আশুর বৃদ্ধাশ্রমই ২১ জনের নিরাপদ ঠিকানা

  • গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৫, ২০১৯, ০৪:১৩ পিএম

গোপালগঞ্জ : ‘তৃষ্ণার্তকে জল দান, ক্ষুধার্তকে অন্ন; আশ্রয়হীনকে আশ্রয় দান, ইহাই মানব ধর্ম’ -এমন একটি স্লোগানে নিয়ে ১৯৯৬ সালে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার রাহুথর ইউনিয়নের হাইশুর গ্রামে স্থাপিত হয় হাইশুর বৃদ্ধাশ্রম। সেই থেকে নানা টানাপোড়নের মধ্যে চললেও বৃদ্ধাশ্রমটি এখন ওই এলাকার বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের শেষ বয়সের ঠিকানা ও আশ্রয় হয়ে উঠেছে।

চরম অনিশ্চয়তা নিয়ে যারাই এ বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিয়েছেন, তারাও খুঁজে পেয়েছেন তাদের শেষ বয়সের নিরাপদ ও নিশ্চিত আবাসস্থল। বৃদ্ধাশ্রমের রয়েছে ২৪০ জন খাদ্য প্রদানকারী সদস্য; যারা বছরে অন্তত ১ দিনের খাদ্য বৃদ্ধাশ্রমে প্রদান করেন। তাদের এ মহানুভবতায় এখনও বেঁচে রয়েছে বৃদ্ধাশ্রমটি।

মানব সেবাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিশ্বমানব সেবা সংঘ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে এ বৃদ্ধাশ্রমটির কার্যক্রম শুরু হয়। পরে ১৯৯৯ সালে জেলার সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে এটি নিবন্ধিত হয়। বর্তমানে এখানে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা রয়েছেন ২১ জন; যাদের ৮ জন মানসিক প্রতিবন্ধী, ২ জন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এবং ৫ জন রয়েছেন স্ট্রোকের রোগী। এদের মধ্যে রয়েছেন অসহায়, নিঃসন্তান, বিধবা ও স্বামী-পরিত্যাক্তা। তাদের থাকা-খাওয়া, সেবা-শুশ্রুষা ও চিকিৎসাসহ যাবতীয় প্রয়োজন মেটাতে প্রতিনিয়ত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন বৃদ্ধাশ্রমের সেবক আশুতোষ বিশ্বাস (আশু)। বৃদ্ধাশ্রমের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের খাবার যোগাতে তিনি বাদ্যযন্ত্র নিয়ে পথে পথে গান-বাজনা করেও ভিক্ষা করেন।

প্রতিদিন সকালে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ঘুম ভাঙ্গানো থেকে বাজার-ঘাট, খাওয়া-দাওয়াসহ রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত প্রায় সকল কাজেই তাকে সহযোগিতা করেন তার সহধর্মিনী মনিকা রানী বোস। তিনি একটি প্রাইমারী স্কুলের প্রধানশিক্ষক। তিনিও তার মাসিক বেতনের বড় একটি অংশ তুলে দেন স্বামীর হাতে, ওই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের প্রয়োজন মেটাতে।

২০০১ এর শুরুতে চান্দার বিলের পাড়ে ফুলমতি নামে এক বৃদ্ধাকে পড়ে থাকতে দেখে দু’পথচারী তাকে নিয়ে আসেন হাইশুর গ্রামে এই বিশ্ব মানব সেবা সংঘের অফিসে। সেখানে চিকিৎসা পেয়ে তিনি সুস্থ হন ঠিকই; কিন্তু আপনজনদের কাছে আর ফিরে যেতে রাজী হননি। সেই থেকেই তিনি এ বৃদ্ধাশ্রমে রয়েছেন এবং তিনিই হলেন এ বৃদ্ধাশ্রমের প্রথম সদস্য। এরপর বিভিন্ন সময়ে সমাজের অবহেলিত, সহায়-সম্বলহীন অসহায় বহু বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এসেছেন এই বৃদ্ধাশ্রমে।

এ পর্যন্ত হিন্দু-মুসলিমসহ মোট ৪১ জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এ বৃদ্ধাশ্রমে এসেছেন; যাদের ১৯ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। আশুতোষ সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে আশেপাশের বিভিন্ন শ্মশাণে তাদের সৎকার করেছেন। যারা এখনও আছেন, তারা এ বৃদ্ধাশ্রমটিকে মনে করেন এটাই তাদের শেষ বয়সের নিরাপদ ঠিকানা। কিন্তু শুধুমাত্র খাদ্য-প্রদানকারী সদস্যদের সহযোগিতা দিয়ে তাদের আহার, পরিধেয় বস্ত্রাদি ও চিকিৎসাসহ দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানো ভেলায় করে সাগর পাড়ি দেয়ার মতোই কঠিন হয়ে পড়েছে।

এ বৃদ্ধাশ্রমে প্রায় শুরু থেকেই রয়েছেন ৯৭ বছরের রত্তণা বসু। তারও তিন ক‚লে কেউ নেই। দিনের অধিকাংশ সময় তিনি হুইল চেয়ারেই কাটান। ভাঙ্গা কণ্ঠে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, তিনি এখন আর হাঁটতে পারেন না। তার দৈনন্দিন ক্রিয়াকর্মে আশু ছাড়াও আশ্রমের অন্যরা তাকে অনেক সহযোগিতা করে। এখন তার আর ভালো লাগে না। চলে যাওয়ার অপেক্ষায় দিন গুনছেন।

বৃদ্ধাশ্রমে রয়েছেন গোপালগঞ্জের এক সময়ের কৃতি ফুটবলার বাবু বিশ্বাস (৫৮)। খুব ছোট করে দু’একটি কথা বলতে পারেন। স্ট্রোকের  কারণে তার ডানপাশ অনেকটাই অবশ। ভাগ্যের পরিহাসে বিগত ৯ মাস ধরে তিনি সেখানে আছেন। বিগত ৭ মাস ধরে আছেন গোপালগঞ্জ শহরের বটতলা এলাকার ধণাঢ্য পরিবারের সন্তান ইসমাইল সিকদার (৫২)।
 

সাংবাদিক দেখে তিনি হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন আর বলেন, আমার পরিবার লোকজন আমাকে সবকিছু থেকে বঞ্চিত করেছে। ঠিকমতো খেতেও দিতো না। আশু আমার কেউ না; কিন্তু ও আমাকে রাস্তা থেকে এনে এখানে আশ্রয় দিয়েছে। এখানে আমি ভালো আছি। এখানে দেড় বছর ধরে আছেন বাগেরহাটের চালনা এলাকার স্বজনহীন কৃষ্ণপদ মন্ডল (৭০)। ৪ বছর ধরে আছেন হরিদাসী (৬৮), চপলা বিশ্বাস (৬৫) ও মঙ্গল কীর্ত্তণীয়া (৭৮) সহ আরও কয়েকজন। তাদের প্রত্যেকেরই জীবনে কিছু হৃদয়-বিদারক ঘটনা রয়েছে। একসময় অসহায় সহায়-সম্বলহীনভাবেই তারা এ বৃদ্ধাশ্রমে এসে আশ্রয় নিয়েছে।

বৃদ্ধাশ্রমের সেবক আশুতোষ বিশ্বাস জানিয়েছেন, দিনে দিনে বৃদ্ধাশ্রমে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সংখ্যা বাড়ছে। বসবাসের ঘর-বারান্দা থেকে শুরু করে কোনকিছুই পর্যাপ্ত নয়। অর্থাভাবে বৃদ্ধাশ্রমের অনেক প্রয়োজনই মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। এখানে ছোট্ট একটি মন্দির রয়েছে; যেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা সকাল-সন্ধ্যায় প্রার্থনা করতে পারছেন; কিন্তু এখনও একটি প্রার্থনা-কক্ষ তৈরী করা সম্ভব হয়নি; যেখানে মুসলিম বৃদ্ধরা নামাজ পড়তে পারেন। বৃদ্ধাশ্রমের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সহযোগিতার জন্য তিনি জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদে বহুবার ধর্ণা দিয়েছেন, আকুতি জানিয়েছেন, আবেদন জানিয়েছেন। কিন্তু সরকারি বা বেসরকারি কোন সাহায্য-সহযোগিতা এখনও তিনি পাননি। সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধনকৃত হলেও বৃদ্ধাশ্রম খাতে তাদের কাছে কোন ফান্ড নেই।

বছরে ১ দিনের খাদ্য প্রদানকারী যে ২৪০ জন সদস্য রয়েছেন, তাদের কেউ কেউ বছরে একাধিক দিনের খাদ্যের ব্যবস্থা করেন। তাদের দান করা বস্ত্রাদি দিয়েই বৃদ্ধাশ্রমের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পরিধেয় বস্ত্রের ব্যবস্থা করা হয়। তারপরও বছরে বেশকিছু দিন তাকে ভিক্ষা করতে বের হতে হয়। মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে এবং পথে-ঘাটে গান-বাজনা করে তিনি যা পান তাই দিয়ে বছরের বাকী দিনগুলো কোনরকমে চালিয়ে নিচ্ছেন। তবে, গত রোজার ঈদের সময় কাশিয়ানী উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ.এস.এম. মাঈনউদ্দিন ভিখারীদের জন্য খাদ্য প্রকল্প থেকে কিছু চাল, ডাল, লবন, টোস্ট-বিস্কিটের ৫০টি প্যাকেট দান করেছিলেন বলেও তিনি জানান।

তিনি আরো জানান, কাশিয়ানীর ঝাটিগ্রামের মানুষ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ মানব রঞ্জন ঘোষ, যিনি বেশিরভাগ সময় রাশিয়াতে অবস্থান করেন, তিনি যখন দেশে থাকেন তখন প্রতিমাসেই একবার অন্ত:ত এই বৃদ্ধাশ্রমে আসেন এবং বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদেরকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেন। এছাড়াও গোপালগঞ্জের সিভিল-সার্জন ডাঃ তরুণ মন্ডল মাঝেমধ্যে আসেন এবং সম্ভবমতো চিকিৎসা সেবা দিয়ে যান। এছাড়াও বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিবেশী রয়েছেন গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা পরিবার-পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ তপন মজুমদার। তিনিও সেখানে মাঝেমধ্যে যান। বৃদ্ধাশ্রমের অসুস্থ বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ঔষধপত্রের যোগান দেন ডাঃ নির্মল কান্তি বিশ্বাস। তিনি মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভদের কাছ থেকে যেসব স্যাম্পল পান, তা থেকেই তিনি এ ঔষধপত্রের ব্যবস্থা করেন।

এছাড়াও রত্নগর্ভা মঞ্জু বিশ্বাস মাঝেমধ্যেই খাদ্যদ্রব্য ও পরিধেয় বস্ত্রাদি দান করেন এ বৃদ্ধাশ্রমে। এসব সাহায্য-সহযোগিতা দিয়েই বর্তমানে চলছে হাইশুর বৃদ্ধাশ্রম। কিছুদিন পরই শীত আসছে। প্রতিবছর শীতের সময় এসব বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের প্রচুর শীতবস্ত্র দরকার হয়। কিন্তু বাংলাদেশ রেড-ক্রিসেন্টে আবেদন করেও কখনও তাদের সাড়া মেলেনি। তারপরও তিনি এ বৃদ্ধাশ্রমটিকে বাঁচিয়ে রাখতে সর্বতো চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

আমরাও চাই, এ বৃদ্ধাশ্রমটি অটুট থাকুক। এখানে আশ্রিত বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও শেষ বয়সে বেঁচে থাকুক পরম নির্ভরতায়। আনন্দে কাটুক সারাক্ষণ। আমরা তাদের পাশে থাকতে চাই। তাদেরকে সেবা দিতে চাই।

এইচবি/এএস