বন্যা পরিস্থিতি: কোথায় কি ঘটলো সারাদিন

  • নিউজ ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুন ২০, ২০২২, ০৮:০০ পিএম

ঢাকা : সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি না হওয়ায় আতঙ্কে আছেন মানুষজন। এছাড়া নগরের ফাঁকা বাসাবাড়িতে চুরি ও ডাকাতি বেড়েছে। এদিকে সুনামগঞ্জ পৌর শহর থেকে কমতে শুরু করেছে বন্যার পানি। ফলে চারদিন পর শহরের ৫০ শতাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়েছে। মৌলভীবাজারের বড়লেখা, জুড়ি, কুলাউড়া, সদর ও রাজনগর উপজেলার ৪ শতাধিক গ্রামের আড়াই লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। মৌলভীবাজার শহরের চাদঁনীঘাট পয়েন্টে মনু নদীর পানি বিপদসীমা ছুইঁ ছুঁই করছে। এতে মৌলভীবাজার শহরও প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। হবিগঞ্জে খোয়াই নদীর পানি বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে দেখা গেছে। 

অপরদিকে টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে বিপৎসীমার ১০৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ফেনীর মুহুরী নদীর পানি। বাঁধ ভেঙে জেলার ফুলগাজী উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বিপৎসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার ওপরে যমুনার পানি। কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলের ঘোড়াউত্রা ও কালনী নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের পানুর গ্রামের বাসিন্দা ও আওয়ামী লীগ কর্মী মানিক মিয়ার (৩৮) মৃত্যুর পর তার জানাজা পড়ার স্থান নিয়ে বাধে বিপত্তি। কারণ পুরো গ্রামই তলিয়ে আছে বন্যার পানিতে। 

এছাড়াও টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, ফরিদপুরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সারাদেশের বন্যা নিয়ে আমাদের ডেস্ক রিপোর্ট-


সিলেটের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে তীব্র খাদ্য সংকট

সিলেটের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় পাঁচদিন ধরে আটকে আছেন কয়েক লাখ মানুষ। অধিকাংশ ভবনের নিচতলা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় দুই ও তিনতলায় আশ্রয় নিয়েছেন অনেকে। এ অবস্থায় ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়েছেন সিলেটের প্রায় ২০ লক্ষাধিক মানুষ। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে থাকা প্রায় আড়াই লাখ মানুষ রয়েছেন তীব্র খাবার সংকটে।

এখনো মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রের খোঁজে আছে। সেনাবাহিনী তাদের উদ্ধার ও ত্রাণ বিতরণ এবং চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তবে তা প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রতুল।

এর মধ্যে নেই বিদ্যুৎ, মুঠোফোনগুলো বন্ধ। এমন ভুতুড়ে পরিস্থিতিতে মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রায় ৫০০ আশ্রয়কেন্দ্রে খাদ্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। সরকারি ও বেসরকারীভাবে দেওয়া ত্রাণ অপ্রতুল বলছেন বন্যাদুর্গতরা। খাদ্য সংকটে অভুক্ত রয়েছে আশ্রয় কেন্দ্রে রাখা ৩১ হাজার গৃহপালিত পশুও।

এদিকে বন্যার পানি তেমন কমছে না। গতকাল সন্ধ্যা ৬টা থেকে আজ সকাল ৬টা পর্যন্ত সুরমা নদীর সিলেট সদর পয়েন্টে পানি কমেছে মাত্র দশমিক ১ সেন্টিমিটার। আর একই সময়ে সিলেটের জকিগঞ্জের অমলসীদ পয়েন্ট কুশিয়ারা নদীর পানি বেড়েছে দশমিক ৯ সেন্টিমিটার। বন্যা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি না হওয়ায় আতঙ্কে আছেন লোকজন। এছাড়া নগরের ফাঁকা বাসাবাড়িতে চুরি ও ডাকাতি বেড়েছে।

এমন অবস্থায় নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছেন নগরের বাসিন্দারা। এখন আর নগরে কোনো আশ্রয়কেন্দ্র খালি নেই। সবজায়গায় লোকজনে টই-টম্বুর। এছাড়া বিভিন্ন উপজেলায় বন্যাদুর্গতরা চাইলেই আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারছেন না। অতিরিক্ত পানি থাকায় তারা বাসাবাড়ির সিঁড়িতে এমনকি বাসার ছাদেও ত্রি-পল টানিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।

কেউ কেউ আশ্রয় খুঁজছেন আত্মীয়স্বজন আর পরিচিতজনদের বাড়িতে। বহুতল ভবনের নিচতলার বাসিন্দারা উঠে যাচ্ছেন দোতলা, তিনতলায়। আর যাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, তারা ছুটছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। কিন্তু পর্যাপ্ত সরকারি সহায়তা না থাকায় আশ্রয়কেন্দ্রের বাসিন্দারা ভুগছেন খাদ্য সংকটে। নিজেদের জমানো সঞ্চয় আর মানুষের সহায়তাই এখন তাদের ভরসা।

স্থানীয়রা জানান, টানা বৃষ্টি ও জমে থাকা বন্যার পানির কারণে ঘর থেকে বের হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। যাতায়াত ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ায় ত্রাণ কার্যক্রমও খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। অনেকের ঘরে চাল-সবজি থাকলেও সেগুলো রান্না করে খাওয়ার মতো ব্যবস্থা নেই। বেশিরভাগ ঘরবাড়িতে পানির কারণে আগুন জ্বালানের ন্যূনতম সুযোগও নেই।

সরেজমিনে মহানগরের ঘাসিটুলা, কলাপাড়া, লামাপাড়া, নগরের শামীমাবাদ, কানিশাইল, সুরমা আবাসিক এলাকা, শাহজালাল উপশহর, সোবহানিঘাট, শাপলাবাগ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, চারদিকে থৈ থৈ পানি। রাস্তা, দোকানপাট, বাসাবাড়ি, ঘরের মধ্যে পানি। কোথাও কোথাও হাঁটুপানি আবার কোথাও কোমরপর্যন্ত। মানুষজন অসহায় হয়ে ত্রাণের অপেক্ষায় বসে আছেন।

সিলেট জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী রোববার পর্যন্ত সিলেটে সিটি করপোরেশন, ৫টি পৌরসভা ও ১৩টি উপজেলায় মোট ৪৯৭টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ২ লাখ ৩০ হাজার ৬৩২ জন আশ্রয় নিয়েছেন। ৩১ হাজার গবাদিপশুকেও উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হয়েছে।

চারদিন পর বিদ্যুৎ পেলো সুনামগঞ্জ

সুনামগঞ্জ পৌর শহর থেকে কমতে শুরু করেছে বন্যার পানি। ফলে চারদিন পর শহরের ৫০ শতাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়েছে। এরমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হাসপাতাল, কারাগার, জেলা প্রশাসক কার্যালয়, সদর থানা রয়েছে।

সোমবার (২০ জুন) সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়।

সুনামগঞ্জ বিদ্যুৎ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মশিউর রহমান বলেন, পৌর শহরের ৫০ শতাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছি। গুরুত্বপূর্ণ অফিসগুলোতে বিদ্যুৎ দেওয়া হয়েছে। আরও এলাকায় দেওয়ার জন্য কাজ করছি। তবে যেসব এলাকার পানি এখনো নামেনি, সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরে স্বাভাবিক হবে।

মৌলভীবাজারে আড়াই লাখ মানুষ পানিবন্দি

ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে মৌলভীবাজারের বড়লেখা, জুড়ি, কুলাউড়া, সদর ও রাজনগর উপজেলার ৪ শতাধিক গ্রামের আড়াই লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। জেলার নদনদীর পানি কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

কুলাউড়া ও বড়লেখা উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় গ্রামগুলোতে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রয়েছে। বাড়িঘরে পানি ওঠায় বিভিন্ন স্কুল-কলেজে কয়েকশ পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় ত্রাণ সামগ্রী অপ্রতুল।

কুশিয়ারা নদী ও হাকালুকি হাওরের পানি বেড়েছে। এতে ১০টি ইউনিয়নের ২০০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বন্যা কবলিত হয়েছেন ৫০ হাজার মানুষ।

কুলাউড়া উপজেলায় অতি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। নদ-নদীসহ হাকালুকি হাওরের পানি বাড়ায় ভূকশিমইল, ভাটেরা, জয়চন্ডী, ব্রাহ্মণবাজার, কাদিপুর ও কুলাউড়া সদরসহ ১৩টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। শতাধিক গ্রামের মানুষ পানিবন্দি। গ্রামগুলোর সঙ্গে বিদ্যুৎ সংযোগ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় বিচ্ছিন্ন।

এছাড়াও জুড়ী উপজেলার ৩টি, সদর উপজেলার ৬টি এবং রাজনগর উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের ১ লাখ মানুষ বন্যা কবলিত হয়েছেন। নদী ও হাকালুকি হাওরের পানি বৃদ্ধি পেয়ে জেলার হাওরাঞ্চল ও কুশিয়ারাপাড়ে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন বানভাসি মানুষ। এর মধ্যে রাজনগর উপজেলার উত্তরভাগ ইউনিয়নের ওয়াবদা বেড়িবাঁধের উত্তর পাশে কুশিয়ারা নদীর তীরের রামপুর, সুরিখালসহ অন্তত ২০ গ্রামের প্রায় ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি। এদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন পার্শ্ববর্তী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বন্যা দুর্গত মানুষের সংখ্যা কয়েক হাজার।

হবিগঞ্জে খোয়াই নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে

প্রবল বর্ষণ ও উজানের পাহাড়ি ঢলে হবিগঞ্জে খোয়াই নদীতে পানি বাড়ছে। সোমবার (২০ জুন) বিকেল ৪টার দিকে খোয়াই নদীর পানি বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে দেখা গেছে।

বাল্লা সীমান্তে বাংলাদেশ অংশে নদীর প্রবেশদ্বারে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বন্যায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। নবীগঞ্জ ও আজমিরীগঞ্জের পর এবার লাখাই উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে।

জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মিনহাজ আহমেদ শোভন জানান, কুশিয়ারার পানি অব্যাহতভাবে বাড়ছে। নদীর বাঁধ উপচে পানি হাওরে প্রবেশ করার ফলে নতুন নতুন গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। দিঘলবাগ, ইনাতগঞ্জ, বড় ভাকৈর, আউশকান্দি ইউনিয়নের গ্রামগুলো প্লাবিত হচ্ছে।

তিনি আরও জানান, সোমবার সকাল থেকে খোয়াই নদীতে পানি বাড়ছে। বিকেল ৪টায় শহরের মাছুলিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। রাতে পানি আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

বানভাসি মানুষের পাশে বিজিবি

সিলেট ও সুনামগঞ্জে আকস্মিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বানভাসিদের উদ্ধার, প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রী বিতরণ এবং জরুরি চিকিৎসাসেবা দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এ পর্যন্ত তিন হাজার ক্ষতিগ্রস্ত বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে বিজিবি।

সোমবার (২০ জুন) বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

এতে বলা হয়, বিজিবির সিলেট ব্যাটালিয়নের (৪৮ বিজিবি) তত্ত্বাবধানে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার শিমুলতলা গ্রামের বন্যার্ত ২৫০ পরিবারের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। অপরদিকে, সুনামগঞ্জ ব্যাটালিয়নের (২৮ বিজিবি) তত্ত্বাবধানে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার বন্যার্ত ২০০ পরিবারের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। এসময় বিজিবির সরাইল রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শহীদুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।

এছাড়া সুনামগঞ্জ ব্যাটালিয়নের (২৮ বিজিবি) তত্ত্বাবধানে সুনামগঞ্জ ব্যাটালিয়ন সদরের সামনে বন্যার্ত প্রায় ৪০০ জন মানুষকে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়া এবং তাদের মধ্যে ওষুধ বিতরণ করা হয়েছে।

এছাড়া বন্যাকবলিত লালাখাল এলাকার নিশ্চিতপুর ও লালাবস্তি গ্রামে আটকেপড়া ২২ বানভাসি পরিবারকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়াসহ তাদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছে বিজিবির জকিগঞ্জ ব্যাটালিয়ন (১৯ বিজিবি)।

বিজিবির ময়মনসিংহ সেক্টরের নেত্রকোনা ব্যাটালিয়নের (৩১ বিজিবি) তত্ত্বাবধানে দুর্গাপুর উপজেলার বন্যার্ত ১৫০ পরিবার এবং জামালপুর ব্যাটালিয়নের (৩৫ বিজিবি) ব্যবস্থাপনায় কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলা আলগা বিওপির সীমান্তবর্তী এলাকার বন্যাকবলিত ৩০ পরিবারের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে।

বিপৎসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপরে তিস্তার পানি

টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সোমবার (২০ জুন) দুপুরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আসফাউদদৌলা এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

তিনি বলেন, হাতীবান্ধা উপজেলার দোয়ানী পয়েন্টে বিপদসীমার ৩৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ভারত থেকে প্রচুর পরিমাণে পানি বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। তিস্তা পাড়ের মানুষদের নিরাপদে সরিয়ে যেতে বলা হচ্ছে।

এর আগে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে দিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ইতোমধ্যে জেলার পাঁচ উপজেলার তিস্তা পাড়ের অন্তত ৩ লাখ মানুষ আতঙ্কে দিন কাটছে।

জেলার পাটগ্রামের দহগ্রাম, হাতীবান্ধা উপজেলার সানিয়াজান, গড্ডিমারী, সিঙ্গীমারী, সিন্দুর্না ইউনিয়নে পাঁচ শতাধিক বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করেছেন।

বন্দি হাওরের লাখো মানুষ

কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলের ঘোড়াউত্রা ও কালনী নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। উজানের পানি দ্রুত হাওরে প্রবেশ করছে। এতে করে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

ইতোমধ্যে জেলার অষ্টগ্রাম, ইটনা, মিঠামইন উপজেলার শতাধিক গ্রামের প্রায় দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এছাড়া করিমগঞ্জ, তাড়াইল, নিকলী, বাজিতপুর ও ভৈরবের নিচু এলাকা বন্যায় ডুবে গেছে। এসব এলাকার রাস্তাঘাট, বসতবাড়ি, বাজার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি উঠেছে। ভেসে গেছে হাজার হাজার মাছের খামার। প্রশাসনের উদ্যোগে তিন শতাধিক আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সেসব কেন্দ্রে এরইমধ্যে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ১০ হাজার মানুষ।

শতভাগ হাওর অধ্যুষিত ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার বেশিরভাগ এলাকা এখন পানির নিচে। এই তিন উপজেলার এক লাখেরও বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।

ইটনা এলাকায় অলওয়েদার সড়কের কাছাকাছি চলে এসেছে পানি। মিঠামইন উপজেলার প্রায় ৫ শধাধিক পরিবারকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনা হয়েছে। অষ্টগ্রামে ৩১টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বন্যাকবলিতরা এসে এসব কেন্দ্রে আশ্রয় নিচ্ছেন।

নেত্রকোনায় আশ্রয়কেন্দ্রে লক্ষাধিক মানুষ

নেত্রকোনায় সার্বিকভাবে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে মদন ও খালিয়াজুরিতে পানি আরও বাড়ছে। অন্য উপজেলাগুলোতে পানি অপরিবর্তীত আছে। ৩২৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে অন্তত ১ লাখ ৬ হাজার ৬৮৮ মানুষ ঠাঁই নিয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মোহনলাল সৈকত জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ভারী বৃষ্টিপাত না হওয়ায় কলমাকান্দা, দুর্গাপুর ও বারহাট্টায় বন্যার পানি কমতে শুরু করছে। দুর্গাপুরের সোমেশ্বরী নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে পানি এখন বিপৎসীমার ৫৮৭ সেন্টিমিটার নিচে আছে। ওই পয়েন্টে বিপৎসীমা ১৫ দশমিক ৮৯ মিটার। তবে উব্দাখালি নদীর পানি কলমাকান্দা পয়েন্টে বিপৎসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। খারিয়াজুরির ধনু নদের পানিও বিপৎসীমার ৬৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে ভারী বৃষ্টিপাত না হলে বন্যার পরিস্থিতি উন্নতির দিকে যাবে।

জানাজা-দাফনেও বিপত্তি

নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। বাড়ির আঙিনা, ফসলের মাঠ, কবরস্থান সব জায়গাই ডুবে আছে। কোথাও এতটুকু শুকনো জায়গা নেই। ফলে এখন মানুষ মারা গেলে জানাজা কিংবা দাফন সব কিছুতেই বিপত্তি। খাটিয়া কাঁধে নিয়ে বহনের সুযোগও নেই। ভরসা শুধু কলাগাছের ভেলায়।

শনিবার (১৮ জুন) রাতে মারা যান মোহনগঞ্জের পানুর গ্রামের বাসিন্দা ও আওয়ামী লীগ কর্মী মানিক মিয়া (৩৮)। মৃত্যুর পর তার জানাজা পড়ার স্থান নিয়ে বাধে বিপত্তি। কারণ পুরো গ্রামই তলিয়ে আছে বন্যার পানিতে। পরে গ্রামবাসী সিদ্ধান্ত নেয় উঁচু এলাকার রাস্তায় জানাজা পড়ানো হবে। কিন্তু সেখানে মরদেহ নিয়ে যাওয়া ছিল আরো দুরূহ ব্যাপার।

সমস্যা সমাধানে বানানো হয় কলাগাছের ভেলা। আর সেই ভেলায় করে মানিকের মরদেহ নেওয়া হয় সমাজ গ্রামের রাস্তায়। রোববার সন্ধ্যায় জানাজা শেষে তার মরদেহ দাফন করা হয়। মৃত মানিকের এক ছেলে ও দুই মেয়ে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নিজের অটোরিকশায় চার্জ দিতে গিয়ে শনিবার রাতে তার মৃত্যু হয়।

বিপৎসীমার ১০৩ সে মি ওপরে মুহুরী নদীর পানি

টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে বিপৎসীমার ১০৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ফেনীর মুহুরী নদীর পানি। বাঁধ ভেঙে জেলার ফুলগাজী উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে।

সোমবার (২০ জুন) সকাল ৮টার দিকে উপজেলার উত্তর দৌলতপুর গ্রামের নুরুর বাড়ি সংলগ্ন স্থানে বাঁধ ভেঙে অন্তত তিন গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বন্যার পানিতে উপজেলার ফুলগাজী বাজার, উত্তর দৌলতপুর, দক্ষিণ দৌলতপুর, বৈরাগপুরসহ আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। পানির চাপ বাড়ায় মাছের ঘের, জমির ফসল, গবাদি পশু নিয়ে স্থানীয়রা নিরাপদে আশ্রয় নিতে শুরু করেছেন।

বিপৎসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার ওপরে যমুনার পানি

বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে জামালপুরের ৬ উপজেলার অন্তত ৩০ গ্রাম। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে জেলার ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, বকশিগঞ্জ, মাদারগঞ্জ, মেলান্দহ ও সরিষাবাড়ী উপজেলার অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ। বন্যার পানি প্রবেশ করে জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে।

সোমবার (২০ জুন) সকালে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি পরিমাপক আব্দুল মান্নান জানান, পাহাড়ি ঢলে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রসহ সব নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি ২২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার এবং ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি ১৪ দশমিক ৩ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ১৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, গত কয়েকদিনের পাহাড়ি ঢলে ইসলামপুর উপজেলার চিতালু, কুলকান্দি, বেলগাছা, নোয়ারপাড়া ও সাপধরী ইউনিয়ন এবং দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার চুকাইবাড়ী, বাহাদুরাবাদ ও চিকাজানী ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। এছাড়াও বকশিগঞ্জ, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ী উপজেলার কিছু কিছু নিম্নাঞ্চলের রাস্তা-ঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ ফসলি মাঠ তলিয়ে গেছে। দেখা দিয়েছে নদী ভাঙন। এতে আতংকিত হয়ে পড়েছে ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষ।

সোনালীনিউজ/এনএন