মাদারীপুর: ভুয়া কাগজপত্র দাখিল করে পদ্মা সেতুর বিভিন্ন প্রকল্প থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে একটি দালাল চক্রের বিরুদ্ধে। মাদারীপুর জেলা প্রশাসন থেকে ২০ জন দালালের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এদেরই একজন হুমায়ন ঢালী। তিনি আগে ছিলেন ছাগলের দালাল। এই কয়েক বছরে তিনি হয়েছে কোটিপতি। সরেজমিন অনুসন্ধান করে এমনই তথ্য পাওয়া গেছে।
সরেজমিন অনুসন্ধান করে জানা গেছে, শরিয়তপুরের জাজিরা উপজেলার বিকেনগর ইউনিয়নের হাওলাদারকান্দি গ্রামের আবদুল হক ঢালীর ছেলে হুমায়ুন ঢালী। ৫ বছর আগেও জাজিরার কাজির হাটসহ কয়েকটি হাটে ছাগল বিক্রির দালালীর পাশাপাশি জমিতে ট্রাক্টর চালিয়ে হাল চাষ করতেন। দরিদ্র পরিবারের ও দিনমজুরের সন্তান হুমায়ুনের একসময় নিজের ভিটেমাটি ছাড়া আর কোন জমি ছিলোনা। গত ৫ বছরের হয়েছেন কোটি কোটি টাকার সম্পতির মালিক। নিজের নামে কোটি কোটি টাকার জমি ক্রয়েরও খবর পাওয়া গেছে। মাত্র কয়েক বছরে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া হুমায়ুন এখন মাদারীপুর ও শরিয়তপুর জেলায় এখন আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে পরিনত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, শরীয়তপুর-নাওডোবা সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় তিনটি প্যাকেজে ২৭ কিলোমিটার সড়ক চার লেন, ২৭টি কালভার্ট ও ২টি সেতু নির্মাণ করা হচ্ছ। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ২৩১ কোটি ১৮ লাখ টাকা ধরা হয়েছে জমি অধিগ্রহণে। আর এই ক্ষতিপূরণের টাকা দিচ্ছে শরীয়তপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে। শরীয়তপুর থেকে নাওডোবা পর্যন্ত সড়ক চার লেন করার প্রকল্প অনুমোদন পাওয়ার পর থেকেই দুই পাশে স্থাপনা নির্মাণের হিড়িক পড়েছে।
সরেজমিনে নাওডোবা -জাজিরা আঞ্চলিক সড়কের বিকেনগর ইউনিয়নের দৈনিক বাজার এলাকায় হুমায়ন ঢালীর বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, সেখানে পাঁচতলা বিশিষ্ট অট্টালিকা নির্মাণাধীন রয়েছে। ইতোমধ্যে দুই তলার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়াও অতিরিক্ত বিল উত্তোলন করার উদ্দেশ্য তার বাড়িতে টিনের ৫ টি চৌচালা ঘর উত্তোলন করা হয়েছে।
এদিকে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে যেসব চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। তার মধ্যে গত ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২০ সালে বিকেনগর এলাকার চানমিয়া শেখের নিকট থেকে ২২ শতাংশ জমি ক্রয় করেন। যার দলিল নং ৮০১/২০। গত ৯ জুন ২০২০ সালে একই এলাকার জলিল শিকদারের নিকট থেকে ১৬.৫ শতাংশ জমি ক্রয় করেন। যার দলিল নাম্বার ১২৮৭/২০।গত ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২০ তারিখে একই এলাকার দানেছ শেখের নিকট থেকে ২১ শতাংশ জমি ক্রয় করেন। যার দলিল নং ৬৬৩/২০। গত ৬ আগষ্ট ২০১৯ তারিখে একই এলাকার আবদুল জলিল শিকদারের নিকট থেকে ১৬.৫ শতাংশ জমি ক্রয় করেন। যার দলিল নং ৩১২৩/১৯।
এদিকে হুমায়ূন ঢালীর নিজ নামে ক্রয় করা জমি বিক্রেতা জাকির শিকদার বলেন, 'আমি গত দেড় দুই বছর আগে দুইটা জমি হুমায়ূন ঢালীর নিকট বিক্রি করেছি। জমির পরিমান একটা ৪ কাঠা, অন্যটি ৫ কাঠা। একটি ২৩ লক্ষ টাকা, অন্যটি ৫ লক্ষ টাকা। হঠাৎ শুনি হুমায়ূন ঢালী অনেক জমি কিনতেছে। তখন তার কাছে জমি বিক্রি করেছি। শুনেছি ব্রীজের ওখান থেকে (পদ্মা সেতু) টাকা কামাই করছে। মানুষের বিল নাকি কি করে নিয়ে গেছে। কেমনে কি করছে তা জানিনা।'
আরেক জমি বিক্রেতা ইদ্রিস হাওলাদার বলেন, 'আমি ৭ শতাংশ ও আমার চাচা ২০ শতাংশ জমি হুমায়ূন ঢালীর নিকট বিক্রি করেছেন। ১ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা করে শতাংশ দাম দিয়েছে। হুমায়ুন ঢালী আগে সংসারী কাজ করতো। কোথায় এত টাকা পেলো তা জানিনা। সে ৫/৬ বিঘা জমি কিনেছে জানি।'
এই ব্যাপারে জাজিরা উপজেলার বিকেনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাজী ইস্কান্দার আলী ভূইয়া বলেন, 'আমি দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলাম। গত এক বছর আগে দেশে এসে নির্বাচন করে চেয়ারম্যান হয়েছি। হুমায়ন ঢালীকে আমি ব্যাক্তিগত ভাবে চিনি। ৫ বছর আগেও নিম্ন ফ্যামিলির ছিলো তারা। এখন অর্থবিত্ত প্রতাবশালী হয়েছে। তবে কিভাবে এত টাকা পয়সা, অর্থবিত্ত হইলো, কি ব্যবসা করে, তা আমার জানা নাই। আমি জানি ৫/৭ বছর আগে এমনিই কৃষি কাজ করতো। বর্তমানে আমাদের সাথে রাজনীতিতে জড়িত সে। তাকে কোনো পদ দেওয়া নাই। নির্দিষ্ট কোনো ব্যবসা নাই তার। এখন আবার দুবাই যাওয়া আসা করে।'
স্থানীয় খোকন হাওলাদার বলেন, 'হুমায়ুন ঢালী আমার পরিচিত, আমাদের পাশেই বাড়ি। ছোট থেকে একত্রেই বড় হয়েছি। ওরে ৪ বছর আগেও মেশিন (পাওয়ার টিলার) চালাইতে, কৃষি কাজ করতে দেখেছি। কাজীর হাটে বকরী ছাগলের দালালী করতে। হটাৎ করেই দেখি ও অনেক জমিজমা কিনেছে। অনেক বড় বিল্ডিং করছে। কদিন আগে টিভিতে দেখেছি মাদারীপুরের ডিসি তার নামে দুদকে একটা মামলা দিয়েছে।'
হুমায়ূন ঢালীর মা জমিলা খাতুন বলেন, হুমায়ন আগে মেশিন (পাওয়ার টিলার) চালাইছে, ধান পান ভাঙ্গাইছে। আমার বাবার কালের জায়গা জমির টাকা পয়শা পাইছি ২০ লক্ষ। অন্য ছেলেদেরসহ হুমায়ূন কে সেই টাকার ভাগ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
হুমায়ন ঢালীর মেয়ে ফাতেমা আক্তার (১৯) এর নিকট তার বাবার এত অর্থ সম্পদের উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার বাবা দুবাইতে অন্যরকমের ব্যবসা, যেমন, সাবান শ্যাম্পু, কসমেটিক্স এর ব্যবসা করেন।
এই ব্যাপারে হুমায়ূন ঢালীর বক্তব্য নিতে তার বাড়িতে গেলে তিনি পরিচয় গোপন করে কৌশলে সটকে পরেন। পরে তাকে ফোন করা হলে তিনি বিভিন্ন ব্যস্ততা দেখিয়ে বলেন, ‘আমি বিদেশে ছিলাম, বর্তমানে দুবাই থেকে কসমেটিক্স এর ব্যবসা করি। ব্যবসার লাইসেন্স নেই, তবে এয়ারপোর্টে ট্যাক্স দিই। আমার নানার কালে ৫০ বিঘা জমির বিল পেয়েছি। বাবার কালের দেড় কোটি টাকার জমি বিক্রি করেছি আমরা চার ভাই। আমি কোনো জমি কিনিনাই। সদ্য নির্মিত তার এত বড় অট্রালিকা বাড়ি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমার বাড়ি আমার বাবা করে রেখে গেছেন। আমার বাবা মারা গেছেন ৭ বছর আগে। বাবা একজন কৃষক ছিলেন। এগুলো সব মিথ্যা কথা।'
এবিষয়ে শরিয়তপুর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সাইফুদ্দিন গিয়াস বলেন,'আমাদের এখান থেকে কোন ধরনের অনৈতিক কাজ করার সুযোগ নেই। দালালদের তালিকা পেলে প্রয়োজনে আমাদের অফিসে টাঙিয়ে রাখা হবে। কেউ যাতে অনৈতিক সুবিধার না নিতে পারে তার জন্য আমরা প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।'
এবিষয়ে মাদারীপুর পুলিশ সুপার মাসুদ আলম বলেন, 'নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তি নয় আমরা সবার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব। যারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ করেছে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। আমরা তদন্তপূর্বক সবার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেব।
সোনালীনিউজ/এএইচ/এসআই