• ঢাকা
  • সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রশ্ন উঠছে আশ্রয় দেওয়া নিয়ে

হুমকি হয়ে উঠছে রোহিঙ্গারা


বিশেষ প্রতিনিধি আগস্ট ২৭, ২০১৯, ০৩:৩৬ পিএম
হুমকি হয়ে উঠছে রোহিঙ্গারা

ঢাকা : বাংলাদেশের মানবিকতা আর উদারতার প্রশ্রয়ে বেপরোয় এখন আশ্রিত রোহিঙ্গারা। যে কারণে রোহিঙ্গাদের এখন দেশের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছেন অধিকাংশ মানুষ। দুশ্চিন্তা ও শঙ্কা বাড়াচ্ছে আশ্রয়গ্রহণকারী এসব রোহিঙ্গা।

মিয়ানমারে নির্যাতিত এসব রোহিঙ্গাকে মানবিক কারণে বাংলাদেশ আশ্রয় দিলেও এরা এখন জড়িয়ে পড়ছে নানা ধরনের বিশৃঙ্খল কর্মকাণ্ডে। যে কারণে ক্যাম্প এলাকাসহ দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন মারাত্মক হুমকিতে।

দুই বছরের মাথায় এসে কক্সবাজারের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ও রোহিঙ্গাদের কর্মকাণ্ডে প্রশ্ন উঠেছে, এত ব্যাপক পরিসরে আশ্রয় দেওয়াটা ঠিক ছিল কি-না। সে প্রশ্ন এখন বড় হয়ে আসছে।

অপরদিকে, কূটনৈতিক নাটক করা মিয়ানমার আসলেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চায় কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা।

রোহিঙ্গা সংকটের দুই বছর অতিক্রম উপলক্ষে কক্সবাজার জেলার উখিয়ার কুতুপালং মধুরছড়া (ক্যাম্প-৪) আশ্রয় শিবিরের তিনটি পাহাড় ও মাঠে জড়ো হয়েছিলেন লাখো রোহিঙ্গা। সেই মহাসমাবেশে রোহিঙ্গা নেতারা শর্ত পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।

মিয়ানমার সরকারের বিষয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আস্থার সংকট রয়েছে জানিয়ে সমবেত রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে নেতারা বলেন, আমাদের সবসময় ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।

আমাদের যদি মিয়ানমারে ফিরে যেতে হয়, একসঙ্গে যাব, একসঙ্গে সীমান্ত পার হব। এ সময় রোহিঙ্গারা দাঁড়িয়ে চিৎকার করে নেতাদের বক্তব্যের সমর্থন জানায়। রোহিঙ্গাদের মহাসমাবেশ ঘিরে নেওয়া হয়েছিল কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

এদিকে গতকাল থেকে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে থাকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে তারা রোহিঙ্গাদের নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে থাকেন। সমাবেশের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে।

জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইন থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজার এলাকার বিভিন্ন সীমান্তে রোহিঙ্গা ঢল শুরু হয়। বর্তমানে টেকনাফ ও উখিয়ায় ৩৪টি আশ্রয় শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ৫০ হাজার। কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি। তাছাড়া গত দুবছরে প্রায় ৯০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু এসব আশ্রয় শিবিরে জন্ম নিয়েছে।

সর্বশেষ গত ২২ আগস্ট দ্বিতীয় দফার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দিন নির্ধারিত ছিল। কিন্তু শর্ত ছাড়া কোনো রোহিঙ্গা ফিরে যেতে রাজি না হওয়ায় প্রত্যাবাসন স্থগিত করা হয়।

এদিকে দুই দফা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর সরকার এখন কোন দিকে যাবে সেটি স্পষ্ট নয়।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, চীনের বিশেষ উদ্যোগ ও মিয়ানমারের অনুরোধে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের তারিখ ঠিক হয়েছিল। ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু না হলেও রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য প্রস্তুতির প্রক্রিয়া চালু আছে।

জানা গেছে, আগামী মাসের শুরুতে চীন সফরে যাওয়ার কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরটি গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।  

সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট ছিল এটি। রাখাইনে ২০১৭ সালের ওই নৃশংসতাকে গণহত্যা বলছে জাতিসংঘ। কক্সবাজারের বিপুল এলাকাজুড়ে মাত্র কয়েক মাসের মাথায় যে সাত লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছিল, দুই বছরে তাদের একজনকেও ফেরত পাঠানো যায়নি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢলের শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জোট, পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ, মানবাধিকার সংগঠন ও গণমাধ্যম বাংলাদেশের পাশে আছে।

অথচ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অনেকটা আড়ালে রেখে প্রত্যাবাসনের চেষ্টা হয়েছে দুবারই। মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একধরনের কূটনৈতিক নাটক খেলছে।

চীনের সরাসরি মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সর্বশেষ ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের তারিখ ঠিক করে। এর আগে ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রথম তারিখ ঠিক হয়েছিল। দুটি চেষ্টাই ব্যর্থ হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে মিয়ানমারের ওপর নতুন করে চাপ আসতে পারে।

এ ছাড়া আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালত (আইসিসি) আর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতেও (আইসিজে) রোহিঙ্গা নিধনের অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরুর প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে।

এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে মিয়ানমার চীনের হাত ধরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য রাজি হয়।

তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হওয়ায় বাংলাদেশের দিকে আঙুল তুলছে মিয়ানমার। দেশটির সরকারি গণমাধ্যম গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমারের গত শুক্রবারের খবরে বলা হয়েছে, সম্ভাব্য প্রত্যাবাসনকারীদের কাছে স্বেচ্ছায় ফেরার ব্যাপারে যথাযথ আবেদনপত্র বিলি করা হয়নি। এ ছাড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের ৪০০ জনকে দ্রুত ফেরত পাঠানোর বিষয়টিও বাংলাদেশ অগ্রাহ্য করেছে।

রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত পাঠাতে ২০১৭ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারের সঙ্গে প্রত্যাবাসনের চুক্তি করেছিল বাংলাদেশ। এ সংকট সমাধানের জন্য বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় পন্থাকে উপায় হিসেবে দেখছে। বাংলাদেশ এ সমস্যা সমাধানে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় উপায়ের কথা সব সময় বলছে।

কিন্তু মিয়ানমার যে আসলেই প্রত্যাবাসন চাইছে না, সেটা তারা দুই দফায় প্রমাণ করেছে। রাখাইনে এখনো প্রত্যাবাসনের উপযোগী পরিবেশ তৈরি হয়নি।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এক বিবৃতিতে বলেছে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এখনো বৈষম্য অব্যাহত থাকায় কফি আনানের নেতৃত্বাধীন কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য মিয়ানমার সরকারকে অব্যাহতভাবে সহযোগিতা করে যাবে যুক্তরাষ্ট্র।

কারণ, এটা মিয়ানমার ও বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাসহ রাখাইনের সব জনগোষ্ঠীকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সেরা উপায়।
রোহিঙ্গারা যাতে স্বেচ্ছায়, মর্যাদাপূর্ণভাবে ও টেকসই উপায়ে রাখাইনে তাদের আদি নিবাসে বা পছন্দসই জায়গায় ফিরে যেতে পারে, সে ব্যাপারে মিয়ানমারকে উৎসাহ জোগাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়াস অব্যাহত থাকবে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ব্যর্থ প্রমাণ করে মিয়ানমার ও তার সমর্থকরা এদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি নষ্ট করার পাঁয়তারা করছে।

কারণ, এখন পর্যন্ত নানা রকম ঝুঁকি থাকার পরও উদারভাবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে বাংলাদেশ। তবে ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে মোটামুটি জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হয়েছিল।

সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবীর এ বিষয়ে বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের সময় আমাদের মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোকে বিবেচনায় নিতে হবে।

দেশটিতে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে সরকার, সামরিক ও ধর্মীয় নেতৃত্ব এক কাতারে রয়েছে। তাই বন্ধুদেশগুলোর সহযোগিতার পাশাপাশি এ সমস্যার দ্রুত সমাধানের জন্য মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করেন, চীন ও জাপানসহ মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ দেশের মধ্যস্থতায় পরের দফা প্রত্যাবাসনের সময়সীমা ঠিক করার সময় বাংলাদেশকে আরো সতর্ক থাকতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনকে সামনে রেখে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে মিয়ানমারের ওপর বড় পরিসরে চাপ আসতে যাচ্ছিল। তাই সেটিকে সরিয়ে দিতে মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একধরনের কূটনৈতিক নাটক করেছে। ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বরেও মিয়ানমার একই কাজ করেছিল। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আন্তরিক নয়।

কক্সবাজারে কাজ করছে এমন একটি আন্তর্জাতিক এনজিওর কর্মী আলাপকালে বলেন, রোহিঙ্গারা খুব আরামে আছে। বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যে সহায়তা দিচ্ছে তা চিন্তাও করা যায় না। ফলে পরিস্থিতি আরো জটিল হচ্ছে। রোহিঙ্গারা এখন সামাজিক সংকট তৈরি করছে। তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে। জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধে। এদের ভরণ-পোষণে সরকারকে বাজেটে বরাদ্দ রাখতে হচ্ছে। তাই এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই

Wordbridge School
Link copied!