারীকে নদীবন্দর হিসেবে ঘোষণা করেন। সে অনুসারে ২০১৬ সালের ৮ ডিসেম্বর এ সংক্রান্ত বাংলাদেশ গেজেট প্রকাশিত হয়। এরপর ২০১৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর চিলমারীর রমনা ঘাটে একটি পন্টুন স্থাপন করে চিলমারী নদীবন্দর উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু গত ৫ বছরেও প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না থাকায় নৌবন্দরের কাজের কোনো অগ্রগতি হয়নি। চলছে মহামারী করোনার মরণ ছোবল। প্রতিদিনই সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছেই। করোনার কারণে দেশের অর্থনীতিও পর্যুদস্ত। এর মাঝে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গত ৮ জুন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। ২৩৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে চিলমারী উপজেলার রমনা ঘাট এলাকায় ২ দশমিক ৫ একর জায়গাজুড়ে নির্মাণ করা হবে যাত্রীবাহী পোর্ট এবং জোড়গাছ পুরাতন বাজার এলাকায় ৭ দশমিক ৫ একর জায়গা জুড়ে নির্মাণ করা হবে পণ্যবাহী পোর্ট। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে চিলমারী এলাকায় বন্দরে পরিবাহিত প্রায় ৩ দশমিক ২৫ লাখ যাত্রী ও ১ দশমিক ৫ লাখ টন মালামালের সুষ্ঠু ও নিরাপদ ওঠানামা নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি নৌবাণিজ্য ও অতিক্রমণ প্রটোকলের আওতায় ভারতের আসাম এবং নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনের ক্ষেত্রে অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।
উল্লেখ্য, এই সময়ে ৩৩ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নিরাপদ নৌ-চলাচলের জন্য চ্যানেলসহ ২ হাজার ৪৮০ বর্গমিটার আরসিসি জেটি এবং ৩৭৯ দশমিক ৮ বর্গমিটার স্টিল জেটি তৈরি করা হবে। এছাড়াও ৭৮৫ মিটার নদীর তীর রক্ষা, এক হাজার ৩০৪ বর্গমিটার গুদাম, ৫টি পল্টুন, বন্দর ভবন, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য ডরমেটরি নির্মাণ করবে বিআইডব্লিউটিএ। চিলমারী নদীবন্দর পুনঃচালুকরণে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দসহ একনেক সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়ায় এলাকাবাসী সরকারকে কৃতজ্ঞতার পাশাপাশি আনন্দ মিছিল বের করে।
বাংলাদেশসহ গোটা দুনিয়ায় যখন মানুষের আয় ও সম্পদের বৈষম্য বেড়েছে, তেমনি আঞ্চলিক বৈষম্যও বেড়েছে। সে হিসেবে চিলমারী উপজেলার অধিকাংশ মানুষ এখন দারিদ্র্যসীমার নিচেই বাস করে। আর এর মূল কারণ হলো, এখানে যেমন কর্মসংস্থানের অভাব, তেমনি ভৌগোলিক কারণে কুড়িগ্রাম জেলা বন্যাপ্রবণ এলাকার মধ্যে অন্যতম। ফলে চিলমারী বন্দরটি পুনরায় নতুন আঙ্গিকে চালু হলে চিলমারী বন্দরের হারিয়ে যাওয়া যৌবন আবার ফিরে আসবে। মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। গতি ফিরবে বন্দরে। ফলে এ অঞ্চলের অর্থনীতিও গতিশীল হবে। আমরা আশা করছি, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এটি একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে। এতে করে স্থানীয় জনগণের ব্যবসা-বাণিজ্যের যেমন প্রসার হবে, তেমনি নানাভাবে সাধারণ মানুষের আয়-রোজগার বৃদ্ধি পাবে। ফলে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসরত চিলমারীর সাধারণ মানুষের খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন হবে। স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, চিলমারী বন্দরের পাশ ঘেঁষে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্রের ড্রেজিংসহ বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প চলমান রয়েছে। নদী ড্রেজিং প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে চিলমারী-রৌমারী ফেরি চলাচল করবে। তখন কুড়িগ্রামের এই দুই উপজেলার মানুষ উপকৃত হবে বিশেষভাবে। আর অমিত সম্ভাবনার জায়গাটি হচ্ছে, চিলমারীর চরের বালিসম্পদ। ভূ-তত্ত্ব জরিপ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ বিজ্ঞান শিল্প গবেষণা পরিষদের তথ্যমতে, চিলমারীর চরের বালিতে রয়েছে কাচ তৈরির উপাদান কোয়ার্টজ সিলিকা। এছাড়া অন্যান্য খনিজ পদার্থের পরিমাণ ৫৪ কেজি। যদি এই খনিজ সংগ্রহ করা যায়, তাহলে সারা দেশের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানি করাও সম্ভব। ফলে চিলমারী নদীবন্দরকে ঘিরে হতে পারে শিল্পায়ন। কারণ এখানে শ্রমিকের শ্রমমূল্য এখনো কম। আর তাই এখানে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে শ্রমিকের অভাব হবে না। এখানকার শ্রমজীবী মানুষকে তখন স্বল্প ভাড়ায় দূরপাল্লার বাসে গাদাগাদি করে ‘মফিজ’ নামে দেশের নানা প্রান্তে যেতে হবে না।
অন্তত চিলমারী বন্দরকে নতুন রূপে সাজাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা এবং দেশের মহামারীর এই সংকটকালেও চিলমারী নদীবন্দরের অনুকূলে অর্থ বরাদ্দে একনেক সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়ায় সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। আমরা আশা করি চিলমারী নৌবন্দরটিতে ঐতিহ্যের হারানো যৌবন আবার ফিরে আসবে এবং এ অঞ্চলের অর্থনীতিও গতিশীল হবে।
লেখক : সমাজ বিশ্লেষক